বিক্ষোভ থেকে আন্দোলন ১১ মার্চ
সাতচল্লিশের নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে যে ভাষা-বিক্ষোভের সূচনা, প্রয়ােজনীয় কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ তাতে যথেষ্ট শক্তিসঞ্চার করতে পারেনি, আন্দোলন গড়া তাে দূরের কথা। অবশ্য এর মধ্যেই ভাষার পক্ষে পথচলার। উপলক্ষ তৈরি হয়ে যায়। পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে ২৩ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে পরিষদে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে গ্রহণের জন্য সংশােধনী প্রস্তাব আনেন। কিন্তু গণপরিষদের বাঙালিঅবাঙালি মুসলিম লীগ সদস্যদের সমবেত বিরােধিতায় ২৫ ফেব্রুয়ারি ওই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। তাদের বিরােধিতার মূল কথা ছিল, ‘মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ও দেশের সংহতি রক্ষার জন্য পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি, এবং তা উর্দু।’ গণপরিষদের এ মনােভাবে ঢাকার ছাত্রসমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সব স্থবিরতা মুহূর্তে কেটে যায়। শুরু হয় বৈঠকের পর বৈঠক। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শিক্ষায়তনগুলােতে ধর্মঘট পালিত হয়। ওই দিন স্কুল-কলেজ, হল-হােস্টেল থেকে আসা ছাত্ররা আর্টস বিল্ডিং প্রাঙ্গণে জড়াে হয়। সেখানকার ছাত্রসভায় সরকারি ভাষানীতির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভা। শেষে যথারীতি মিছিল; স্লোগান ওঠে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ এরপর ২৮ ফেব্রুয়ারি এক বৈঠকে ১১ মার্চ দেশব্যাপী প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা দিবস হিসেবে স্থির করা হয়। বৈঠকের উদ্যোগ নেয় তমদুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। আন্দোলন সফল করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধারার। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা চলে। এবং ছাত্রাবাস ও বিভিন্ন মতের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদের নিয়ে ২ মার্চের বৈঠকে নতুন করে দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এবারও আহ্বায়ক হন তমদুন মজলিসেরই সদস্য শামসুল আলম। | ১১ মার্চের কর্মসূচি ঠিক করার জন্য এরপর দফায় দফায় সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক চলে। মার্চের ৪, ৫ ও ১০ তারিখে অনুষ্ঠিত আলােচনা বৈঠকে কর্মসূচির চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়। নবগঠিত সংগ্রাম পরিষদ এবার ব্যাপক ভিত্তিতে বহুদলীয় হওয়া সত্ত্বেও এর মধ্যে বিভিন্ন মতাদর্শের দ্বন্দ্ব ঠিকই উপস্থিত থাকে, যা আন্দোলনের পক্ষে দুর্বলতা হিসেবে গণ্য হওয়ার মতাে। পরবর্তী পর্যায়েও এমনটাই দেখা গেছে। তবে এ কথাও সত্য যে আন্দোলন গড়ে তােলার ক্ষেত্রে হল-হােস্টেলের রাজনীতি-সচেতন ছাত্রদের ভূমিকাই ছিল প্রধান এবং তারাই ছিল শক্তির উৎস। অবশ্য সংগ্রাম পরিষদে ছিল তমদুন মজলিসের প্রাধান্য।
নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ১১ মার্চ সচিবালয়ের বিভিন্ন গেটে এবং নীলক্ষেত ও পলাশী ব্যারাক, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ, রমনা পােস্ট অফিসসহ বিভিন্ন স্থানে পিকেটিং শুরু হয়। এ পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের অনেকে পুলিশের লাঠির আঘাতে ও সরকারের পােষা গুণ্ডাবাহিনীর আক্রমণে আহত হন, মহম্মদ তােয়াহাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। গ্রেপ্তার হন অনেকে। তবু আন্দোলন চলতে থাকে। এবং তা বিভিন্ন জেলায় ও কোনাে কোনাে শহরে এমন তীব্রতায় ছড়িয়ে যায় যে মুখ্যমন্ত্রী শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। অব্যাহত আন্দোলন ক্রমে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে ভেবে বিচলিত মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের কাছে আপসরফার ভিত্তিতে আন্দোলন বন্ধ করার প্রস্তাব পাঠান। অনেক দেনদরবার শেষে ১৫ মার্চ উভয় পক্ষের মধ্যে আট দফার শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই আট দফার মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সুপারিশ-প্রস্তাব গ্রহণের কথাও ছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের পর সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলন স্থগিত হওয়ার ঘােষণা দেয়। কিন্তু আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা ওই চুক্তি মেনে নিতে রাজি হয়নি। এমনকি ছাত্র-জনতাকে চুক্তির কথা জানাতে গিয়ে অধ্যাপক আবুল কাসেম ছাত্র-জনতার। বিক্ষোভের মুখে পড়েন। মহম্মদ তােয়াহা এ সময় ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করেন। ‘চুক্তি এখনাে চূড়ান্ত হয়নি’—এ কথা বলে তিনি তাদের শান্ত করেন। তাদের। দাবিতে পরদিন ১৬ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট অব্যাহত থাকে এবং ১৭ মার্চ শুধু শিক্ষায়তনে ধর্মঘট চলে (বদরুদ্দীন উমর, বশীর আল হেলাল, প্রাগুক্ত গ্রন্থ)। তবে শেষ পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করা হয়। ১১ মার্চের কর্মসূচি ঢাকার বাইরে রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, যশাের, খুলনা, দৌলতপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, ভৈরব, কুমিল্লা, নােয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে পালিত হয়। আন্দোলনের ব্যাপকতা ছাড়াও বিশেষ যে কারণে মুখ্যমন্ত্রী নিজ উদ্যোগে শান্তিচুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা হলাে পাকিস্তানের স্থপতি মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন পূর্ববঙ্গ সফর। রাষ্ট্রপ্রধানের সফরকালে অব্যাহত ছাত্র আন্দোলন মুখ্যমন্ত্রীর জন্য স্বস্তিদায়ক হতাে না। আবার কারও মতে, আন্দোলন বন্ধ করতেই তিনি তড়িঘড়ি করে রাষ্ট্রপ্রধানকে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করেন। কারণ যা-ই হােক, জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা সফর উপলক্ষে সংগ্রাম পরিষদকেও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। আন্দোলন স্থগিত করতে হয়।
বিস্ময়কর যে এমন এক নাজুক পরিস্থিতির শান্তিচুক্তিকে অধ্যাপক আবুল কাসেম আন্দোলনের ‘বিজয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যা আদতে বিজয় ছিল না; ছিল জোড়াতালির আপসরফা। আর ছাত্রদের চোখে ওই আপসরফা ছিল আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। তারা আন্দোলন স্থগিত করতে চায়নি। এমনকি মহম্মদ তােয়াহাও একপর্যায়ে আন্দোলন স্থগিত করার বিরুদ্ধে ছিলেন। কারণ, আন্দোলন একবার স্থগিত করলে পরিস্থিতিবিশেষে তা সচল করা কঠিন হয়ে। পড়ে। এ ক্ষেত্রে ঠিকই মার্চের অসম্পূর্ণ আন্দোলনের পর ভাষার দাবিতে একটি। সফল আন্দোলন পড়ে তুলতে বায়ান্নর ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ প্রায় চার বছর অপেক্ষা। করতে হয়। এর জন্য সংগ্রাম পরিষদের মূল নেতাদের অদূরদর্শিতা দায়ী। | ১১ মার্চের আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতার মূল্যায়ন করতে গেলে কিছু অপ্রিয় । সত্য বলতে হয়। সংগ্রাম পরিষদের যেসব নেতা আন্দোলন স্থগিত করা শান্তিচুক্তিতে ‘বিজয়’ দেখেছিলেন, তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্য বুঝতে পারেননি; অথবা বুঝেও জিন্নাহ সাহেবের সফরকে আন্দোলনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মনে। করেছিলেন। তাই যা ঘটার, তা-ই ঘটেছে। রাষ্ট্রপ্রধানের সফর নিরুপদ্রব হয়েছে। এবং সফর শেষে যেমন জিন্নাহ সাহেব, তেমনি মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনও সংগ্রাম। পরিষদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিনামা বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছেন। গণপরিষদে এরপর বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব এদেরই বিরােধিতায় বাতিল হয়ে গেছে। ঘটনা প্রমাণ করে, রাজনীতি-সচেতন জনতা ও বামপন্থী ছাত্ররা যা বুঝতে পেরেছিল, সংগ্রাম পরিষদের আপসবাদী নেতারা তা বুঝতে ভুল করেছিলেন। | প্রসঙ্গত, ১১ মার্চের আন্দোলনে সক্রিয় মূল সংগঠকদের সম্পর্কে বশীর আল হেলালের একটি মন্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচ্য। তার মতে, মার্চের এই আন্দোলনে। ফজলুল হক হল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও মেডিকেল কলেজের ছাত্র ও ছাত্রনেতারাই। বিশেষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তবে সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও শামসুল আলম ছাড়া সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের নেতৃস্থানীয় আর কোনাে ছাত্রের। উল্লেখযােগ্য ভূমিকা ছিল না’ (পৃ. ২২৮)। অন্যদিকে বদরুদ্দীন উমরের মতে, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, মুসলিম ছাত্রলীগ এবং সাধারণ ছাত্রসমাজই আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে’ (পৃ. ১২৬)। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ একুশের ভাষা আন্দোলনেও এই সাধারণ। ছাত্রসমাজই ছিল আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি। সঙ্গে ছিল যুবলীগ ও বামপন্থী ছাত্রকর্মী এবং তাদের নেতারা।
সূত্র : ভাষা আন্দোলন – আহমদ রফিক