You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.04.20 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | জাতিসংঘ মহাসচিবের রিপোর্ট | সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড় | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২০শে এপ্রিল, রবিবার, ৭ই বৈশাখ, ১৩৮১

জাতিসংঘ মহাসচিবের রিপোর্ট

তেল ও অন্যান্য কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির ফলে তেল আমদানিকারক উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১৯৭০ সনে প্রায় ১ হাজার কোটি ডলার হতে ১৯৭৪ সনে ১২ শত কোটি ডলারে দাঁড়াবে। জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ডহেইম গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এক বিশেষ রিপোর্টে উপরি-উক্ত ভবিষ্যদ্বাণী করেন। রিপোর্টে আরও বলা হয় যে, তেল রপ্তানিকারী দেশগুলির রপ্তানি আয়ের ১৯৭০ সন অপেক্ষা প্রায় ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৮ শত কোটি ডলার হতে প্রায় ৭৮ শত কোটি ডলারে দাঁড়াবে। উন্নত দেশগুলির বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ১০ গুণ অর্থাৎ প্রায় ৮ শত কোটি হতে আজ সহস্রাধিক কোটিতে উন্নীত হবে। অবশ্য এই হিসাবকে ‘আনুমানিক’ হিসাব বলে উল্লেখ করা হয়।
মহাসচিব এর রিপোর্টটি ‘আনুমানিক’ হিসাব বলে চিহ্নিত করা হলেও এ কথা আজ দিবালোকের মত সত্য যে, গত বছরের অক্টোবর মাসে আরব-ইসরাইল সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে তৈল উৎপাদনকারী দেশগুলোর তেলের মূল্যবৃদ্ধির কথা ঘোষণা করেন। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর তেল কে অস্ত্ররূপে ব্যবহার করার জন্যই তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও বিশেষ বিশেষ দেশে তেল সরবরাহ না করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে বলার কিছু নেই। কেননা উন্নত দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে তেলকে সস্তা দরে কিনে চড়া দামে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা লুটছে। শুধু তাই নয় কোন কোন দেশ মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইলকে মদদ যুগিয়েছে প্রত্যক্ষভাবে। এহেন পরিস্থিতিতে থেকে পরিত্রান পাবার জন্যই তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেন।
তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে উন্নত দেশগুলোতে সংকট ও সমস্যা দেখা দিল বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো।
কথায় বলে বিপদ যখন আসে তখন একা আসে না। তেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে হু হু করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বিদেশ থেকে বিবিধ পণ্য, জ্বালানি ও খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। আমদানির ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোর অবস্থা তাই বর্তমানে দাঁড়িয়েছে নুন আনতে পান্তা ফুরাবার মতো।
জাতিসংঘের মহাসচিব উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থিক সংকটের চিত্র টি তুলে ধরার আগে ও বিশ্ব ব্যাংক গত সপ্তাহে সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, জরুরী ভিত্তিতে আর্থিক সাহায্য দেওয়া না হলে চলতি বছরে বহু উন্নয়নশীল দেশ আর্থিক সংকটে পড়বে। বিশ্বব্যাংকের একটি পর্যালোচনা এই হুঁশিয়ারি জ্ঞাপন করা হয় এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্বব্যাংকের পর্যালোচনাটি বিলি করা হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থিক সমস্যার সমাধান কল্পে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়েরী বুমেদীনের বিশেষ অনুরোধে কাঁচামালের ন্যায় সঙ্গত মূল্য প্রাপ্তির বিষয় নিয়ে জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছে। এই অধিবেশনে কাঁচামালের ন্যায় সঙ্গত মূল্যের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, উন্নত দেশগুলো সস্তা দরে কাঁচামাল আমদানি করে তাই আবার পণ্যের আকারে চড়া দামে রপ্তানি করছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। সুতরাং আজকের দিনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল কাঁচামালের ন্যায় সঙ্গত মূল্যপ্রাপ্তি।
মহাসচিব এর রিপোর্ট এর পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, উন্নয়নশীল দেশগুলো আর্থিক সংকটে নিমজ্জিত। বিশ্বব্যাংক এই সংকটের কথা উপলব্ধি করেই জরুরী ভিত্তিতে আর্থিক সাহায্যের কথা বলেছেন। আমরা আশা করবো, জাতিসংঘ এ সমস্যা ও সংকটের কথাটি বিচার-বিবেচনা করে দেখবেন। কেননা আজকের দুনিয়াতে একা বেঁচে থাকার কোন উপায় নেই একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল।

সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়

গত শনিবার ‘বাংলার বাণী’তে নীলফামারী মহাকুমার পাট চাষ সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত সংবাদপত্রে বলা হয়েছে, নীলফামারী মহকুমায় এবছর পাটের আবাদ শোচনীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। গত বছর এই মহকুমায় কয়েক হাজার একর জমিতে পাটের আবাদ করা হয়েছিল। সেখানে এ বছর মাত্র কয়েকশ একর জমিতে পাটের চাষ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ওখানকার কৃষকরা এখন বোরো ধানের চাষ করার কথা চিন্তা করছে এবং অনেকে জমিতে আউশ ধান বপন করেছে। তাছাড়া কিছুসংখ্যক চাষিরা জমিতে পাট চাষ না করে তা ফেলে রেখেছে।
পাটের আবাদ হ্রাস করা সম্পর্কে অনেক কৃষক জানিয়েছে যে, গত বছর তারা পাটের যে দর পেয়েছে তা দিয়ে তাদের বীজ ও সার ও অন্যান্য ব্যয় ওঠেনি। ফলে তারা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের সহজ বিচারে তাই এখন পাট চাষের চেয়ে ধান চাষই অধিক লাভজনক বলে মনে হচ্ছে।
উল্লেখিত প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে দেশের সমগ্র পাট পরিস্থিতির একথা রূপরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথম কথা হচ্ছে, পাট চাষিরা পাট বুনে লাভবানতো হচ্ছেই না উপরন্ত সব দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার উপর পাটের ধার্যকৃত সর্বনিম্ন মূল্য পাট ক্রয় কেন্দ্র গুলোর অবস্থা ও দুর্নীতির জন্য তাদের হাতে পৌঁছুচ্ছে না। হরহামেশাই অভিযোগ আসছে যে, নির্ধারিত হারের চেয়ে অনেক কম দামে সেখানে পাট ক্রয় করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ একই পাট উৎপাদনের বিনিময় যে মূল্য তাদের দেবার কথা তা ন্যায় সঙ্গত নয় বলেই পাট চাষিরা মনে করছে, তার ওপর পাট ক্রয় কেন্দ্র মধ্যস্বত্বভোগীদের কুট কারসাজিতে নির্ধারিত সর্বনিম্ন মূল্য তারা পাচ্ছে না। যার পরিণতি স্বরূপ পাট চাষীরা পাট চাষে বিমুখ হয়ে পড়েছে।
একথা অনস্বীকার্য যে, তাদের বক্তব্যের মধ্যে ও সততা আছে। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে সর্বনিম্ন একশো কুড়ি বা পঁচিশ টাকা মণের নিচে চাল বিক্রি হয়না। আর এক মণ ধান উৎপন্ন করতে যে পরিমাণ সময়, অর্থ, শ্রম ও যত্ন প্রয়োজন হয়, এক মণ পাট উৎপাদন করতে তুলনামূলকভাবে তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ, শ্রম ও যত্ন প্রয়োজন হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই ধানের বা চালের দামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাট চাষীরা পাট উৎপাদনের ন্যায্য পুরস্কার আশা করবে বৈ কি!
আমরা জানি বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল হলো পাট। একমাত্র এই পাট বেঁচেই আমরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করি। সেই অর্থ দিয়ে আবার দেশের জন্য নানাবিধ অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি কেনাকাটা করি এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নেই। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির বহুলাংশে এই পাট শিল্পের উপর নির্ভরশীল। সেজন্য পাটকে বলা হয় হয়ে থাকে সোনালী আঁশ এবং এই সোনালী আঁশের বিশ্ববাজারও খুব আশাব্যঞ্জক। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় বর্তমান বিশ্বে তেল সংকট ও তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলি এখন বাধ্য হয়েই সিনথেটিক ফাইবার উৎপাদন কম করে দিয়েছে। এই সময় আমরা পাটের উৎপাদন বাড়িয়ে আরো বেশি পরিমাণ পাট বিদেশে রপ্তানী করার সুযোগ গ্রহণ করতে পারি। এই তেল সংকট ও তেলের মূল্যবৃদ্ধি আমাদের ভবিষ্যতে আরো প্রসারিত করে দিয়েছে।
এই সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে তাই এখন পাট ও পাটজাত দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে আমাদের সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টাকে নিয়োজিত করা উচিত। স্মরণ করা যেতে পারে, বিগত কোরিয়ান যুদ্ধের কালে বাংলাদেশ শুধুমাত্র পাট বেচে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অভাবনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা প্রায় সেই ধরনের সুযোগ এখন আমাদের সামনে উন্মুক্ত হয়েছে। এই সময়ে পাটনীতি ঘোষণায় বিলম্ব বর্জন করে সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণের সুবিবেচনা রাখতে হবে। পাট উৎপাদন করে পাট চাষিরা যেন লাভবান হতে পারে এবং ক্রয় কেন্দ্র গুলোর সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের যেন তারা সহজ পন্থায় নির্ধারিত ন্যায্যদাম বুঝে পায় তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
গত ১৩ই মার্চ পাটমন্ত্রীর পাটের সর্বনিম্ন মূল্য মণপ্রতি ৬০ টাকা ধার্য এর ব্যাপারে বার্তা সংস্থার প্রতিনিধির সাথে আলাপ করেছিলেন এবং বলেছিলেন আগামী মে মাসে পাটের মূল্য ধার্য প্রস্তাবিত কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এই প্রসঙ্গে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, পাট চাষীদের ন্যায় সঙ্গত স্বার্থ রক্ষায় কার্যকরী ব্যবস্থা প্রণয়ন এর ব্যাপারে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা তৎপর রয়েছেন।
সামনেই মে মাস। কর্মসূচি ঘোষণা করার দিন। আমরা আশাবাদী তাই অনেক কিছুই আশা করছি। এই সঙ্গে কথা বলতে চাই-মনে রাখতে হবে যে জাতীয় অর্থনীতির মূল নিয়ামক গুলির মধ্যে পাটই বিশিষ্ট প্রধান সম্পদ। এই সময় কাজে লাগাবার সর্বাত্মক পরিকল্পনা তাই আজ আশু তাগাদার ভিত্তিতে গ্রহণ করতে না পারলে সে ক্ষতি প্রায় অপূর্ণই থেকে যাবে। কথায় বলে সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। আশা করি পাট মন্ত্রণালয় এ সম্পর্কে যথাসময়ে সচেতন হবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন