You dont have javascript enabled! Please enable it!

আমতলা থেকে মেডিকেল ব্যারাকে

একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) সকালটা ছাত্রদের জন্য ছিল টান টান উত্তেজনায় অস্থির। রাতভর উত্তেজনার উত্তাপ ঠান্ডা সকালেও শেষ হয়নি। ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহেও শীতটা সে বছর বেশ জেঁকে বসেছিল। রােদ উঠতে না উঠতে স্কুলকলেজের ছাত্রদের আনাগােনায় ছাত্র এলাকা সরব হয়ে ওঠে। যেমন মেডিকেল কলেজ ব্যারাক, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। অর্থাৎ তখনকার আর্টস বিল্ডিং, এখন। যা মেডিকেল কলেজ ইমার্জেন্সি। | গেটের কাছাকাছি গােলগাল বড়সড় আমগাছ, তার উত্তর-পশ্চিম দিকে মধুর ক্যান্টিন। পূর্ব দিকে বেলতলায় ছােট্ট পুকুর-বড় ডােবা বললেও চলে। দক্ষিণপশ্চিমে বঙ্গভঙ্গ আমলের দালান—আর্টস বিল্ডিং, লাগােয়া পাঁচিল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। সর্বদক্ষিণে রেললাইন। এ ভূগােলেই সেদিন ছাত্রদের উত্তেজিত পদচারণে আমতলার ছাত্রসভা ঐতিহাসিক চরিত্র অর্জন করেছিল। সকাল থেকেই স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আগ্রহী ছাত্রদের উপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ উত্তাপ ছড়াচ্ছিল। আলােচনা, তর্কবিতর্ক সবকিছুই ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা নিয়ে। সেই সঙ্গে চলেছে মধুর ক্যান্টিনে চা-পান। এর। মধ্যেই গেটের বাইরে রাস্তায় খাকি হাফপ্যান্ট পরা পুলিশ বাহিনীর সতর্ক অবস্থান। তাদের কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে অস্ত্র। পাশে দাড়ানাে জিপগাড়ি ও ট্রাক। অর্থাৎ তারা প্রস্তুত। প্রস্তুত যেকোনাে ধরনের পরিস্থিতি মােকাবিলার জন্য। | যত দূর মনে পড়ে, আমতলার ছাত্রসভা শুরু হয় বেলা প্রায় ১১টার দিকে। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজনীতিক শামসুল হক সাহেব আসেন তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বক্তব্য দিতে । তার পরনে কালাে শেরওয়ানি, মাথায় জিন্নাহ টুপি। ক্যান্টিনের পাশে দাড়িয়ে ছাত্রদের সঙ্গে তার অনানুষ্ঠানিক আলাপ। পাশে দাড়ানাে কাজী গােলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান, হেদায়েত হােসেন চৌধুরী প্রমুখ ছাত্রনেতা তার আপস ফর্মুলার প্রতি সমর্থন জানাচ্ছিলেন। 

সভার শুরুতে প্রথম বক্তা শামসুল হক। ১৪৪ ধারা অমান্য না করার রাজনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থিত ছাত্রদের উচ্চকণ্ঠ। প্রতিবাদে মাঝপথে থেমে যায়। তার বক্তব্য সেদিন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি। এরপর ছাত্র-যুবনেতাদের দু-একজনের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিনের মূল প্রস্তাব : এ মুহূর্তে ১৪৪ ধারা ভেঙে নির্ধারিত কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে না গেলে আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়বে, ভাষার দাবি কোনাে দিনই অর্জিত হবে না।’ উপস্থিত ছাত্রদের সমর্থনে এমন সিদ্ধান্তই বহাল থাকে। ঠিক হয়, ১০ জনের ছােট ছােট মিছিল নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় বেরিয়ে যাবে। লক্ষ্য অ্যাসেম্বলি হল । আপাত গন্তব্য কাছাকাছি অবস্থিত মেডিকেল ব্যারাক প্রাঙ্গণ। সভায় আবদুস সামাদসহ দু-একজন ছাত্রনেতা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। সভাপতি গাজীউল হকের সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় উল্লিখিত সিদ্ধান্ত ঘােষণার মধ্য দিয়ে সভা শেষ হয়। কিছুক্ষণ ধরে বিরতিহীন স্লোগান ওঠে : রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’, ‘চলাে, চলাে, অ্যাসেম্বলি চলাে’ ইত্যাদি। সভা শেষ হতে না হতে কিছুটা বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে যখন ১০ জন করে ছাত্রছাত্রীর মিছিল গেট দিয়ে বের হতে চেষ্টা করছে, পুলিশি জুলুম তখন আরও জোরেশােরে শুরু হয়ে যায়। জুলুম গােটা প্রাঙ্গণে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছােড়া, রাস্তায় ছাত্রছাত্রীদের ওপর লাঠিচার্জ এবং বেশ কিছু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে পিকআপ ভ্যানে তােলার জবরদস্তিতে প্রকাশ পেয়েছিল।

তবে কাঁদানে গ্যাসের আক্রমণ এতটাই প্রবল ছিল যে আমতলাসংলগ্ন এলাকা ধুলাে ও ধােয়ায় একাকার হয়ে যায়। গ্যাসের জ্বালায় ছাত্রদের অনেকে বেলতলার পুকুরে রুমাল ভিজিয়ে চোখে চেপে ধরতে থাকে। অনেকে পেছনের রেললাইন ধরে, কেউ ভাঙা পাঁচিল ডিঙিয়ে ব্যারাক প্রাঙ্গণের। দিকে ছুটে যেতে থাকে। রাস্তায় পুলিশের লাঠি হামলায় আক্রান্ত ছাত্রদের কেউ কেউ কাঁটাতারের বেড়া। ডিঙিয়ে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় খেলার মাঠে ঢুকে পড়ে। তবে অধিকাংশই লাঠিতাড়নার মধ্য দিয়েই দ্রুত এগিয়ে চলে হাসপাতাল ও ব্যারাক প্রাঙ্গণের দিকে। সেদিন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে যারা ট্রাকে দাড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের পরিচিত মুখ এখনাে মনে পড়ে; যেমন—আবদুস সামাদ, হাবীবুর রহমান শেলী, আলী আজমল, আনােয়ারুল হক খান প্রমুখ ছাত্রনেতা। সেদিন আর্টস বিল্ডিং প্রাঙ্গণে নেতৃস্থানীয় যেসব ছাত্রী আমতলার সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য শাফিয়া খাতুন, রওশন আরা বাচ্চু, সুফিয়া ইব্রাহিম, শামসুন্নাহার প্রমুখ। তারা পুলিশের বাধা এড়িয়ে মেডিকেল হােস্টেলের দিকে যান। তাঁদের মধ্যে রওশন আরা পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন। তবে তাঁদের কাউকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি। পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছােড়ার অভিযােগ যেমন সত্য, তেমনি এ তথ্যও সঠিক যে পুলিশও ছাত্রদের ওপর পাল্টা ইটপাটকেল ছুড়েছে। আর বেপরােয়া লাঠিচার্জের পাশাপাশি একটু পরপরই কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়েছে এবং তা এতই যে ছাত্রদের পক্ষে আমতলা প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে।  শেষ পর্যন্ত পুলিশের বেপরােয়া আক্রমণ থেকে মাথা বাঁচিয়ে ছাত্রদের ব্যারাক প্রাঙ্গণে আশ্রয় নিতে দেখা যায়। তখন বেলা দুপুর । আমতলা থেকে ব্যারাক প্রাঙ্গণে পেীছে ছাত্রদের লক্ষ্য হয়ে ওঠে অ্যাসেম্বলি ভবন ঘেরাও এবং রাস্তা থেকে যথাসম্ভব এমএলএ কাউকে না কাউকে আটক করে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে প্রস্তাব তােলার প্রতিশ্রুতি আদায় । আইনসভার অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা বিকেল তিনটায়।

 

সূত্র : ভাষা আন্দোলন – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!