You dont have javascript enabled! Please enable it!

আন্দোলন অব্যাহত প্রতিক্রিয়া ও সম্ভাবনা

ঝােড়াে হাওয়ার উদ্দামতা নিয়ে বৃহস্পতি, শুক্র (২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি) দুটি দিন শেষ হয়, কিন্তু বিক্ষোভ-আন্দোলন শেষ হয় না। শহর ঢাকা তখনাে ছাত্র নেতৃত্বের ছকমাফিক চলতে থাকে। ১৮ বছর পর এমন ঘটনা আরও ব্যাপকভাবে দেখা গেছে। জাতীয় চেতনার টানে। বায়ান্নতে তার সূচনা। ঢাকার পথে পথে মিছিলের পর মিছিল। এমনই এক ক্লান্ত মিছিলে শক্তি সঞ্চার করতে জনৈক বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র সজোরে স্লোগান তােলে : রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বাংলা চাই’। এরপর সেই আবেগের টানে হঠাৎই উচ্চারিত হয় : বাংলা ভাষা বাংলা ভাষা : রাষ্ট্র চাই রাষ্ট্র চাই’ । মিছিলে তখন চাপা হাসি। ইচ্ছায় হােক, অনিচ্ছায় হােক ওই স্লোগানে সেদিন কি দেশের রাজনৈতিক ভবিতব্য ভর করেছিল? ভর করেছিল ভাষিক রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা? স্লোগান শুধরে নিয়ে মিছিল আবার পথ চলতে থাকে। এ ঘটনা ঘটেছিল ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সামনের রাস্তায়। শনিবারও (২৩ ফেব্রুয়ারি) যথারীতি স্বতঃস্ফূর্ত পূর্ণ হরতাল, মিছিলে-স্লোগানে সরব ঢাকা আন্দোলনের অস্তিত্ব জানিয়ে দিচ্ছে। ১৪৪ ধারার মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে রাজপথে জনতার ঢল। তা সত্ত্বেও পুলিশের লাঠিচার্জ ও রাতের কারফিউ অব্যাহত থাকে। সেনা জওয়ানদের টহল বন্ধ হয় না। সেসব উপেক্ষা করে সচিবালয়সহ অফিস-আদালতে ধর্মঘট চলছে, রেল বন্ধ, এয়ার অফিস বন্ধ। বাঙালি রেল কর্মচারীদের ওপর গুলি চলে এবং অভাবিত ঘটনা যে গুলি চালাতে অস্বীকার করায় পুলিশের একাংশের অস্ত্র ‘সিজ’ করা হয়। গ্রেপ্তার হন এক হাবিলদারসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। একুশের আবেদন ছিল এতটাই গভীর, এতটাই হৃদয়স্পর্শী ।

সেনাবাহিনী মেডিকেল ব্যারাকের কন্ট্রোল রুম থেকে বেয়নেটের মুখে মাইক ছিনিয়ে নেওয়ার পর সুরক্ষিত সলিমুল্লাহ হলের মাইকই প্রধান ভূমিকা পালন করে। এর সার্বক্ষণিক দায়িত্বে ছিলেন ওই হলের বাসিন্দা ইকরামুল আমিন। ফজলুল হক হলেও তখন আন্দোলনের কর্মসূচি ও অন্যান্য প্রচারের জন্য কন্ট্রোল রুম খোেলা হয় । কিন্তু এহ বাহ্য। একুশের দুই দিনব্যাপী  বিষয় ছিল পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন। শুধু নিরক্ষবলয়ই নয়, ডানপন্থী অনেক সংগঠনই তখন পুলিশি জুলুমের নিন্দায় সােচ্চার হয়ে ওঠে। আলিয়া মাদ্রাসা, তিব্বিয়া হাবীবিয়া কলেজও বাদ যায় না। ব্যাংক কর্মচারী সমিতিও এ ব্যাপারে পিছিয়ে থাকেনি।  তবে রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল পরিষদ সদস্য আবুল কালাম শামসুদ্দিনের পর মাওলানা তর্কবাগীশেরও পদত্যাগ। সরকারবিরােধী মনােভাবের ব্যাপক বিস্তার মুসলিম লীগ দলে ভাঙনের সূচনা ঘটায়। জনাব তর্কবাগীশের পথ ধরে একাধিক সদস্য মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন। শামসুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হয় আইন পরিষদে নতুন বিরােধী দল। সরকারবিরােধী প্রতিক্রিয়ার টানে আরও গঠিত হয় ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা কমিটি’। এতে উল্লেখযােগ্য ব্যক্তি হলেন শেরেবাংলা, মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম, কামরুদ্দীন আহমদ, আনােয়ারা খাতুন প্রমুখ। সরকার ও তার দলের পায়ের নিচ থেকে এভাবে মাটি সরে যেতে থাকে।

স্বনামখ্যাত ব্যক্তি অনেকে সরকারি অনাচারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভে-প্রতিবাদে সােচ্চার হয়ে ওঠেন। এ কে ফজলুল হক ছাত্রদের দাবি জয়যুক্ত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন বলে জানান। আর মওলানা ভাসানী তার স্বভাবসুলভ কণ্ঠে বলেন : ‘আমি দাবি করি অবিলম্বে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হােক, পুলিশি গুলির তদন্তের জন্য হাইকোর্টের জজ ও জনপ্রতিনিধি নিয়ে কমিশন গঠন করা হােক। আমি অপরাধীদের প্রকাশ্য বিচার দাবি করিতেছি।’ তাঁর মতে, নুরুল আমিন ইতিহাসের দাবি অস্বীকার করছেন। অত্যাচার মানুষের বিক্ষোভ বাড়ায়, চাপা দিতে পারে না। তবে ব্যক্তিক প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর হলাে, মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি মােহন মিঞার বিবৃতি : ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের সংবাদ শুনিয়া স্তম্ভিত হই ।…অবিলম্বে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি কর্তৃক পুলিশি জুলুমের তদন্তের জন্য সরকারের নিকট দাবি জানাইতেছি।’ তাদের পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় ছাত্রদের পক্ষে আরও একাধিক প্রস্তাব গ্রহণের ঘটনা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য। এসবের পেছনে উদ্দেশ্য যা-ই থাক, এ কথা ঠিক যে। একুশের আন্দোলন সরকার ও ক্ষমতাসীন দলকে গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছিল। বিনষ্ট ভাবমূর্তি উদ্ধারই তখন তাদের প্রধান লক্ষ্য। অর্থাৎ সংকট থেকে উত্তরণ। একুশের আন্দোলন সূচনা-দিন থেকে দেশময় যে বিক্ষোভ-প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়, তা মূলত শিক্ষায়তনকেন্দ্রিক তথা ছাত্র-অঙ্গনের হলেও এর প্রভাব জনমন স্পর্শ করেছিল। এর কতটা রাজনৈতিক সচেতনতাসিদ্ধ, সে বিষয়ে কোনাে জরিপের হিসাব নেই। কিন্তু প্রভাব ছিল বলেই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা দল মুসলিম লীগ দুই বছরের মধ্যেই নির্বাচনে চরম পরাজয়ের সম্মুখীন হয়। এটা সত্যই  অবিশ্বাস্য ঘটনা। মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের নাড়ির বন্ধন থাকে বলেই সেখানে আঘাত চেতন-অচেতনের হিসাব ছাড়িয়ে যায়। বােদ্ধা রাজনৈতিক বিশ্লেষক কারও কারও ধারণা, এর প্রভাব পশ্চিম পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতেও কিছুটা পড়েছিল। গণতন্ত্রী ও বামপন্থী নেতারা এর সঠিক মূল্যায়নে রাজনৈতিক সম্ভাবনার কথাও ভাবেন। তাই মিয়া ইফতেখারউদ্দিন, জি এম সৈয়দ, আবদুল মজিদ সিন্ধী প্রমুখ পূর্বোক্ত ঘরানার নেতা এককাট্টা হয়ে নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করতে ফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। মাত্র দিন কয়েকের আয়ু নিয়ে একুশে ইতিবাচক এক রাজনৈতিক সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছিল। একুশের তাৎপর্য নিয়ে যারা ভাবেন, তারা এ কথা মানেন।

সূত্র : ভাষা আন্দোলন – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!