You dont have javascript enabled! Please enable it!

পুলিশের গুলি ও ইতিহাসের ট্র্যাজেডি

একটা সাধারণ সত্য সবাই জানি, যেকোনাে আন্দোলন বা আদর্শগত লড়াই একবার শুরু হয়ে গেলে যােদ্ধাদের মনে আর ভয়ভীতি, দ্বিধা-সংশয় থাকে না। যেকোনাে মূল্যে গন্তব্যে পৌছানাে তখন একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে। একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে আমতলার সভা শেষে সরকারি বাধানিষেধ ভেঙে বেরিয়ে আসার পর ছাত্রছাত্রীদের মনে পেছন ফিরে তাকানাের মতাে চিন্তা ঠাই পায়নি। তখন তাদের একমাত্র লক্ষ্য লড়াইয়ে জেতা, যা ছিল নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ। লড়াই। | আর সে উদ্দেশ্য নিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুর থেকে ছাত্রদের ব্যারাক প্রাঙ্গণে উপস্থিতি। বেলা গড়াতে শুরু করলে অছাত্র অনেককেই জমায়েত হতে দেখা যায়। যেমন—সচিবালয়ের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী, দোকান-রেস্তোরাঁর কর্মী এবং পথচারী মানুষজন। রাষ্ট্রভাষার দাবি তখন আর ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দাবি আদায়ের লড়াইটা হয়ে ওঠে ছাত্র-জনতা সবারই, ২২ ফেব্রুয়ারির গণআন্দোলনে যা পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। আইনসভার অধিবেশনে যােগ দিতে অনেক সদস্যই ব্যারাকের সামনের রাস্তা দিয়ে যাবেন, ছাত্রদের এমন ধারণা ভুল ছিল না। মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ছাত্র তাই সহজেই মানিকগঞ্জের এমএলএ আওলাদ হােসেনকে হােস্টেলে নিয়ে আসে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে প্রস্তাব তােলার শর্তে তিনি মুক্তি পান। ছাত্ররা মন্ত্রী হাসান আলীর গাড়িও আটক করে, কিন্তু পুলিশ তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। বিরােধীদলীয় সদস্য নেলী সেনগুপ্তা ছাত্রদের দাবি উপেক্ষা করে দ্রুত চলে যান।  এসব ঘটনার মধ্যেই সমবেত ছাত্র-জনতার চেষ্টা চলে হােস্টেল-সংলগ্ন পরিষদ ভবনের সামনের রাস্তায় পৌছানাের। কিন্তু লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসের আক্রমণে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। পুলিশের কঠিন বাধার মুখে ছাত্রদের একমাত্র পুঁজি বহু উচ্চারিত স্লোগান—“রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’ ইত্যাদি  এবং মেডিকেল ব্যারাকের কন্ট্রোল রুম থেকে আন্দোলনের পক্ষে প্রচার-প্রচার পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশে—প্রচার পথচারী মানুষকে আন্দোলনে টেনে আনতে। আন্দোলনের প্রচারকাজে সাহায্য করতে একুশে ফেব্রুয়ারি দুপুরে মেডিকেল কলেজ ইউনিয়নের উদ্যোগে ২০ নম্বর শেডের ১ নম্বর কক্ষে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। প্রচারকাজে ব্যবহার করা হয় কলেজ ইউনিয়নের নিজস্ব মাইক-স্পিকার। প্রচারের। সার্বক্ষণিক দায়িত্বে থাকেন মেডিকেলের কয়েকজন ছাত্র। মাত্র দুই দিনের আয়ু নিয়ে এই কন্ট্রোল রুম আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শক্তি হয়ে উঠেছিল।

গুলিতে ছাত্র-অছাত্র হত্যার খবর এখানকার প্রচারের কল্যাণেই মুখে মুখে গােটা শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল, এমনকি পৌছেছিল পরিষদ ভবনে। ছাত্রদের এ রকম তৎপরতা যদি লড়াই হয়ে থাকে তাহলে বলতে হয়, নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা বনাম সশস্ত্র পুলিশের ওই লড়াই তখন ঘণ্টা দুই-তিন স্থায়ী হয়েছিল। ছাত্র-জনতার অবস্থান তখন হােস্টেল প্রাঙ্গণে, কলেজ গেটের সামনে, খেলার মাঠসংলগ্ন রাস্তার তেমাথায়। ফুলার রােডে দাঁড়ানাে হােটেল-রেস্তোরা ‘মেকো’, ‘পপুলার’, নাজমা’র বয়-বেয়ারা থেকে হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় এবং আশপাশের সাধারণ মানুষের উপস্থিতি প্রতিবাদী জনতার আয়তন বাড়িয়ে তােলে। তাদের মুখেও ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ও পুলিশি জুলুমের বিরুদ্ধে স্লোগান। এ অবস্থায় পরিস্থিতি বিচার করে নিরপেক্ষ প্রত্যক্ষদর্শীও স্বীকার করবেন যে ছাত্রদের কার্যক্রম বা তৎপরতা পুলিশের নিরাপত্তায় কোনাে হুমকি সৃষ্টি করেনি। এককথায়, গুলি চালানাের মতাে কোনাে পরিস্থিতি তখন দেখা দেয়নি। তাই এতকাল পরও আজ ভাবতে অবাক লাগে যে নিরস্ত্র ছাত্রদের রাস্তায় বেরিয়ে আসা। ঠেকাতে কেন পুলিশ গুলি ছুড়েছিল! ছাত্ররা তাে সামনের রাস্তায় পুলিশের ব্যারিকেডও অতিক্রম করতে পারেনি। তাই সেদিনের প্রশ্ন আজও আমাদের ভাবায় : পুলিশের ওই চরম ব্যবস্থা গ্রহণের আদৌ কোনাে প্রয়ােজন ছিল কি না। | হােস্টেল প্রাঙ্গণে সমবেত ছাত্রদের কেউ ভাবতে পারেনি, বিরাজমান পরিস্থিতিতে পুলিশ গুলি চালাতে পারে। সে জন্যই টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটার আওয়াজ শুনতে শুনতে গুলির আওয়াজে জনা কয়েক ছাত্র চেঁচিয়ে ওঠে, ফাকা আওয়াজ, ফাঁকা আওয়াজ।’ কিন্তু ওগুলাে যে ফাকা আওয়াজ নয়, তা বােঝা গেল কয়েকজনকে গুলির আঘাতে পড়ে যেতে দেখে। বিশেষ করে, ১৪ নম্বর ব্যারাকের সামনে মাথায় গুলি লাগা ছাত্রটিকে দেখে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গুলি চলে। বিকেল তিনটা ২০ মিনিটে, গুলি ২৭ রাউন্ড।

তখন পরিষদ ভবনে আইনসভার অধিবেশন শুরু হয়েছে।পুলিশ বাহিনী শুধু হােস্টেল প্রাঙ্গণেই গুলি চালায়নি, গুলি ছুড়েছে রাস্তার মােড়ে দাঁড়ানাে ছাত্র-জনতার ওপরও। সেখানেও হতাহতের ঘটনা লক্ষ করার মতাে। যেমন রাস্তার এক কোণে পয়ােনিষ্কাশন পাম্পের পাশে উপস্থিত একজন, তেমনি  চৌধুরী পেট্রলপাম্পের পাশে এক কিশােরও গুলিবিদ্ধ হয়, যাকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায় বলে দৈনিক আজাদ-এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, পুলিশ আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালায়। কিন্তু পরিস্থিতি বলে, হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে পুলিশ গুলিবর্ষণ করেছিল; নিশ্চিতই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। আর ওই কর্তৃপক্ষের মধ্যে যেমন অবাঙালি, তেমনি বাঙালিও ছিলেন। দায় তাদের সবারই । সবচেয়ে বড় কথা, পুলিশ সেদিন ছাত্রপক্ষের প্ররােচনা ছাড়া এবং কোনাে ধরনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ না করেই নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল; ভয় দেখিয়ে ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নয়। স্বৈরাচারী শাসকশ্রেণী বরাবর এমনটাই করে থাকে। আর এটাই তাদের জন্য হয়ে ওঠে ইতিহাসের ট্র্যাজেডি।

সূত্র : ভাষা আন্দোলন – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!