You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৩রা অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ১৬ই আশ্বিন, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

নয়া শিল্প বিনিয়োগ তফসিল

১৬ই জুলাই ঘোষিত নয়া শিল্প বিনিয়োগ নীতির ভিত্তিতে আগামী দু’বছরের জন্য বেসরকারী বিনিয়োগের লক্ষ্য ধার্য্য করা হয়েছে সত্তর কোটি টাকা। এই সত্তর কোটি টাকার মধ্যে বত্রিশ কোটি এগারো লাখ টাকার প্রয়োজন হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। সরকারী শিল্প বিনিয়োগ তফসিলে নয়া শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে পঞ্চান্ন কোটি পঞ্চান্ন লাখ টাকা, আধুনিকীকরণ ও সংস্কারের জন্য এগারো কোটি পঁচানব্বই লাখ টাকা এবং দু’কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে অন্যান্য শিল্পখাতের জন্য।
নয়া শিল্প তফসিলে বেসরকারী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এগারোটি শিল্পগ্রুপে মোট একশ’ আটটি উপখাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এই অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে খাদ্য ও সংশ্লিষ্ট দ্রব্য, বস্ত্র, বনজ দ্রব্য ও সংশ্লিষ্ট শিল্প, কাগজবোর্ড, ট্যানারী চামড়া ও রাবার দ্রব্য, রাসায়নিক ঔষধ, কাঁচ, সিরামিক, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প প্রভৃতি।
স্বাধীনতাত্তোর কালে নয়া শিল্প যেমন আশানুরূপভাবে গড়ে উঠেনি তেমনি উৎপাদন ক্ষেত্রে আমাদের ভয়ানক মন্দার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়েছে। সরকার এ ব্যাপারে পূর্বাপর কোনো বলিষ্ঠ নীতি দিয়ে অগ্রসর হতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে আমদানীর উপর নির্ভরশীলতা এবং মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থোপার্জনের অবাধ এবং অপরিমিত সুযোগ থাকায় উৎপাদনে বিনিয়োগ করতে কেউ আগ্রহ প্রদর্শন করেনি। সরকারী সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি শিল্পলগ্নির ভবিষ্যত পরিণাম সম্পর্কেও অনিশ্চয়তার পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছিল।
রাতারাতি অবশ্য এটা দূর হবেনা। সরকারী নীতি সম্পর্কে এই মুহূর্তেই যে বিনিয়োগকারীরা সুস্পষ্ট এবং খোলাখুলি ধারণা নিতে সক্ষম হবে তাও জোর দিয়ে বলা যায় না। সবচাইতে বড় যে সমস্যা তা হলো বাণিজ্যের মাধ্যমে অবাধ এবং অপরিমিত মুনাফা অর্জনের পরিবেশ আগের মতো এখনো বিদ্যমান। শিল্প বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট অর্থ যাদের পকেটে রয়েছে তারা বাণিজ্যের মাধ্যমে অধিকতর এবং নগদ অর্থ আয়কেই শ্রেয় বলে মনে করছে।
দেশে উৎপাদনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা আবশ্যক। নীতিগতভাবে এই বক্তব্য আমরা বারবার পেশ করে আসছি। যে শিল্পগুলো রয়েছে তার উৎপাদন বৃদ্ধি যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন নয়া নয়া শিল্প গড়ে উঠা। এই নয়া শিল্প প্রতিষ্ঠায় এমন কোনো ব্যবস্থা অবশ্যই নেয়া চলবে না যা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে আঘাত করতে পারে। এ ব্যাপারে শিল্প তফসিলে বেসরকারী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আঠারোটি শিল্পের ব্যাপারে যে বাধা নিষেধ রাখা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।
নয়া শিল্প তফসিল ঘোষিত হয়েছে। এখন তা কার্যকরী করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রথমতঃ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মনে সৃষ্টি করতে হবে আস্থার ভাব। দ্বিতীয়তঃ দেশীয় উদ্যোক্তাদের অন্যবিধ উপায়ে অপরিমিত মুনাফার্জনের পথ বন্ধ করতে হবে। এ দু’টোই মূলতঃ উৎপাদনক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রাথমিক শর্ত হিসেবে আমরা মনে করি।

কলেরার ব্যাপকতা প্রতিরোধ

ঝড় থেমে গেলেও যেমনি ঝড়ের রেশ মুছে যায়না, তেমনি বানের জল নেমে যাওয়ার পরও সাধারণ মানুষ দুর্বিপাকের কবল থেকে একেবারে নিস্তার পায়নি। বন্যার তান্ডবলীলা মানুষের সহায় সম্পদ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, দেখা দিয়েছে দারুণ খাদ্যাভাব। মানুষ খাদ্যাভাবে কচু ঘেচু, শাক পাতা ইত্যাদি অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। দেশের বিভিন্নাঞ্চলে বন্যার পর কলেরা, উদরাময় ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এবং সুদূর গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে প্রতিদিন রোগব্যাধি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার খবর আসছে। বন্যাপ্লাবিত এলাকাগুলোতে বানের জল সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনো রকম কলেরা ভ্যাকসিন দেয়া না হওয়াতে কলেরার প্রাদুর্ভাব প্রকটতর হয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকার মানুষ কলেরার কবলে পড়ে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে।
জানা গেছে, মুক্তাগাছা থানার ৩ নম্বর তারাটি ইউনিয়নে কলেরায় প্রতিদিন গড়ে আট-দশ জনের মৃত্যু হচ্ছে। এই ইউনিয়নে এ পর্যন্ত কলেরাক্রান্ত হয়ে ষাট জনেরও বেশী মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার বন্যাকবলিত এলাকায়ও কলেরা এবং উদরাময় রোগের বিস্তৃতি ঘটেছে। মিরপুরের কলেরাক্রান্ত হয়ে মারা গেছে পাঁচজন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমায় মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে কলেরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একমাত্র কিনাইর গ্রামে মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচে দাঁড়িয়েছে এবং ধীরে ধীরে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে কলেরার জীবাণু। কলেরায় যশোরে মৃত্যু হয়েছে ছয়জনের। যশোরের কোতোয়ালী থানাধীন গ্রামগুলোতে কলেরার প্রাদুর্ভাব এতোই প্রকট যে, এখানে এই রোগ নিরোধের জন্য একটি মহামারী প্রতিরোধক দলকে প্রেরণ করা হয়েছে। বগুড়া জেলার বিভিন্ন স্থানেও কলেরা জাঁকিয়ে বসেছে। কলেরাক্রান্ত ৫২ জনের মধ্যে ২৩ জন ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছে। বগুড়া জেলার বিভিন্নাঞ্চলে কলেরা দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এলাকার পর এলাকায় কলেরারোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আক্রান্ত এলাকার মানুষ প্রয়োজনীয় ঔষধের জন্য হন্যে হয়ে হাসপাতালগুলোতে ধর্ণা দিচ্ছে। কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা জীবনরক্ষাকারী ঔষধ। গাইবান্ধা মহকুমায় একদিনেই মারা গেছে ২৪ জন। সেখানে কলেরা প্রতিষেধক ইনজেকশন, স্যালাইন এবং বিশুদ্ধ পানির দেখা দিয়েছে চরম সংকট।
দেশের বিভিন্নাঞ্চলে কলেরার প্রকোপ তীব্র আকার ধারণ করেছে। এবং মৃত্যুর বিভীষিকা করাল মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। একদিকে খাদ্যাভাব, অপরদিকে মহামারী। সারাদেশ জুড়ে চলছে মৃত্যুর কারবার। সাধারণ মানুষের এই চরম দুর্যোগের দিনে রোগমুক্তির জন্যেও পাওয়া যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় ঔষধ। কিন্তু তাই বলে তো মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যায় না। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জীবনে আশার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। কলেরা মহামারীর কবল থেকে সাধারণ মানুষকে করতে হবে মুক্ত। সময় থাকতে যদি কলেরা প্রতিষেধকের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাবলম্বন করা না যায়, তাহলে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। কলেরার জীবাণু একস্থান থেকে অন্যস্থানে ক্রমাগত ব্যপ্তি লাভ করবে। দেশব্যাপী কলেরার প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধ করতে হলে জরুরী ভিত্তিতে আক্রান্ত এলাকাগুলোতে স্যালাইন সরবরাহ করতে হবে এবং কলেরা প্রতিষেধকের জন্যে গ্রামে গ্রামে পাঠাতে হবে চিকিৎসক দল। ভ্যাকসিন, টিকা এবং পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ না করা হলে ভয়াবহ কলেরা অসংখ্য মানুষের জীবন-প্রদীপ নিভিয়ে দেবে। যে সব এলাকায় কলেরা ছড়িয়ে পড়েছে, সেই সব এলাকার স্বাস্থ্য বিভাগীয় কর্মীরা নাকি চরম উদাসীনতা প্রদর্শন করে চলেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিষেধক ব্যবস্থার অভাবে যদি মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে থাকে, তাহলে তা হবে খুবই মর্মান্তিক ব্যাপার।
আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কলেরা প্রতিরোধের জন্যে অবিলম্বে সর্বাত্মক ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন। ইতিমধ্যেই কলেরার ব্যাপকতা সারাদেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। অনাহারে মরছে মানুষ পথে-ঘাটে। তার উপর যদি কলেরার কবলে পড়ে মানুষকে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হয় তাহলে মানবতার সব চিহ্নই মুছে যাবে। তাই, কলেরা যাতে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, যাতে কোনো নতুন এলাকা কলেরা কবলিত না হয় এবং কলেরাক্রান্ত হয়ে কেউ যেন প্রয়োজনীয় ঔষধের অভাবে জীবন বলিদান না করে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সেদিকে সুতীক্ষ্ম নজর দিতে হবে। কলেরা প্রতিরোধের জন্য সক্রিয় ব্যবস্থাবলম্বন ত্বরান্বিত করা দরকার।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!