শহীদ স্মৃতি অমর করে রাখতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ
জাতীয় জীবনে কখনাে কখনাে এমন কিছু ঘটে, যার প্রতীকী রূপ সেই জাতিকে পথ দেখায়; হয়ে ওঠে প্রেরণার উৎস। একুশের ভাষা আন্দোলন তেমন একটি প্রতীকী উৎস ‘শহীদ মিনার’ জাতিকে উপহার দিয়েছে। শহীদ মিনার আমাদের জন্য হয়ে আছে প্রতিবাদ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতীক। সর্বোপরি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রেরণা। আর সে জন্য আমাদের বারবার যেতে হয় ওই শহীদ মিনারে। যেতে হয় পথ ঠিক করে নিতে, আদর্শিক শক্তি অর্জনের জন্য। একুশের রক্তাক্ত স্মৃতি নিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ যখন ছাত্র-জনতার প্রতিবাদী পদচারণে উত্তাপ ছড়াচ্ছে, তখন সবকিছু ছাপিয়ে শােনা যাচ্ছিল ‘শহীদ স্মৃতি অমর হােক’ স্লোগান। আর শহীদ স্মৃতি অমর করে রাখতে হঠাৎ করেই মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ছাত্রের মনে এল একটা ছােটখাটো স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির কথা। হােক ছােট। প্রতীকের গুরুত্ব ছােট-বড়র হিসাব মানে না। যেমন ভাবা তেমন কাজ। দিনটা ছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি। গােলাম মাওলাসহ আন্দোলনে সক্রিয় নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ছাত্র পুলিশের গুলি ও শহীদদের নিয়ে আলােচনা করতে গিয়ে হােস্টেল প্রাঙ্গণে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির সিদ্ধান্তে আসেন। আলােচনা চলে কীভাবে কারফিউয়ের মধ্যে কাজটা শেষ করা যাবে। এ কাজের পরিকল্পনা থেকে শেষ পর্যন্ত সবই ছিল যৌথ চিন্তা ও সম্মিলিত শ্রমের ফসল। আর একান্তভাবেই তা করেছেন মেডিকেল ব্যারাকের ছাত্ররা। বিশ্ববিদ্যালয় বা কোনাে সংগঠনের নেতা-কর্মী এতে অংশ নেওয়ার সুযােগ পাননি।
এ সত্যটা একুশের ইতিহাস পাঠক মাত্রেরই জানা দরকার। যেকোনাে স্থাপত্যকাজের জন্য দরকার নকশা। শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির জন্য। নকশা আঁকার দায়িত্ব পড়ে বদরুল আলমের ওপর। পরে তার সঙ্গে যােগ দেন। সাঈদ হায়দার। গুটিকয় খসড়া রেখাচিত্র বাতিলের পর যেটা গৃহীত হলাে, সেটার ওপর ভিত্তি করেই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির প্রস্তুতি শুরু হয়। কলেজ সম্প্রসারণ কাজের জন্য কলেজ প্রাঙ্গণে জমা করা ইট-বালু ব্যবহারে কোনাে সমস্যা ছিল না। কিন্তু সিমেন্ট তাে গুদামে তালাবদ্ধ। তাই যেতে হলাে কলেজের কাজের জন্য মনােনীত সাব-কন্ট্রাক্টর পিয়ারু সরদারের কাছে। সব শুনে সরদার সাহেব নির্দ্বিধায় ছাত্রদের হাতে গুদামের চাবি। তুলে দিয়ে বলেন, যে কয় বস্তা দরকার তা নিয়ে গুদাম বন্ধ করে চাবিটা যেন তাকে ফেরত দেওয়া হয়। একুশে এবং ছাত্রসমাজ জনমনে কতটা স্থান করে নিয়েছিল, এ ঘটনা থেকে তা বােঝা যায়। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে নকশা আঁকিয়ে হিসেবে সম্প্রতি কারও কারও লেখায় নতুন নাম যােগ করা হচ্ছে, যা একান্তই উদ্দেশ্যমূলক ও একেবারেই ভিত্তিহীন। নকশা, মালমসলা, এমনকি একজন রাজমিস্ত্রিও জোগাড় হওয়ার পর এবার স্থান নির্বাচন। ১২ নম্বর শেডের সামনে এবং হােস্টেলের হাঁটাচলার রাস্তাটার পাশে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির স্থান ঠিক হয়।
জায়গাটা বরকতের গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থান থেকে সামান্য দূরে এ স্থাপত্যকর্ম তদারকির দায়িত্বে ছিলেন কলেজ ইউনিয়নের তৎকালীন। জিএস শরফুদ্দিন আহমদ, যিনি বন্ধুদের কাছে ইঞ্জিনিয়ার নামে পরিচিত ছিলেন। কারণ, ওই কাজের সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন, পরে আসেন ডাক্তারি পড়তে। কারফিউর রাত। গেটের বাইরে রাস্তায় সশস্ত্র টহলদারি। এর মধ্যেই সাহসী। ছাত্ররা খাওয়াদাওয়া শেষে রাত ১০টা থেকে কাজ শুরু করে দেন। হােস্টেলে উপস্থিত প্রায় সবাই একটুখানি হলেও কাজে হাত লাগিয়েছেন। এমনকি হােস্টেলের বয়-বাবুর্চিরাও। কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে মানববন্ধনের মতাে করে দাড়িয়ে হাতে হাতে ইট টানা, হাসপাতালের স্ট্রেচারে বালু আর সিমেন্ট বহনের মতাে কাজ সবই ছাত্রদের শ্রমে। বলতে হয়, সে রাতে জোগালি-শ্রমিকের কাজ করেছিল মেডিকেল হােস্টেলের বেশ কিছুসংখ্যক ছাত্র খুব ভােরে কাজ শেষ। সারা রাতের ঘামঝরানাে শ্রম শেষে যে স্মৃতিস্তম্ভের স্থাপত্য তৈরি হয়, তা ছিল সাড়ে ১০ ফুট উচু, ছয় ফুট চওড়া। এর নামফলকে লেখা ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’, ফলকের আঁকিয়ে বদরুল আলম। পলেস্তারার কাজ শেষ হলে কালাে কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয় স্থাপত্যটি। ছােট ছােট খুঁটি পুঁতে দড়ি বেঁধে ঘিরে দেওয়ার পর দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় লাল অক্ষরে লেখা পােস্টার। তাতে ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হােক’, ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু কর’, ‘রাষ্ট্রভাষা তহবিলে মুক্তহস্তে দান করুন’ ইত্যাদি। সারা রাতের শ্রম শেষে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির কারিগর সবাই যে যার ঘরে। তখন তারা ভাবতেও পারেনি, এ স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে শহরের মানুষ-নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সবাই গভীর আবেগ নিয়ে ছুটে আসবে। আর তাদের হাতে এক রাতের শ্রমে গড়া স্মৃতিস্তম্ভ মাজারের মর্যাদা পেয়ে যাবে। বাস্তবে তা-ই ঘটেছিল। কুয়াশাভেজা ভােরের সেই স্মৃতি কখনাে ভুলে যাওয়ার নয়। বিশেষ করে যখন তা এক ঐতিহাসিক স্থাপত্যের সমাপন।
সূত্র : ভাষা আন্দোলন – আহমদ রফিক