You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২২শে নভেম্বর, শুক্রবার, ১৯৭৪, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

সেন্টোর সামরিক মহড়া

ভারত মহাসাগর আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সামরিক মহড়ার জন্য সেখানে সমাবেশ ঘটানো হয়েছে তুরস্ক, বৃটেন, পাকিস্তান, ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ও নৌ ইউনিটসমূহ। উদ্যোক্তা পাকিস্তান স্বয়ং। পঁয়ষট্টি সালের পর ‘সেন্টোর’ সামরিক মহড়ায় পাকিস্তানের এই প্রথম সক্রিয় অংশ গ্রহণ। উদ্দেশ্য সামরিক জোটের মনঃতুষ্টি সাধন করে কিছু সামরিক উপকরণ সংগ্রহ।
ক’বছর ধরে পাকিস্তান কিন্তু বাহ্যতঃ ‘সিয়াটো’ এবং ‘সেন্টো’ সামরিক জোটের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করে আসছিল। ‘ইসলামিক সমাজতন্ত্রী’ ভুট্টো কথায় কথায় পাশ্চাত্যের সামরিক জোটগুলো সম্বন্ধে বিষোদ্গার করতেন। কর্তার ইচ্ছেয় গীত গাওয়া হতো সেখানকার প্রচার মাধ্যমগুলোতেও সম্প্রতি জোটনিরপেক্ষ স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে রাখী বাঁধার ব্যাপারেও আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু কাজে আর কথায় কি অদ্ভূত বৈপরীত্য। সেই প্রধানমন্ত্রী এবং সেই পাকিস্তানই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সেন্টোর সামরিক মহড়া।
ভারত মহাসাগরকে ঘিরে একটা ষড়যন্ত্র বেশ কিছুকাল থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দিয়াগো গার্সিয়ায় নতুন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি নির্মাণের পাঁয়তারা এবং এই মহাসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক জোটগুলোকে সক্রিয় করে তোলার ব্যাপারে পাশ্চাত্য দেশসমূহের আগ্রহ সেই ষড়যন্ত্রের রূপকেই প্রকটতর করে তোলে। ইতিমধ্যে জাতিসংঘে ভারত মহাসাগরকে শান্তি এলাকা বলে ঘোষণা করার প্রস্তাবও পাশ হয়েছে। কিন্তু সেই প্রস্তাব বাস্তবায়ন তথা তার উপর শ্রদ্ধা দেখিয়ে ভারত মহাসাগরে কোনো প্রকার সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অনু্প্রবেশ বন্ধ করার ব্যাপারে কোনো কোনো দেশের আগ্রহের অভাব উদ্বেগজনক। কিছুদিন আগে মার্কিন নৌ-বহর এন্টারপ্রাইজের ভারত মহাসাগরে প্রবেশের খবর বেরিয়েছে। ‘সেন্টোর’ সামরিক মহড়া চলবে ত্রিশে নভেম্বর পর্যন্ত। উপমহাদেশের রাজনৈতিক অবস্থাও আগের চাইতে জটিলতর হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় ভারত মহাসাগরে সামরিক মহড়া অথবা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অনুপ্রবেশ স্বাভাবিকভাবেই এই এলাকার জনগণকে উদ্বিগ্ন না করে পারে না।
ইতিমধ্যে ভারতের পক্ষ থেকে তাদের মনোভাব জানানো হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং লোকসভায় বলেছেন, সেন্টোর সামরিক মহড়ায় পাকিস্তানের অংশ গ্রহণ পাক-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টাকে বিঘ্নিত করতে পারে। আসলে এটা পাকিস্তানী শাসক শ্রেণীর চরম হঠকারী মনোভাবকেই চাঙ্গা করে তুলতে সহায়তা করবে। যুদ্ধবাজ জেনারেলরা এতে উৎসাহী বোধ করবে। আর সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির কোনোরকম সুযোগ সেখানকার শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকেই করে তুলবে দুঃসহ।
এ ছাড়া এর প্রতিক্রিয়া প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের উপর যে পড়বেনা তা বলা যায়না। এতদাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং সৎপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে ইদানীং যে পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা হয়েছে পাকিস্তানের জঙ্গীবাদী মনোভাব তা অঙ্কুরেই বিনাশ করবে। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো পাকিস্তান বা ঐ রকম কোনো দেশের প্রশ্রয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি এবং ভারত মহাসাগরে একটা স্থায়ী ‘ষড়যন্ত্র ঘাঁটি’ গড়ে তোলার ব্যাপারে তারা অধিকতর উৎসাহী বোধ করবে। আমরা উপমহাদেশ এবং ভারত মহাসাগরীয় এলাকার অন্যান্য রাষ্ট্রের শান্তিপ্রিয় জনগণের পক্ষ থেকে মহাসাগরের জল উত্তপ্ত করবার যে কোনো প্রয়াসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করছি। উত্তেজনা সৃষ্টির সহায়ক এমন কোনো কর্মকান্ডে জড়িত হওয়া থেকে ভারত মহাসাগরীয় এলাকার দেশসমূহকে বিরত থাকার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।

আবার লঞ্চ ডুবি : আবার মৃত্যু

গত পরশু রাত্রে খুলনার পাইকগাছা যাওয়ার পথে প্রবল খরস্রোতা ও হাঙ্গরে পরিপূর্ণ শিবসার অদূরে আরেকটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবিতে অন্ততঃপক্ষে তিনশত যাত্রীর প্রাণহানি ঘটেছে। বারই থেকে বিশে নভেম্বর। মাত্র আট দিনের ব্যবধানে দেশের দু’অঞ্চলে লঞ্চ দুর্ঘটনায় অন্যূন পাঁচ শত লোক মর্মান্তিকবাবে মৃত্যুবরণ করেছে। খুলনার যাত্রীবাহী লঞ্চ ‘এম.এল.জয়নাব’-এর দুর্ঘটনার কারণ বিস্তারিত জানা যায়নি। শীতের শান্ত নদীবক্ষে যেখানে বিন্দুমাত্র ঝড়ো বাতাসের সম্ভাবনা নেই বা প্রবল ঢেউয়েরও কোনো প্রশ্ন উঠে না—লঞ্চ চলাচলের সম্পূর্ণ অনুকূল বর্তমানের এই শান্ত আবহাওয়ায় যাত্রীবাহী লঞ্চ দুর্ঘটনার পেছনে অন্য কোনো কারণই থাকতে পারে না। আট দিন আগে মুন্সীগঞ্জের কাছে যে কারণে ‘এম.এল.তিতাস’-এর সলিল সমাধি ঘটেছিল ‘জয়নাব’-এর ডুবে যাওয়ার কারণও ঐ একই অর্থাৎ মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী ও মালপত্র বোঝাই। সপ্তাহ খানেকের ব্যবধানে দুর্ঘটনা কবলিত এ দু’টি লঞ্চের যাত্রীদের ভাগ্যই শুধু মর্মান্তিক নয়, বাংলাদেশের নদীবক্ষে যাত্রীবাহী মোটর লঞ্চ চালু হওয়া থেকে এ যাবতকাল পর্যন্ত যতগুলো লঞ্চ দুর্ঘটনা হয়েছে এবং যতগুলো লোক প্রাণ হারিয়েছে তাদের শতকরা পঁচানব্বই জন যাত্রীর করুণ মৃত্যুর কারণ ঐ একই। স্বল্প পরিসরে মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বোঝাই।
এ কথা সকলেই জানেন যে, বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, ফরিদপুর, চাঁদপুর প্রভৃতি এলাকাগুলোর সাথে রাজধানীর প্রত্যক্ষ যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হলো জলপথ। স্টীমারের ভাড়া অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় লঞ্চের উপর চাপ পড়েছে ততোধিক। (অবশ্য লঞ্চের ভাড়া বৃদ্ধি হলেও বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই এদের যাতায়াতের জন্য)। তদুপরি এ অঞ্চলগুলোর আন্তঃপরিবহন ব্যবস্থা ছাড়াও নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ঢাকা, আরিচা ও জগন্নাথগঞ্জের সাথে দেশের উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার একমাত্র অবলম্বন হলো জলপথ। কিন্তু সমস্যা হলো, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী চাহিদার তুলনায় সে স্বল্পসংখ্যক লঞ্চ দেশের জলপথে যাতায়াত করতো, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার অনেকগুলোই বিনষ্ট হয়েছে এবং স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রসারের সাথে সাথে সেই জলযানের সংখ্যাল্পতাকে বৃদ্ধি করা হয়নি পুনর্বার। মালিক পক্ষের কাছে পয়সাটাই। বড় যেন তেন প্রকারে এবং যতবেশী পরিমাণে যাত্রী তারা লঞ্চে তুলতে পারবেন তাতে তাদের অধিক লাভ। এবং যেহেতু যাত্রীর তুলনায় লঞ্চের সংখ্যা স্বল্প প্রতিযোগিতার পরিবর্তে লঞ্চ চালানোর ব্যবসা আজ তাদের কাছে মনোপলিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সুতরাং অধিক যাত্রীবহন বা মাত্রাতিরিক্ত মাল বোঝাইতে যাত্রী সাধারণের অসুবিধা হলেও চলাচলের বিকল্প কোনো পন্থা না থাকায় জনসাধারণ এই লঞ্চেই আবার আশ্রয় গ্রহণ করবে লঞ্চ মালিকরা সেটা ভালো করেই জানেন। ভালো করেই জানেন তারা যে, দু’একটি লঞ্চ ডুবে গেলেও লোকসান পুষিয়ে নিতে এক মাসও সময় লাগবে না, তাই ব্যবসায়ে ‘মনোপলি’ও অস্বাভাবিক মুনাফার লোভে মানুষের জীবনের প্রতি থোড়াই কেয়ার করে এরা বেপরোয়া হয়ে গেছে।
অতীতে আমরা দেখেছি যখনই কোথাও কোনো যাত্রী বোঝাই লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে, মালিক পক্ষের তরফ হতে অর্থ প্রদান করে রাতের অন্ধকারে ডুবন্ত লঞ্চ থেকে লাশ সরিয়ে ফেলা হয় গুটি কয়েক মৃতদেহ প্রদর্শন করে লঞ্চ ডুবির ঘটনাকে হালকা করে তোলার জন্য। এ যাবতকাল ধরে তারা তাতে সফল হয়েছে—কেননা অধিক যাত্রী বহন বা মালামাল বোঝাই করার ব্যাপারে সেই পাক আমল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা কোনো সরকারই গ্রহণ করেননি। ‘তিতাসে’ যাত্রী ছিল সাড়ে চার শ’র মতো, লাশ পাওয়া গেছে সেই তুলনায় যৎসামান্য। ‘জয়নাবে’ যাত্রীর সংখ্যা পাঁচশ’ ছিল, কিন্তু লাশ পাওয়া যাবে হয়তো গুটি কয়েক। কারণ খরস্রোতা শিবসার বুকে ‘অধিকাংশ’ লাশই ভেসে যাবে এবং তাদের অনেকেই চলে যাবে নোনা পানির হাঙ্গরের পেটে। এক্ষেত্রে মালিক পক্ষের তরফ থেকে এবারেও ঘটনাটিকে হালকা করে দেখানো সহজ হবে। সরকারের কাছে আমরা অনুরোধ করছি লঞ্চে মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী ও মাল বোঝাই এর উপর কার্যকরী নিষেধাজ্ঞা প্রবর্তন করে বাংলার মানুষের নদীপথে চলাচলের ব্যাপারে সুষ্ঠু নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুন অবিলম্বে। কারণ কি ভয়াবহ বিপদজনক অবস্থায় অধিক যাত্রী ও মালে ঠাসাঠাসি হয়ে বাংলার নদীপথে লঞ্চগুলো চলাচল করে, খবরের কাগজের পাতায় হামেশাই তার নির্ভুল চিত্র বের হচ্ছে এবং তা দেখে এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা করাও আপনাদের পক্ষে অসুবিধা হবার কথা নয়। নদীপথে অস্বাভাবিক ও মর্মান্তিক মৃত্যুর হার একটুখানি মনোযোগ দিলে রোধ করা যে কোনো সময়ই সম্ভব।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!