You dont have javascript enabled! Please enable it!

একুশের সন্ধ্যারাতটা শাসকদের জন্য ছিল কালবেলার মতাে

একুশে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যারাতের সময়টা শাসকদের জন্য বােধ করি কালবেলার মতাে হয়ে ওঠে। যেমন পরিবেশে, তেমনি ঘটনার তাৎপর্যে। তখন মেডিকেল হােস্টেল প্রাঙ্গণে ছুটে আশা মানুষের পায়ে পায়ে ওঠা ধুলাে আর কাঁদানে গ্যাসের ধােয়াটে গন্ধের অবশিষ্ট মিলে এক অভাবিত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। ছাত্র-জনতার শােক ও কান্না শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে এক ধরনের ঘৃণা ও শক্তির জন্ম দেয়, যা আন্দোলনের জন্য হয়ে ওঠে বিস্ফোরক পুঁজি। সে পুঁজির সদ্ব্যবহারে পরদিন এগিয়ে আসে ঢাকাই ছাত্র-যুবা-জনতার আবেগ, যা মিছিলে, স্লোগানে ও তৎপরতায় প্রকাশ পায়।  ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় এবং পরদিন। আমতলার ছাত্রসভায় যেসব ছাত্র-যুবা ও রাজনৈতিক নেতা ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা ভাঙার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, তাদেরই কেউ কেউ একুশের কালসন্ধ্যায় চোখের জলে ভিজে শহীদদের প্রতি সমবেদনা জানাতে এসেও ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে হঠকারী পদক্ষেপ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। বিলুপ্ত সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গােলাম মাহবুব একই মানসিকতায় ২২ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিসংবলিত ইশতেহারের খসড়ায় স্বাক্ষর দিতে অস্বীকার করেন (আবদুল মতিন)।  কিন্তু রক্ত ঝরানাে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে উদ্দীপনার জন্ম, তার টানে সেদিন। এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় যা একুশের আন্দোলনকে জনসমর্থনে শক্তিমান। করে তােলে । সংগ্রাম পরিষদেরই সিদ্ধান্তমতাে পরিস্থিতির বিচারে পরিষদ বিলুপ্ত হওয়ার কথা। তাই মেডিকেল কলেজ ইউনিয়নের ভিপি গােলাম মাওলার কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তাকেই সংগ্রাম পরিষদের অস্থায়ী আহ্বায়ক মনােনীত করা হয় । সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির । সেসব কর্মসূচির মধ্যে ছিল পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদদের নিয়ে হােস্টেল। প্রাঙ্গণে জানাজা অনুষ্ঠান ও শােকসভা, তাদের লাশ ও রক্তমাখা কাপড়ের পতাকা নিয়ে ঢাকার রাজপথে মিছিল, বাড়িতে বাড়িতে কালাে পতাকা তােলা এবং শােকচিহ্ন হিসেবে প্রত্যেকের বুকে বা বাহুতে কালাে ব্যাজ ধারণ ।

জনমানসে  উদ্দীপনা জোগাতে এবং আন্দোলনের সঙ্গে জনচেতনাকে একাত্ম করে তুলতে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইনসাফ ও আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য একই কথা বলে | এদিকে মেডিকেল কলেজের অ্যানাটমি হলের পেছনের ঠান্ডা বারান্দায় আলােআঁধারে রক্তাক্ত রফিকউদ্দিন শয়ান। অন্যদিকে হাসপাতালের দোতলায় এক কক্ষে আবদুল জব্বারের নিথর প্রাণহীন দেই। আত্মদানেও বুঝি তাদের ভাষিক দায় শেষ হয়নি। আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ ছাত্রদের প্রবল ইচ্ছা, তারা মিছিলে ছাত্র-জনতার সঙ্গী হন। সে উদ্দেশ্য নিয়েই পরদিনের কর্মসূচি, যাতে ঘাতকদের কর্মকাণ্ডের পাল্টা জবাব দেওয়া যায়। জনতার কাঠগড়ায় তাদের যথাযথ বিচারের ব্যবস্থা করা যায়। জানাজা, শােকসভা ও মিছিলের সিদ্ধান্ত ছাড়াও সেদিন সন্ধ্যারাতের। তৎপরতায় ছিল ওই সময়ের মধ্যেই প্রতিবাদী কর্মসূচিসংবলিত ইশতেহার ছেপে প্রতিটি ছাত্রাবাসে বিতরণ এবং গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রাবাস ও সংগঠনের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন। এককথায় একটি সফল আন্দোলনের জন্য কাঠখড় পােড়ানাে। এ কাজটা ছাত্র-যুব নেতৃত্ব ঠিকঠাকমতােই করেছিল, যদিও পুলিশের হাত থেকে রফিকজব্বারের লাশ রক্ষা করতে পারেনি। কিন্তু গুলিবর্ষণ ও হতাহতের ঘটনার ব্যাপক ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের সরকারবিরােধী মনােভাব সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রী ও তার চতুর প্রশাসনের চেতনায় অশুভ সংকেত ছড়িয়ে দিয়েছিল। মেডিকেল ব্যারাকের কন্ট্রোল রুম থেকে মিছিল-কর্মসূচির বিরতিহীন প্রচার যেমন জনমানসে ক্রমাগত ঘণ্টা। বাজিয়ে চলেছিল, তেমনি সতর্ক করে দিয়ে থাকবে চতুর আমলাতন্ত্রকে। তাই ছাত্রদের চোখ এড়িয়ে গভীর রাতে রফিক-জব্বারের লাশ গুম করে ফেলে পুলিশ। দুপুরে এরাই তুলে নিয়েছিল ফুলার রােড থেকে গুলিবিদ্ধ এক কিশােরকে। 

সেদিনই গভীর রাতে বিবেকহীন সরকারের প্রতিনিধিদের উদ্যোগে ওই শহীদদের শেষ আশ্রয় জোটে আজিমপুর কবরস্থানের গণকবরে, তাদের স্বাভাবিক দাফনের সব দাবি অগ্রাহ্য করে। মৌলভি গফুর ও ড্রেসার সুরুজ্জামানের সাক্ষ্যে ওই সত্য বেরিয়ে আসে। আর ২২ ফেব্রুয়ারি খুব ভােরে মেডিকেল কলেজের দুই তরুণ ছাত্র আলমগীর ও আমির আহসান ওই কবরের ওপর থেকে রক্তমাখা কিছু কাপড়চোপড়ের অংশ নিয়ে এসে সেই অপকর্মের হদিস জানায়। | লাশ গুম করেও তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি সরকার। সন্ধ্যারাতের শিখা জনমনে ঠিকই আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। ছাত্রদের নেওয়া কর্মসূচির তীব্র প্রভাব যে সরকারের জন্য এক অশুভ সংকটকাল তৈরি করেছিল, ২২ ফেব্রুয়ারির গণআন্দোলন তার প্রমাণ। আর সে আন্দোলনের জোয়ারে ভেসে যায় ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা। দিন কয়েকের জন্য ছাত্র এলাকা মুক্ত এলাকায় পরিণত হয় । তাই ঢাকার ডিএসপি সিদ্দিক দেওয়ানের ক্ষুব্ধ মন্তব্য: দ্যাশ তাে এখন আপনারাই চালাচ্ছেন।’ 

এলিস কমিশন  বিচারপতির আত্মবিক্রয় একুশে ফেব্রুয়ারি নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ কতটা সংগত ছিল, সে প্রশ্ন নিয়ে বিব্রত সরকার বিচারপতি এলিসকে তদন্তে নিয়ােগ করে। এক সদস্যের ওই তদন্ত কমিশন সরকারের কাছে যে প্রতিবেদন পেশ করে, তা ছিল। পক্ষপাতদুষ্ট এবং তাতে ছিল সরকারকে অপরাধমুক্ত করার অপ্রপ্রয়াস। একজন বিদেশি বিচারপতির কাছ থেকে এ ধরনের অনৈতিকতা কারও হিসাবে মেলেনি। তাই ছাত্র-জনমত ও সরকারবিরােধী রাজনৈতিক অঙ্গন একবাক্যে এলিস কমিশনের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। পত্রপত্রিকায় চলেছে জোর সমালােচনা। এলিস কমিশনের মূল বক্তব্য ছিল ছাত্ররা উচ্ছল, দাঙ্গাবাজ । পুলিশ। যুক্তিসংগত কারণেই ২৭ রাউন্ড গুলি চালিয়েছে এবং তারা হােস্টেলের বাইরে থেকে ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলিবর্ষণ করেছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, পুলিশ তার নিরাপত্তার প্রয়ােজনে গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। আন্দোলনরত মানুষের ওপর গুলি চালানাের যথার্থতা প্রমাণ করতে এ ধরনের কথা প্রশাসন বা সরকারমাত্রই বলে থাকে। নুরুল আমিন ও তাঁর প্রশাসন কর্তৃপক্ষের মুখেও একই কথা শােনা গেছে। অথচ ঘটনা ভিন্ন কথা বলে। গুলিবর্ষণের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত হােস্টেল প্রাঙ্গণে ও বাইরে রাস্তায় সমবেত ছাত্রদের মুখে ছিল রাষ্ট্রভাষাবিষয়ক স্লোগান। সেই সঙ্গে সরকার ও পুলিশি তৎপরতাবিরােধী স্লোগান। তবে তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল পরিষদ ভবনের সামনে পৌছানাে, যে জন্য তারা দলবদ্ধভাবে চেষ্টা করেছে সামনের রাস্তায় পুলিশি বাধা অতিক্রম করতে। কিন্তু পুলিশের লাঠিপেটার মুখে সে চেষ্টা সফল হয়নি। তাদের হাতে না ছিল লাঠি, না ছিল কোনাে ধরনের অস্ত্র, যা পুলিশের নিরাপত্তায় হুমকি হয়ে দাড়াতে পারে। তবে এটা ঠিক যে গুলি চালানাের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তারা তাদের সর্বশক্তি নিয়ে গন্তব্যে পৌছানাের নিরস্ত্র চেষ্টা চালিয়ে গেছে। কমবয়সী স্কুলছাত্রদের কেউ কেউ পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছুড়েছে এ কথা সত্য, পুলিশও পাল্টা সেগুলােই ছুড়েছে ছাত্রদের দিকে। কিন্তু এ ঘটনা কি গুলি চালনার কারণ হতে পারে?  

আরও একটি বিষয়ে বিচারপতি এলিস মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন। তার প্রতিবেদন অনুযায়ী পুলিশ হােস্টেল গেটের বাইরে থেকে গুলি চালিয়েছে, ভেতরে ঢােকেনি। হােস্টেলের গেট, রাস্তা ও শেডগুলাের অবস্থান এবং কারও কারও গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা বিচার করে দেখলে এলিস সাহেবের দাবি সঠিক মনে হয়। কারণ, গেটের বাইরে থেকে চালানাে গুলি আঁকাবাঁকা গতিপথে সর্বপশ্চিমে অবস্থিত ২০ নম্বর শেডের বারান্দায় দাঁড়ানাে আবদুল জব্বারের তলপেটে আঘাত করতে পারে না। তা ছাড়া পুলিশকে গেটের কিছুটা ভেতরে ঢুকে গুলি করতে উপস্থিত ছাত্রদের অনেকেই তাে দেখেছে। আর ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কি কখনাে কারও মাথা লক্ষ্য করে গুলি। ছােড়ে? বুঝতে কষ্ট হয় না যে পুলিশ হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে গুলি ছুড়েছে। তাই বরকতের উরুতে, জব্বারের তলপেটে এবং রাস্তার মােড়ে দাঁড়ানাে অজ্ঞাতপরিচয়। যুবকের পেটে গুলি লেগেছে। ভয় দেখানাে গুলিতে ফুলার রােডে উপস্থিত কিশাের মারা যেত না। সত্যি বলতে কি, এলিস কমিশনের গােটা প্রতিবেদনটিই মিথ্যায় ভরা, একজন বিচারকের চরম অনৈতিকতার প্রতিফলন। এরপরও কথা আছে। মেডিকেল কলেজের যে কজন ছাত্রকে কমিশনে সাক্ষ্য। দিতে ডাকা হয়েছিল, তারাও একবাক্যে বলেছে, গুলি চালানাের মতাে তখন কোনাে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। পুলিশ বিনা প্ররােচনায় গুলি চালিয়েছে। তাদের সাক্ষ্য যে প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তা থেকেও এলিস সাহেবের পক্ষপাতদুষ্ট মনােভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সহপাঠী অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার ডা, আবদুল মালিকের ভাষ্যেও এ কথা জানা যায়। সে সময় মেডিকেল কলেজের ছাত্র মালিককে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়েছিল। সেই সঙ্গে আরও কয়েকজনকে, যারা সক্রিয় রাজনীতিতে কখনাে যােগ দেয়নি। তাদের সাক্ষ্য অগ্রাহ্য করার পক্ষে যুক্তি নেই। 

নুরুল আমিন সরকারের রক্তমাখা নােংরা আস্তিন পরিষ্কার করতে গিয়ে এলিস সাহেব বিচারপতির পবিত্র আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন। ঘৃণা কুড়িয়েছিলেন পূর্ববঙ্গের দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর কাছ থেকে। তবে শাসকসেবার ভালাে ‘ইনাম’ পেয়েছিলেন নুরুল আমিন সরকারের কাছ থেকে। আর সেটাই বােধ হয় তার কাক্ষিত ছিল। যে জন্য শপথ-ভাঙা অপরাধ করতে এলিস সাহেবের বিবেকে বাধেনি। প্রসঙ্গত বলা দরকার, নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলি চালানাের মূল দায়দায়িত্ব শুধু অবাঙালি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরাইশি, অতিরিক্ত সিটি পুলিশ সুপার মাসুদ মাহমুদ বা চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদেরই ছিল না; ছিল বাঙালি এস.পি মাে. ইদরিস, ডিআইজি ওবায়দুল্লাহ ও তাঁর নিকট বাঙালি সহকর্মীদেরও এবং সর্বোপরি মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের। অবাঙালি পাকিস্তানি প্রশাসক ও রাজনীতিকদের মনােভাব সবাই জানি, কিন্তু বাঙালি মন্ত্রী বা প্রশাসকদের ওই  মনােভাবের ব্যাখ্যা কী? সম্ভবত ব্যক্তিস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ ও রক্ষণশীল চিন্তা এ ধরনের ন্যায়নীতি-বহির্ভূত কাজে তাদের প্ররােচিত করেছিল। সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বার্থপূরণের চিন্তা তাে ছিলই। তবে তাদের এ কর্মকাণ্ড আন্দোলনকে তুঙ্গে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল, এই যা। সেই সঙ্গে দেশব্যাপী সরকারবিরােধী মনােভাবের আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। যাকে বলে পাল্টা প্রাপ্তি। এ বাস্তবতা বুঝতে পারেনি নুরুল আমিন প্রশাসন।

 

সূত্র : ভাষা আন্দোলন – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!