রাষ্ট্রভাষা বাংলা ইতিহাসের গােড়ার কথা
পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে, অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অধিকার আদায়ের জন্য যে লড়াই, তার সূচনা বিক্ষোভে, পরে সংগঠিত আন্দোলনে। ইতিহাসের যেমন ইতিহাস থাকে, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসেরও তেমনি রয়েছে পূর্বকথা, যা এক হিসাবে ইতিহাসেরই অংশ। সে পূর্বকথা অবশ্য প্রধানত রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে তাত্ত্বিক লেখালেখিতে সীমাবদ্ধ এবং তা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস আগে থেকে শুরু, চলেছে পরেও। এ প্রসঙ্গে আরেকটু পেছনে তাকানাে দরকার, জানা দরকার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পটভূমি। ইংরেজ শাসনে ভারতীয় উপমহাদেশে যে রাজনৈতিক টানাপােড়েন ও হানাহানি, তার পেছনে ছিল ইংরেজের সুচতুর শাসননীতি—’ভাগ কর এবং শাসন কর’ । অবশ্য সেই সঙ্গে আরও কারণ ভারতের দুই প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে অর্থনৈতিক অসমতা ও ধর্মীয় ভিন্নতা। রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতার লােভ ও স্বার্থপরতা ওই বৈষম্য ও ভিন্নতাকে তাদের প্রয়ােজনে ব্যবহার করেছিল। উদারতা ও সহিষ্ণুতা তাদের রাজনীতিতে ছিল না বললেই চলে। এর জন্য ভারতের তৎকালীন দুই প্রধান রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কমবেশি দায়ী। ওই বৈষম্যের ভিত্তিতে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য স্বতন্ত্র মুসলমান রাষ্ট্র গঠনের দাবি ওঠে। ১৯৪০ সালে ওই দাবির প্রকাশ ঘটে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহাের অধিবেশনে উত্থাপিত প্রস্তাবে, যা ইতিহাসে লাহাের প্রস্তাব’ নামে পরিচিত। প্রস্তাবে বলা হয়, ভারতের মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলে দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। অবশ্য এগুলােতে থাকবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা। লাহাের অধিবেশনে প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন বাংলার স্বনামখ্যাত নেতা এ কে ফজলুল হক।
প্রসঙ্গত বলা দরকার যে ভারতে বাঙালি মুসলমান ছিল শিক্ষায় ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে পেছনে। অবশ্য এ জন্য তাদের দায়ও কম ছিল না। কারণ যা-ই হােক, বাঙালি মুসলমান শ্রেণী-নির্বিশেষে লাহাের প্রস্তাবে তাদের ভবিষ্যৎ উন্নতির সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিল। তাই ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম লীগের বাক্সে একচেটিয়া ভােট দেয়। কিন্তু উত্তরপশ্চিমের মুসলমানপ্রধান প্রদেশগুলােতে মুসলিম লীগ একচেটিয়া বিজয় পায়নি। তাই বলা যায়, সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল ভূমিকা ছিল বাঙালি মুসলমানের। কিন্তু মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিল অবাঙালি মুসলমানের আধিপত্য-নবাব, জমিদার, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের উচ্চবিত্ত শ্রেণীই ছিল। সেখানে প্রধান। তারা বাঙালি মুসলমানের উল্লিখিত ভূমিকার দাম দিতে তৈরি ছিল বাঙালি মুসলমানের স্বাধীন স্বতন্ত্র ভূমির স্বপ্নে প্রথম আঘাত পড়ে, যখন ১৯৪৬। সালের এপ্রিল মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের সম্মেলনে দলীয় প্রধান মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ লাহাের প্রস্তাবকে বিকৃত করে দুই স্বাধীন রাষ্ট্রের বদলে এক পাকিস্তান প্রস্তাব পাস করিয়ে নেন। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সেক্রেটারি আবুল হাশিম একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সেই অযৌক্তিক কাজের প্রতিবাদ করেছিলেন। অন্যদিকে হসরত মােহানিসহ আরও দু-একজন প্রতিবাদীকে কথা বলতেই দেননি মুসলিম লীগের একনায়ক সভাপতি মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ । দ্বিতীয় আঘাত আসে। দেশ বিভাগের পরিপ্রেক্ষিতে আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসুর অখণ্ড তথা যুক্ত বাংলার প্রস্তাব নাকচ হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। | দেশ বিভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা যখন এক নিশ্চিত বাস্তবতা, তখন থেকেই মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ বলতে থাকেন, ‘পাকিস্তানের। রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।’ যেমন—১৭ মে (১৯৪৭) লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান এক বিবৃতিতে বলেন, “উর্দুই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে’ (দৈনিক আজাদ, ১৯ মে ১৯৪৭)। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে এ ধরনের বক্তৃতা-বিবৃতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে। ওঠেন কিছুসংখ্যক বাঙালি লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী। তাঁদের চোখে এমন দাবি। অসংগত ঠেকে। | লেখক-সাংবাদিক আবদুল হক দৈনিক ইত্তেহাদ-এ ‘বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব’ শীর্ষক প্রবন্ধ (দুই কিস্তিতে) লিখে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার যােগ্যতা তথ্য ও যুক্তির সাহায্যে তুলে ধরেন (ইত্তেহাদ, ২২ ও ২৯ জুন ১৯৪৭)। এরপর ৩০ জুন দৈনিক আজাদ-এ প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নামের প্রবন্ধে জনাব আবদুল হক একইভাবে বাংলার যােগ্যতা প্রতিপন্ন করে লেখেন : ‘যেদিক থেকেই বিবেচনা করা যাক না কেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবিই সবচেয়ে বেশি।’ রীতিমতাে সােজাসাপটা কথা।
সাপ্তাহিক মিল্লাত পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে (২৭ জুন ১৯৪৭) বলা হয়, মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোনাে ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে বরণ করার চাইতে বড় দাসত্ব আর কিছু থাকিতে পারে না।’ সম্পাদকীয় নিবন্ধটিতেও বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে যুক্তিতথ্য তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া আরও কয়েকজন সাংবাদিক দেশ বিভাগের আগেই বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সােচ্চার হন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক হানাহানি, রক্তপাত, নিরীহ মানুষের মৃত্যু এবং লীগ নেতাদের রাজনৈতিক মনােভাব বুঝতে পেরে পাকিস্তান আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট কিছুসংখ্যক উদারমনা, গণতন্ত্রী নেতা-কর্মী বিকল্প সম্ভাবনার কথা ভাবতে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তান আন্দোলনের মূল সংগঠন। মুসলিম লীগ ও তার অধিনায়ক মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ব্যক্তিত্ব ও জনপ্রিয়তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কোনাে সংগঠন তৈরি তখনকার পরিস্থিতিতে একেবারেই অসম্ভব। ছিল। কারণ, বাঙালি মুসলমান সে সময় স্বতন্ত্র ভুবন পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভাের, ‘জিন্নাহ’ নামের জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ। | তবু জুন সাতচল্লিশে কামরুদ্দীন আহমদ ঢাকায় এসে গণ আজাদী লীগ নামের যে রাজনৈতিক সংগঠন দাড় করান, তার মূল ভিত্তি ছিল ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব। অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং এর রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। তার কথা, পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, তা সেখানকার মানুষই ঠিক করবে। আর একান্তই যদি কেন্দ্র গঠিত হয়, তাহলে দুই দেশের রাষ্ট্রভাষাই কেন্দ্রের রাষ্ট্রভাষা হবে; যেমন—বেলজিয়াম, কানাডা, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি দেশে রয়েছে। কামরুদ্দীন আহমদের এ উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তােয়াহার মতাে জনা কয় বামপন্থী যুবক (কামরুদ্দীন আহমদ; বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, দ্বিতীয় খণ্ড)।
এটা ছিল মূলত রাজনৈতিক দিক থেকে সাংগঠনিক প্রয়াস, বাংলা রাষ্ট্রভাষার। বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই ওই প্রয়াসের সঙ্গে যুক্ত ছিল। একই সময় আতাউর রহমান, শহীদুল্লা কায়সার, আখলাকুর রহমান প্রমুখ প্রগতিবাদী রাজনৈতিক কর্মী। কলকাতায় বসেই পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক যুব সংগঠন গড়ে তােলার পরিকল্পনা করেন। তারা অবশ্য দেশ বিভাগের পর ঢাকায় এসে স্থানীয় গণতন্ত্রী, প্রগতিবাদী যুবক ও দু-একজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে আলাপআলােচনা করেন। যেমন—মহম্মদ তােয়াহা, নজমুল করিম, অলি আহাদ, তসন্দুক আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ সমমনা যুবনেতা। এ ছাড়া কামরুদ্দীন আহমদ তাে ছিলেনই। জুলাই থেকে চেষ্টা শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে অনেক সরকারি বাধাবিপত্তির মুখে যে কর্মী সম্মেলন হয়, তাতে গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামের সংগঠনের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হয়। সেখানে যুবকদের সামাজিক-রাজনৈতিকসাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ও উন্নতির ঘােষণার পাশাপাশি বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিও উচ্চারিত হয় (বদরুদ্দীন উমর : পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড)। বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক আবদুল হকের মতে, সে সময় খ্যাত-অখ্যাত অনেকে পত্রপত্রিকায় ভাষা সমস্যা নিয়ে আলােচনা করেছেন। অধিকাংশ লেখকই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সােচ্চার হয়েছেন।’ এভাবেই পাকিস্তানের জন্মলগ্নে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে কিছুসংখ্যক বাঙালি লেখকের সাহসী বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে; অনেকটা ইতিহাসের পূর্বকথার মতাে। এ ধারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরও অব্যাহত থেকেছে।
সূত্র : ভাষা আন্দোলন – আহমদ রফিক