You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.05.26 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাঃ জনশক্তির অপচয় | পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সোভিয়েট ইউনিয়ন সফর | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৬শে মে, রোববার, ১২ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১

প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাঃ জনশক্তির অপচয়

বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সম্মেলনে কথাটি আবার উঠেছে। উঠেছে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সীমিত এবং বাস্তবতা ও পারিপার্শ্বিকতা থেকে এর বিচ্ছিন্ন অবস্থানের কথা। সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি স্বয়ং কথা গুলো তুলেছেন। তিনি বলেছেন, কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা স্বাভাবিক হলেও কার্যক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়নি। এর ফলে জনশক্তির অপচয় হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থাকে সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে সুসংহত ও উপযোগী করে গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক জটিল সমস্যা রয়েছে। তিনি বলেন, সামগ্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে জাতীয় জীবনের অনিবার্য প্রয়োজন মেটাতে সর্বস্তরে আধুনিক ও বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতি ত্বরান্বিত করা দরকার।
প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রীও ঠিক একই বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেছেন, শিক্ষাকে উৎপাদনমুখী ও শিক্ষিতদের গ্রামমুখী করার মাধ্যমে গ্রাম নির্ভর বাংলার স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে সফল করে তুলতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি আগামী দিনের শিক্ষানীতি কি ধরনের হবে সে সম্বন্ধে তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, পুঁথিগত বিদ্যা পরিহার ও ব্যবহারিক জ্ঞান বৃদ্ধি, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার প্রসারই হবে শিক্ষানীতির মূল মন্ত্র। শিক্ষিত ব্যক্তিদের শহরের চার দেয়ালের বাইরে গ্রাম পল্লীর ক্ষেতে-খামারে নিয়োগ, উৎপাদন বৃদ্ধিতে ব্যবহার এবং স্বনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ে তোলাই হবে দেশের শিক্ষার একমাত্র বৈশিষ্ট্য।
স্বাধীনতার পরবর্তীকাল থেকে দায়িত্বশীল মহলের এমনই উপলব্ধির সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়ে আসছি। আমরা নিজেরাও বিভিন্ন সময়ে গণমুখী এবং বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করেছি। উপনিবেশিক আমলে যে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল স্বাধীন দেশের প্রয়োজনের সঙ্গে তা সংগতিপূর্ণ হবে না এটাই স্বাভাবিক। এছাড়াও পূর্বতন সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গীকারাবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থার একটা গুণগত বৈপরীত্য রয়েছে। আধাসামন্তবাদী, আধাপুঁজিবাদী সামাজিক কাঠামোটাকে ভেঙে চুরমার করে আমরা সমাজবাদী কাঠামো গড়ে তোলার দুরূহ সংগ্রামে লিপ্ত। সে সংগ্রামের সাফল্য অর্জনের প্রাথমিক শর্তই হলো জনসাধারণকে সেই নয়া সামাজিক বিনয় সম্বন্ধে শিক্ষিত করে তোলা। এ প্রেক্ষিতেও যত শীঘ্র সম্ভব নয়া প্রগতিশীল শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে আমাদের সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে সেই প্রয়োজনে সারা দিয়ে একটা শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। প্রবীণ এবং প্রগতিশীল শিক্ষাবিদদের নিয়ে গঠিত এই কমিশন নয়া শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়ন করবেন। খবরে প্রকাশ, তারা নাকি সেই শিক্ষানীতি প্রণয়ন সমাপ্ত করেছেন। খুব শীঘ্রই তা সরকারের কাছে পেশ করা হবে। অন্তর্বর্তীকালীন জন্য একটা শিক্ষানীতি তৈরি করা হয়েছিল, বছরখানেক আগে। কিন্তু তা কার্যকরী হয়নি। আশা করা যাচ্ছে নতুন যে শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে তা আগামী শিক্ষা বছর থেকেই কার্যকরী হবে।
নয়া শিক্ষানীতি সমাজের প্রয়োজন মেটাতে সফল হবে বলে আমরা আশা করি। আশাকরি রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের প্রতিফলন তাতে থাকবে। থাকবে লাখো শহীদের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ আমাদের নয়া সমাজ গঠনের উপযোগী শিক্ষা প্রসারের ব্যবস্থা। রাষ্ট্রপতি কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নানাবিধ সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো সমাধানে আন্তরিকতা এবং বাস্তবতা নিয়ে এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। ইতিমধ্যে যে অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়া আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোকে বিষায়িত করে তুলেছে তার অবসানেও কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হওয়া উচিত। পাশাপাশি নজরে রাখতে হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর দিকে যারা শিক্ষার আলো গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। মনে রাখা দরকার রাষ্ট্রীয় কর্মতৎপরতায় যদি সেই নিরক্ষর জনসাধারণকে শিক্ষিত করে সঙ্গে নিয়ে চলার ব্যবস্থা নেয়া না হয় তবে বাঞ্ছিত ফল লাভ সম্ভব হবে না।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সোভিয়েট ইউনিয়ন সফর

সোভিয়েট পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ আঁদ্রে গ্ৰোমিকোর আমন্ত্রণক্রমে ছয়দিনব্যাপী সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর শেষে গত শুক্রবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছেন। বাসস প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান যে, তার সোভিয়েট ইউনিয়ন সফর অত্যন্ত ‘ফলপ্রসূ’ হয়েছে। এতে দু’দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা আরো বৃদ্ধি পাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশ-সোভিয়েট যুক্ত ইশতেহারের কথা উল্লেখ করেন। যুক্ত ইশতেহারে উভয় দেশের যৌথ উদ্যোগে শান্তি ও প্রগতির জোরদার করার বাসনাই ব্যক্ত হয়েছে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন গত ১৬ই মে নয়াদিল্লিতে শীর্ষ বৈঠক সমাপ্ত হবার পরই সোভিয়েট ইউনিয়ন সফরে যান। সোভিয়েট ইউনিয়নে অবস্থানকালে ডঃ কামাল হোসেন সোভিয়েট পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ আঁদ্রে গ্ৰোমিকোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
ডঃ কামাল হোসেনের ছয়দিনব্যাপী সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর শেষে গত বৃহস্পতিবার যুগপৎ ঢাকা থেকে যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয়।
যুক্ত ইস্তেহারে বাংলাদেশ ও সোভিয়েট ইউনিয়ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে বন্ধনকে আরো জোরদার করে তোলার উদ্দেশ্যে পরস্পরের কল্যাণজনক আহ্বান জানানো হয়েছে।
দু’দেশ ভারত মহাসাগরকে শান্তি এলাকায় পরিণত করার প্রশ্নটির একটি অনুকূল সমাধান খুঁজে বের করতে তাদের প্রস্তুতির কথা আবার উল্লেখ করেছে।
ইশতেহারে উভয়পক্ষ পুনরায় জোর দিয়ে উল্লেখ করে যে, বাংলাদেশ ও সোভিয়েট ইউনিয়ন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এবং সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনগণের সংগ্রামের সম্ভাব্য সব রকম সাহায্য ও সমর্থন দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দিয়ে যাবে।
উভয় পক্ষ সন্তোষের সঙ্গে লক্ষ্য করে যে, ১৯৭২ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধুর মস্কো সফরকালেও গত এপ্রিলে তার মস্কো অবস্থানকালে তার ও সোভিয়েট নেতাদের মধ্যে আলোচনার ফলে দু’দেশের বন্ধুদের উন্নয়ন ও বহুমুখী সহযোগিতার স্থাপিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালে ও পরবর্তী পর্যায়ে সহযোগিতা চুক্তি সমূহের বাস্তবায়নে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
উভয়পক্ষ দৃঢ় বিশ্বাস করেন যে, নয়াদিল্লিতে স্বাক্ষরিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তি উপমহাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণে এবং এতদ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অবদান স্বরূপ।
ইশতেহারে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ষষ্ঠ বিশেষ অধিবেশনে সিদ্ধান্তসমূহের প্রতি সমর্থন, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে মতবিনিময়, আরব ভূখন্ড থেকে ইসরাইলী সৈন্য প্রত্যাহার, প্যালেস্টাইনী জনগণের অধিকার সুনিশ্চিত করা, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় অবসান এবং সাধারন ও পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন আহ্বানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, মহান সোভিয়েট ইউনিয়ন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। বিপদে বন্ধুর পরিচয়। বিপদের দিনে সোভিয়েট ইউনিয়ন বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল এবং এখনও বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। হাত বাড়ালেই বন্ধুরূপে আমরা সোভিয়েট ইউনিয়নকে অতীতে পেয়েছি, আজও পাচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও পাবো। উল্লেখ্য যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সোভিয়েটের মূল্যবান সাহায্যে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তৎপরতা সম্পর্কে সোভিয়েট পক্ষকে অবহিত করেন।
পরিশেষে আমরাই কথাই বলবো যে, বাংলাদেশ ও সোভিয়েট ইউনিয়ন বন্ধুত্বের অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। এ বন্ধন একের প্রতি অন্যের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার বন্ধন। এ বন্ধন নিপীড়িত মানবতার, শান্তি ও প্রগতির স্বপক্ষে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সোভিয়েট ইউনিয়ন সফর শেষে যুক্ত ইশতেহারে সেই মনোভাব ও মানসিকতাই পুনরায় প্রতিফলিত হয়েছে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন