You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৩ই আগস্ট, মঙ্গলবার, ২৭শে শ্রাবণ, ১৩৮১

মানবজাতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ

রেডক্রস লীগের সেক্রেটারি জেনারেলের বিশেষ প্রতিনিধি মিঃ ক্রুম হেনসেন বাংলাদেশের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সম্বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন যে, বাংলাদেশের বর্তমান বন্যা সারাবিশ্বের মানব জাতির পক্ষে একটি চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। মিঃ হেনসেন বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও ত্রাণ তৎপরতা তদারকির জন্য গত ১০ই জুলাই ঢাকা আগমন করেন।
রেডক্রস লীগের অন্যতম আর একজন প্রতিনিধি মিঃ জি, ষ্টিনল্যান্ড গত ৯ই জুলাই ঢাকায় এসে পৌঁছান। বন্যা পরিস্থিতিকে মিঃ ষ্টিনল্যান্ড ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, বিশ্ব সমাজের কাছ থেকে দ্রুত ও পর্যাপ্ত সরবরাহই বন্যা দুর্গতদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যাপারে বাঙ্গালীদের সুসংহত উদ্যোগকে জোরদার করতে পারে। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ও বাংলাদেশের বন্যা দুর্গত মানুষের জন্য জরুরী সাহায্যদানের আবেদন জানিয়েছেন।
বলাবাহুল্য অশ্রুতপূর্ব প্রায় বন্যার উন্নত দেশ আজ ভয়াবহ রূপে বিপন্ন। দেশের সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই আজ বন্যা ক্লিষ্ট। খাদ্য বস্ত্র ঠাঁই সব ভেসে গেছে প্লাবনে। কোটি কোটি টাকার খাদ্যশস্য ও মালপত্র সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়েছে। অগণিত বন্যাকবলিত লোকের আহাজারিতে দেশ আজও ভারাক্রান্ত। রাজধানীর নগর ও বন্যার ছোবলে আক্রান্ত। সর্বোপরি দেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি এই অবস্থায় এখন আমাদের ব্যাপক দেশি ও বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজন। এবং প্রায় দুই মাস কালের দীর্ঘ বন্যা গ্রস্থ দিনগুলোতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মানবতার ভিত্তিতে সাহায্যের জন্য বিশ্ব বিবেকের কাছে আবেদনও জানানো হয়েছে বারবার।
সারা যে একেবারে পাওয়া যায়নি তা নয়। দেশের বিভিন্ন মানবিক সংস্থা ফিনিশ রেডক্রস, জাপান ও বৃটেনের ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ অভিযান এবং আরো বহু সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আমরা পেয়েছি। আমেরিকার পক্ষ থেকে ২৫০০০ ডলারের একটি চেক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারী নানাবিধ প্রতিষ্ঠানে থেকেও নানাভাবে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। বহু স্বেচ্ছাসেবক এগিয়ে এসেছেন ত্রাণের কাজে। তবুও তা পর্যাপ্ত নয়। প্রয়োজনের তুলনায় বলতে গেলে কিছুই নয়। কোটি কোটি লোক আজ এক কণা খাদ্যের জন্য ধুঁকছে। একফোঁটা ওষুধের অভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বন্যা কবলিত অঞ্চলের মানুষ নানাবিধ সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ অমানুষিক শঙ্কা ও যন্ত্রণার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। মানবতার এত বড় দুর্দিনে তাই আজ বিশ্ব বিবেককে আরও সাহায্য ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
একথা অনস্বীকার্য যে, আজকের সভ্য জগতে কোন দেশই একক অস্তিত্বে বাঁচতে পারে না। পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমঝোতার মাধ্যমে সহঅবস্থান সহ সার্বিক সাহায্য ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। বিপদে-আপদে দিনে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও প্রীতির ভিত্তিতে দুর্গতদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। এই উপলব্ধির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার এবং বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।
বাংলাদেশের এই দুর্যোগ প্রাকৃতিক বিপর্যয় তাই আজকে দুনিয়ার মানবতাবাদীদের সামনে সত্যিই একটা চ্যালেঞ্জ। নিগৃহীত মানবতার সেবায় এবং তাদের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসন এর কাজে বিশ্বসমাজেকে মানবতার দক্ষিণের হাত আরো বহুগুণ প্রসারিত করতে হবে। ত্রাণ ও পুনর্বাসন এর কাজের বিবিধ ত্রাণ সামগ্রী সহ সকলের সাহায্য ও সহযোগিতার আশ্বাস রাখতে হবে। একথা সত্য যে, এত বড় দুর্যোগকে কাটিয়ে ওঠার সাধ্য আমাদের নেই। একটা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কেবলমাত্র চলতে শুরু করেছে। প্রতিবছরের বিপুল খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্যই এদেশকে তার অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অধিকাংশ ব্যয় করতে হয়। তার উপর প্রতিবছরের প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনিত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ধাক্কা এদেশের অর্থনীতির ওপর দুর্বহ চাপ সৃষ্টি করে। অতএব বিশ্ববিবেকের সহানুভূতিশীল দৃষ্টি এবং সহৃদয় সাহায্য ও সহযোগিতার মনোভাব আমাদের একান্ত কাম্য। অন্ততঃপক্ষে বর্তমান পরিস্থিতিকে মানবতার চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেও বিশ্বসমাজ আজ এগিয়ে না এলে কোটি কোটি দূর্গত ও বন্যা কবলিত মানুষকে বাঁচানোর আর কোন বিকল্প পথ বুঝি নেই। আমরা আশাবাদী। সীমাহীন জলরাশির হতাশায় নিমজ্জমান থেকেও বিশ্বসমাজের সুস্থ বিবেক ও মানবতাবোধের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখছি। মানবতার জয় অনিবার্য।

ইস্টার্ন রিফাইনারির লুকোচুরি খেলা

স্বাধীনতার পর থেকে চট্টগ্রামস্থ ইস্টার্ন রিফাইনারি নামক প্রতিষ্ঠানটিতে লুকোচুরির খেলা আরম্ভ হয়েছে। আকাশের বিদ্যুতের মতোই রিফাইনারি এই আছে তো এই নেই। আজ চালু হচ্ছে তো কাল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পর গত ৯ই জুলাই রিফাইনারীটি চালু হয়েছিল। এ সময় আবুধাবি থেকে কেনা দুই লাখ টন অপরিশোধিত তেলের প্রথম চালান পেয়ে উৎপাদন চালু হয়। কিন্তু তারপরেই আবার গত ২রা আগস্ট থেকে রিফাইনারি বন্ধ হয়ে যায়। সেই যে বন্ধ হলো আজও পর্যন্ত তার চালু হয়নি।
রিফাইনারি বন্ধ হয়ে যাবার কারন হিসেবে যে সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায় যে, আবুধাবি থেকে খরিদ করা দুই লক্ষ টন ক্রুড অয়েলের মধ্যে ইতিপূর্বে ৫৪ হাজার টন চট্টগ্রামে পৌঁছেছে এবং ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধিত হয়েছিল। গত পনেরোই জুলাই ৮৯ হাজার টন ক্রুড অয়েল নিয়ে একটি বৃহৎ ট্যাংকার কুতুবদিয়া পৌঁছুলে ২১শে ও ২২শে জুলাই ১৫ হাজার টন অয়েল খালাস করা হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে রিফাইনারি কর্তৃপক্ষ ও ট্যাঙ্কার কোম্পানি ও স্থানীয় এজেন্ট এর মধ্যে কোন বিষয় নিয়ে গন্ডগোল দেখা দিলে ক্রুড অয়েল খালাস বন্ধ রাখা হয়।
সংবাদে আরো প্রকাশ, ইষ্টার্ন রিফাইনারি কর্তৃপক্ষের অযোগ্যতা ও ইচ্ছাকৃত গরীমসির জন্য এই কোম্পানিরই অপর একটি ট্যাংকারের ভাড়া পরিশোধের ব্যাপারে অহেতুক বিলম্ব ঘটেছিল। এছাড়া আবুধাবি থেকে ক্রুড অয়েল আমদানির জন্য লেটার অব ক্রেডিট সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়েই ইস্টার্ন রিফাইনারি একটি ট্যাংকের ভাড়া করে ফলে উক্ত ট্যাংকার আবুধাবিতে কয়েক দিন অবস্থান করে ক্রুড অয়েল ছাড়াই বন্দর ত্যাগ করে। পরবর্তীকালে উক্ত ট্যাংকার কোম্পানি ইস্টার্ন রিফাইনারির নিকট ক্ষতিপূরণ দাবি করে। কাজে আলোচ্য ক্ষতিপূরণ পরিশোধ না করায় ট্যাংকার কোম্পানি ট্যাংকার থেকে মাল খালাসের ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে।
রিফাইনারি সংবাদ পর্যালোচনা করলে মোদ্দা ব্যাপারটা যা দাঁড়ায় তা হল পাটা-পুতার ঘষাঘষিতে মরিচের প্রাণ ওষ্ঠাগত হবার মতই একটা অবস্থা। রিফাইনারি কর্তৃপক্ষের ঢিলেমী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে অতীতেও রিফাইনারি বন্ধ হয়েছে। এবারও হলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো এভাবে চলবে কতদিন! এটা সর্বজনস্বীকৃত সত্য যে, আমাদের দেশের একশ্রেণীর মুনাফাখোর সমাজবিরোধী ব্যক্তিরা যেকোন একটা বাহানা খুঁজে বেড়ায় মুনাফা লুটবার জন্য। রিফাইনারি বন্ধ হলে সে সুযোগটা অনায়াসে পেয়েও যায়। ইস্টার্ন রিফাইনারি বন্ধ হয়ে গেছে এ সংবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বাজারে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। আগে যে কেরোসিন গেলন প্রতি ৭ টাকা বিক্রি হতো তাই বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা দরে। মূল্যবৃদ্ধি আরো হতে পারে। এমনিতে বন্যার পানিতে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। তন্মধ্যে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো পাওয়া যদি কেরোসিনও না যায় তাহলে যে অবস্থার সৃষ্টি হবে তা তো কল্পনাও করা যায় না। হেন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলবো এবারে মেহেরবাণী করে লুকোচুরি খেলা টা বন্ধ করা দরকার। দেশের বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতিতে বোধহয় তাই করা উচিত। আশাকরি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এদিকে একটু নজর দেবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!