You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিস্ফোরক দিনটির জন্য দেশজুড়ে প্রস্তুতি

হাতে মাত্র দুই সপ্তাহের মতাে সময় । দেশজুড়ে দিনটি যথাযথভাবে পালন অর্থাৎ এর কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় ছিল না। কারণ, এত অল্প সময়ে এত বড় কাজের জন্য সাংগঠনিক শক্তির যথেষ্ট অভাব ছিল। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এমন শক্তি ছিল না সে অভাব মেটায়। ভাষার মতাে একটি সর্বজনীন বিষয়কে দলমত-নির্বিশেষে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে এবং জনমনে গ্রহণযােগ্য করে তুলতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। কিন্তু ওই পরিষদ তাদের দায়িত্ব পালনে পুরােপুরি সফল হয়নি। কারণ, এখানেও ছিল আগেকার মতােই মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব ও মতামতের ভিন্নতা। আর সে দ্বন্দ্ব ও ভিন্নতার টানাপােড়েন যে আন্দোলনে নেতিবাচক প্রভাব রেখেছিল, পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে তা বুঝতে পারা যাবে।  মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় পরিষদের বৈঠকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলােচনা করা হয়। যেমন—আন্দোলনের প্রয়ােজনে অর্থ সংগ্রহের জন্য ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পতাকা দিবস পালন। তবে সবচেয়ে জরুরি আলােচ্য বিষয় ছিল সম্ভাব্য ১৪৪ ধারা জারির পরিপ্রেক্ষিতে কর্মসূচি নির্ধারণ। অলি আহাদের মতে, সেদিন বৈঠকে উপস্থিত অধিকাংশ সদস্য আইন অমান্য করার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু অলি আহাদ ও বৈঠকের সভাপতি মওলানা ভাসানী অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার পক্ষে জোরেশােরে কথা বলেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনাে সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়। এ সময়কার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহরে একুশের কর্মসূচি। সফল করে তােলার উদ্দেশ্যে সভা, সমাবেশ, বক্তৃতা, ইশতেহার বিলি ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্লোগানসহ মিছিলের আয়ােজন। উদ্দেশ্য ছাত্র ও জনসাধারণের মধ্যে রাষ্ট্রভাষাবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি। আরেকটি লক্ষণীয় দিক হলাে, এই প্রথম ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরা অধিক সংখ্যায় সভা-সমাবেশে যােগ দেয়, বক্তৃতা করে এবং মিছিলে অংশ নেয়। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষজনকেও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অংশ নিতে দেখা যায়; তবে তা ব্যাপকভাবে নয়, সর্বত্র নয়। 

ভাষা আন্দোলনের সংগঠকেরা সংগত কারণে বন্দীমুক্তির বিষয়টি তাদের সাংগঠনিক প্রচারের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেন। যে জন্য রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানের পরই উচ্চারিত হতাে ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’। কারণ, মুসলিম লীগের অসহিষ্ণু অনাচারী শাসনে রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা অজুহাতে শুধু কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীরাই গ্রেপ্তার হননি, সরকারের সমালােচনার দায়ে অনেক বিরােধীদলীয় বা গণতান্ত্রিক সংগঠনের নেতা-কর্মীও গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘদিন ধরে বন্দী জীবন যাপন করছিলেন। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদের মতাে নেতাও কারাগারে আটক।  তাই ১৯ ফেব্রুয়ারি বন্দীমুক্তির দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্রসভা আহ্বান করা হয়। এতে বক্তৃতা করেন জিল্লুর রহমান, নাদেরা বেগম ও শামসুল হক চৌধুরী। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান, মহিউদ্দিন আহমদসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করা হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয় রাজবন্দী মুক্তি আন্দোলন কমিটি নামের একটি কমিটিও গঠন করা হয় (বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত গ্রন্থ, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ২৪১)। বায়ান্নর শেষ দিকে বন্দীমুক্তি কমিটি আরও গুরুত্ব অর্জন করে। জোরদার হয় সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল। সরকার বাধ্য হয় তেপ্পান্ন থেকে রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে, তবে ধীরেসুস্থে। পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ববঙ্গ সাংগঠনিক কমিটি ভাষাসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে এ সময় কয়েকটি ইশতেহার সার্কুলার প্রকাশ করে, তবে তা তাদের কর্মী, সদস্য ও সমর্থকদের জন্য। ১১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন’ শিরােনামের এমন। একটি সার্কুলারে নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতা এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি ও ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আলােচনা শেষে লেখা হয়, ‘১৯৪৮ সালের আন্দোলন হইতেও এবারের আন্দোলন অনেক বেশি শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে ।…

এই সময়ে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন সঠিকভাবে পরিচালিত হইলে পূর্ববঙ্গের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং বাঙ্গালী ও অন্যান্য জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের আন্দোলন। শক্তিশালী হইয়া আগাইয়া যাইবে।’ | সার্কুলারে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে আরও বলা হয়, বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা কর—এই দাবী বাঙ্গালী জাতির জাতীয় অধিকারের দাবি, এই দাবী বাঙ্গালী জাতির জন্মগত অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবী। অতএব রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন। বাঙ্গালী জাতির অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। কিন্তু। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কেবল বাঙ্গালী জাতিরই আন্দোলন নয়, রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন। পাকিস্তানের সকল ভাষাভাষি জাতি, যেমন—বাঙ্গালী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী, পাঠান, বেলুচ ইত্যাদি সকল জাতির ভাষা ও কৃষ্টিকে সমমর্যাদা দেওয়ার আন্দোলন’ (‘ভাষা আন্দোলনের দলিল সংকলন, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি)।। সবশেষে সদস্য, কর্মী ও সমর্থকদের করণীয় সম্পর্কে সার্কুলারে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সঠিক পথে পরিচালনার জন্য বিশেষ কয়েকটি স্লোগান বাধ্যতামূলকভাবে জনসাধারণের কাছে তুলে ধরার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেগুলাে হচ্ছে, পাকিস্তানের সকল ভাষার সমমর্যাদা চাই’, ‘পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষি জাতির নিজ নিজ ভাষায় শিক্ষা লাভ করা ও রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার চাই’ এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা চাই’।

এসব সার্কুলার প্রকাশ্যে বিতরণ করা হয়নি এবং সরাসরি জনসাধারণের গােচরে আসেনি সত্য, কিন্তু প্রচারিত বক্তব্য বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মূল কারিগরদের অধিকাংশের, অর্থাৎ পার্টি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চেতনায় উপস্থিত ছিল। | তারাই ছিলেন বায়ান্নর আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ও নেতৃস্থানীয় কর্মীদের মধ্যে। সংখ্যাগরিষ্ঠ । ভাষা আন্দোলনবিষয়ক এ-জাতীয় কয়েকটি সার্কুলার লেখকের সংগ্রহেও রয়েছে। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতিসত্তা অধ্যুষিত প্রাদেশিক ভাষাগুলােকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের সুপারিশ কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকেই প্রথম করা হয়। তবে উর্দুর ভাষিক বাস্তবতার কারণে এবং পশ্চিম পাকিস্তানবাসী মানুষ। অনেকেই কমবেশি উর্দু জবানে অভ্যস্ত বলেই কমিউনিস্ট পার্টি উর্দুর দাবি নাকচ করেনি, যদিও উর্দু পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে প্রদেশের জাতিসত্তার ভাষা নয়। উর্দু প্রকৃতপক্ষে দেশ বিভাগের কারণে ভারত থেকে পাকিস্তানে আসা মােহাজেরদের। ভাষা। তাদের অধিকাংশ বিহার, উত্তর প্রদেশ, হায়দরাবাদ, দিল্লি ইত্যাদি অঞ্চল থেকে পাকিস্তানে আসে এবং পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর প্রধান অংশ হয়ে ওঠে। | কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য এ ক্ষেত্রে তুলে ধরার কারণ পাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভাষা আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা ওই মূল বক্তব্য মাথায় রেখে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। এবং তাতে অংশ নিয়েছেন। সে জন্যই বাংলার দাবি এসেছে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে এবং উর্দুর বিরােধিতা না করে। এসব নেতা-কর্মীর মাধ্যমেই কমিউনিস্ট পার্টির ভাষাবিষয়ক মূল বক্তব্য ছাত্র-জনতার কাছে পৌঁছেছে।

এদের লক্ষ্য ছিল যথাসম্ভব শান্তিপূর্ণভাবে ভাষা আন্দোলনকে গণ-আন্দোলনে পরিণত করা এবং তাতে জনস্বার্থের কর্মসূচি যুক্ত করা। কিন্তু সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদে নানা মতের কারণে সুনির্দিষ্ট জনস্বার্থমূলক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আবদুল মতিনের মতে, তার এ ধরনের প্রস্তাব বারবার বাধার সম্মুখীন হয়েছে। এবং এ কথাও ঠিক যে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্লোগান নিয়ে আন্দোলন দীর্ঘসময় সচল রাখা সম্ভব ছিল না। একুশের ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্বে দেশজুড়ে নানা মতের মানুষ ভাষার। প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বড় একটি বিষয় ছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা নানা।  কর্মতৎপরতার মাধ্যমে স্থানীয় ছাত্র-যুবা ও জনসাধারণকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি আদায়ের আন্দোলনে যােগ দিতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। প্রধানত সভাসমাবেশ, হরতাল-মিছিলের মাধ্যমে প্রস্তুতিপর্বের কর্মতৎপরতা প্রকাশ পেয়েছে। শুধু জেলা শহরই নয়, মহকুমা শহর ছাড়াও ছােটখাটো শহরেও স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে একুশের প্রস্তুতিপর্বের কাজ চলেছে। এতে কেন্দ্রীয় সংগঠনের প্রভাব ছিল সামান্যই । ভাষার অধিকার অর্জনের আবেগই ছিল আন্দোলন শুরুর মূল চালিকাশক্তি। সে ক্ষেত্রে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের ভূমিকা ছিল গৌণ। 

সূত্র : ভাষা আন্দোলন – আহমদ রফিক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!