You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাষার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু সাতচল্লিশেই - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু সাতচল্লিশেই

যে আবেগ ও স্বাপ্নিক মুগ্ধতা নিয়ে শ্রেণী-নির্বিশেষে বাঙালি মুসলমান চোখ বন্ধ করে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল তাতে সীমাবদ্ধ পরিসরে হলেও সেই বিশ্বাসে। চিড় ধরা বিস্ময়কর সন্দেহ নেই। ইতিহাসের ধারায় ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের অবসান এবং দেশীয় রাজনীতিকদের হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর। এর পূর্বশর্ত ছিল ভারত বিভাগ। সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে অসংখ্য। নিরপরাধ মানুষের রক্তে ভেজা পথে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র (ডােমিনিয়ন)। এ বিভাজনে শাসক ইংরেজের রাজনীতি ও কূটনীতির প্রভাব ছিল যথেষ্ট।  বিদেশি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভাষায়, ‘অদ্ভুত রাষ্ট্র’ পাকিস্তানের দুই অঞ্চল পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ছিল হাজার মাইলের ভৌগােলিক ব্যবধান। দুই অংশের মধ্যখানে ভিন্ন রাষ্ট্র ভারতের অবস্থান। দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্টিক পরিচয় ছিল পূর্ববঙ্গ’, পরে তার নাম হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান’। বলার অপেক্ষা রাখে না যে জাতিসত্তা ও ধর্মকে অযৌক্তিকভাবে একাকার করে। নিয়ে অর্জিত পাকিস্তানকে ঘিরে বাঙালি মুসলমান তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির স্বপ্ন দেখেছিল, এবং সেটা শ্রেণী-নির্বিশেষে সবাই।

আগেই বলা হয়েছে, স্বল্প পরিসরে হলেও সে স্বপ্নে ভাঙনের সূচনা পাকিস্তান। প্রতিষ্ঠার মাস কয়েক আগে থেকেই। এর কারণ অবাঙালিপ্রধান পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর একচেটিয়া ক্ষমতা ধরে রাখার বাসনা এবং সেই সঙ্গে বাঙালিদের প্রতি অযৌক্তিক বিরূপতা। সেই সঙ্গে ছিল বাংলা ও বাঙালির প্রতি রাজনৈতিকঅর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ। রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি পদক্ষেপে তারা বাঙালি-স্বার্থের প্রশ্নে অদূরদর্শিতা ও একদেশদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। তৈরি করেছে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য। পূর্ববঙ্গ ও বাঙালি হয়ে ওঠে সেই বৈষম্যের শিকার। এর প্রতিক্রিয়া ছিল স্বাভাবিক। পাকিস্তানি শাসকেরা প্রতিটি পদে, বিশেষ করে ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়ার কারণ ঘটিয়েছে। নয়া রাষ্ট্র। পাকিস্তানে সদ্য প্রকাশিত এনভেলাপ, পােস্টকার্ড, মনি অর্ডার ফরম, ডাকটিকিট, রেল টিকিট ইত্যাদিতে লেখা ছিল উর্দু ও ইংরেজিতে; বাংলা অনুপস্থিত। স্বভাবতই ঢাকার ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, এমনকি সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভ দেখা দেয়। সেই ক্ষোভের প্রথম প্রকাশ সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে, সঙ্গে রাজনীতি-সচেতন ছাত্রসমাজ। নীলক্ষেত ব্যারাকে বসবাসরত সরকারি কর্মচারীদের একটি বিশাল অংশ ব্যারাক প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে উল্লিখিত বৈষম্যমূলক সরকারি আচরণের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ জানায়। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিও এসে যায়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠিত এসব জমায়েত, সভা ও ছােটখাটো মিছিলের প্রতিবাদ সংঘটিত হয় ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে, অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার তিন মাসের মধ্যে। সবকিছুতে বাংলা। চাই, উর্দুর সঙ্গে বিরােধ নাই’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, উর্দু বাংলা ভাই ভাই’ ইত্যাদি স্লোগানের মধ্য দিয়ে ক্ষুব্ধ মানুষগুলাের প্রতিবাদ ও আশা-আকাক্ষার প্রকাশ ঘটে। উল্লেখ্য, এ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পেছনে কোনাে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগ বা চেষ্টা জড়িত ছিল না। |

রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সংগঠিত প্রতিবাদের প্রকাশও একই বছরের ডিসেম্বরের প্রথম দিকে। করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে (২৭ নভেম্বর ১৯৪৭) পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে গৃহীত সুপারিশ প্রস্তাব ঢাকায় ছাত্র-শিক্ষক ও সমাজের সচেতন অংশকে ক্ষুব্ধ করে তােলে। প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলাের। উদ্যোগ ছিল উল্লেখযােগ্য। সভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম এবং বক্তৃতা করেন মুনীর চৌধুরী, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এ কে এম আহসান প্রমুখ। | ছাত্রসভার মূল দাবি ছিল পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি। এবং পূর্ববঙ্গে সরকারি ভাষা ও শিক্ষার বাহনরূপে বাংলাকে যথাযথ মর্যাদা দান। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচারে ছাত্ররাই নয়, এ উপলক্ষে নীলক্ষেত ও পলাশী ব্যারাকের সরকারি কর্মচারীদের প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠান ও ছাত্রমিছিলে যােগদান নিঃসন্দেহে সাহসী ঘটনা। সভা শেষে বিশাল ছাত্রমিছিল সচিবালয়, মন্ত্রী ভবন এবং মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউস’-এর সামনে বিক্ষোভে সমবেত হয়। স্লোগান ওঠে : রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, উর্দুর জুলুম চলবে না’ ইত্যাদি। | ছাত্র-শিক্ষক ও সরকারি কর্মচারীদের রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সংগঠিত প্রতিবাদ-বিক্ষোভের তাৎপর্য বুঝতে পারেনি পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী। বরং স্থানীয় প্রশাসন পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দাদের মধ্যে অপপ্রচার চালিয়ে তাদের বাংলাবিরােধী করে তােলে। কিন্তু তাতে ছাত্রদের মনােবলে চিড় ধরেনি; বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও কলেজ ছাত্রাবাসগুলাে ঘিরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে। ছাত্রসমাজ ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে থাকে। 

রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিষয়ে ছাত্রসমাজ ও সংশ্লিষ্ট লােকজনের আবেগ ও সুস্পষ্ট প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পরও সরকারি নীতির কোনাে পরিবর্তন ঘটেনি; বরং থেকে থেকে শাসকগােষ্ঠীর তরফে নানা উপলক্ষে উচ্চারিত হয়েছে একই কথা : “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। ব্যক্তিজীবনে মাতৃভাষার প্রভাব যেমন তারা। বুঝতে চায়নি, তেমনি বুঝতে চায়নি ভাষিক জাতীয়তার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গুরুত্বের সঙ্গে রাষ্ট্রভাষার গভীর সম্পর্কের দিকটি। তাই তারা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু বাঙালি জনগােষ্ঠীর ভাষিক দাবির প্রতি চরম অবহেলা দেখিয়েছে। বহুভাষিক জাতিসত্তা অধ্যুষিত রাষ্ট্রে রাষ্ট্রভাষার সঙ্গে নির্দিষ্ট জাতিগােষ্ঠীর সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির গভীর সম্পর্ক থাকে। তাই বিজাতীয় উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হলে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ যে পিছিয়ে পড়বে, সে আশঙ্কা সচেতন বাঙালি শিক্ষিত সমাজের ছিল বলেই তাদের কারও কারও লেখায় এই বিশেষ দিকটি সুস্পষ্টভাবে উঠে আসে। তাদের আশঙ্কা যে ভুল ছিল না, সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণে তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। জাতীয় পর্যায়ে রাষ্ট্রভাষার তাত্ত্বিক ও বাস্তব দিক নিয়ে তাই যেমন বিভাগপূর্বকালে বাংলার পক্ষে প্রবন্ধাদি ও সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে, তেমনি লেখা হয়েছে। দেশ বিভাগের পর থেকে। যেমন—মাসিক কৃষ্টি পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায় (১৩৫৪) ড. মুহম্মদ এনামুল হক বাংলার পক্ষে লিখতে গিয়ে আক্ষেপ করে বলেন, “উর্দু। বাহিয়া আসিবে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মরণ—রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু।’ প্রায় একই রকম সাহসী ও বিচক্ষণ উক্তি ড, কাজী মােতাহার হােসেনের। সওগাত অগ্রহায়ণ সংখ্যায় (১৩৫৪) বাংলা বনাম উর্দু নিয়ে দীর্ঘ। আলােচনা শেষে তিনি এই বলে মতামত প্রকাশ করেন : বাংলা এবং উর্দু। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত।’ প্রবন্ধটি এর আগে তমদুন মজলিস প্রকাশিত পুস্তিকায় ছাপা হয়েছিল।

ওই পুস্তিকায় প্রকাশিত ছােট একটি নিবন্ধে আবুল মনসুর আহমদ লেখেন, “উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ ও সরকারি চাকুরীর ‘অযােগ্য’ বনিয়া যাইবেন।”  জাতীয় জীবনের এ বাস্তবতা সম্পর্কে বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণী ক্রমেই যে সচেতন। হয়ে উঠছিল, ঢাকা প্রকাশ এর একটি সংবাদ প্রতিবেদন থেকে তা বুঝতে পারা যায়। পত্রিকাটিতে (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭) বলা হয় যে পূর্ববঙ্গের সচিবালয়ে প্রায় সব কটি উচ্চপদে রয়েছেন অবাঙালি মুসলমান। এসব নিয়ে শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের মধ্যে যে অসন্তোষ, তা আরও প্রকাশ পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের একজন অবাঙালি লেকচারারকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সেক্রেটারি পদে নিয়ােগ দেওয়ার ঘটনায়। সাতচল্লিশ থেকে শুরু করে গােটা পাকিস্তানি আমলে অবাঙালি শাসকগােষ্ঠী বরাবরই বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে, বিশেষ করে   উচ্চ পদে বা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগের ক্ষেত্রে, সেনাবাহিনীতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে; যেমন কেন্দ্রে, তেমনি পূর্ববঙ্গেও উচ্চ প্রশাসনের ক্ষেত্রে। স্বভাবতই শিক্ষিত বাঙালির সরকারের প্রতি অসন্তোষ বেড়েছে, বেড়েছে সাতচল্লিশ-পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন। পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী যেমন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য অনড় অবস্থান নিয়েছিল, তেমনি বাংলা রাষ্ট্রভাষার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বাঙালি ছাত্রসমাজের একাংশও ছিল আপসহীন। বিচ্ছিন্নভাবে, সংগঠনগতভাবে রাষ্ট্রভাষার দাবি জোরালাে করে তােলার চেষ্টা চলেছে। সেই লক্ষ্যে ডিসেম্বরের শেষ দিকে (বশীর। আল হেলাল : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস) তমদুন মজলিসের অফিসে বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মী ও ছাত্র প্রতিনিধিদের বৈঠকে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, আহ্বায়ক মনােনীত হন মজলিসের নুরুল হক ভূইয়া। সদস্য আবুল কাসেম, মহম্মদ তােয়াহা, নঈমদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম, অলি আহাদ, আবুল খায়ের, শওকত আলী, ফরিদ আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল ওয়াহেদ। চৌধুরী প্রমুখ বিভিন্ন মতাদর্শের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।  

সূত্র : ভাষা আন্দোলন – আহমদ রফিক