বিদ্রোহ
বিপ্লবী গণবাহিনীর তাত্ত্বিক ধারণা ও কেন্দ্রে একটা সাংগঠনিক কাঠামাে। গড়ে উঠলেও আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে এর কোনাে সদস্য সংগ্রহের কার্যক্রম তখনাে শুরু হয়নি। দিনক্ষণ ঠিক করেও এর কোনাে পরিকল্পনা ও কার্যক্রম নেওয়া হয়নি। গণবাহিনী ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। কেউ কাউকে বলে দেয়নি, তুমি গণবাহিনীর সদস্য।’ ব্যাপারটা হয়ে উঠেছে। প্রথাগত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সংগ্রামের বাইরে গিয়ে অন্য কোনােভাবে কিছু কার্যক্রম নেওয়াটাকেই দেখা হতাে ‘বিপ্লবী কর্মকাণ্ড হিসেবে। আর যাদের বিরুদ্ধে এসব কার্যক্রম পরিচালিত হতাে, তাদের দৃষ্টিতে গণবাহিনী ছিল ‘অগণতান্ত্রিক ও বেআইনি’। নিখিল রঞ্জন সাহা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্নাতক। মেধাবী এই তরুণ সবেমাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্রকৌশল বিভাগে লেকচারার হিসেবে যােগ দিয়েছেন। উনসত্তর সাল থেকেই তিনি ছাত্রলীগের সিরাজপন্থীদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। চুয়াত্তরের ২৬ নভেম্বরের হরতালের প্রস্তুতি উপলক্ষে ঢাকা শহরে একটা শক্তির মহড়া দেওয়ার পরিকল্পনা হয়। নিখিল দায়িত্ব নেন বােমা বানানাের। নিখিল এর আগেও বােমা তৈরি করেছেন, পদ্ধতিটি ছিল খুবই স্কুল। পাতলা এক টুকরা মার্কিন কাপড় চিনি দিয়ে ভিজিয়ে এবং পরে শুকিয়ে মাড় দেওয়া কাপড়ের মতাে শক্ত করা হতাে। এর ভেতরে ধাতব স্পিন্টার ঢুকিয়ে দেওয়া হতাে। এর সঙ্গে মেশানাে হতাে পটাশিয়াম ক্লোরেট। পরে জিনিসটা একটা জ্যাকেটের মধ্যে পুরে দেওয়া হতাে। জ্যাকেটের মধ্যে কয়েকটা ফোকর রাখা হতাে। প্রতিটি ফোকরে অ্যাম্পুলের ভেতরে থাকত সালফিউরিক। অ্যাসিড। এটা ডেটোনেটরের কাজ করত। টাইম বােমা বানানাের জন্য। কনডম ব্যবহার করা হতাে। অ্যালগুলাে কনডমের ভেতরে রাখা হতাে। পরীক্ষা করে দেখা গেল, অ্যাম্পুল ফেটে গেলে অ্যাসিড একটা কনডম থেকে বেরিয়ে আসতে প্রায় দুই মিনিট সময় নেয়। যদি পরিকল্পনা থাকত বােমাটা চার মিনিট পরে ফাটানাে হবে, তাহলে দুটো কনডম ব্যবহার করা হতাে। জ্যাকেটের মুখে একটা সলতে দেওয়া হতাে। সলতের মধ্যে আগুন দিয়ে জ্যাকেটবন্দী বােমাটি ছুড়ে ফেলে দিলে বিস্ফোরণ হতাে। কনডম না থাকলে বিস্ফোরণ হতাে তাৎক্ষণিক।
চুয়াত্তরের ২৪ নভেম্বর রাতে যাত্রাবাড়ীতে গফুর মেম্বারের বাড়িতে নিখিল তার দুই সহযােগী গােলাম মােরশেদ নয়ন ও কাইয়ুমকে নিয়ে বােমা বানানাে শুরু করেন। বেশ কয়েকটি বােমা বানানাে হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ দুর্ঘটনা ঘটে। একটি বােমা ভুলক্রমে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। তারপর আরও কয়েকটি। কাইয়ুম ঘটনাস্থলেই মারা যান। নিখিল আহত হন। তার শরীরের বেশ কিছু অংশ ঝলসে যায়। নয়ন নিখিলকে কাঁধে নিয়ে প্রথমে পােপাস্তগােলা যান। সেখান থেকে একটা অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে নিখিলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ২৫ তারিখ ঢাকা নগর গণবাহিনীর সদস্য বাদল খান হাসপাতালে নিখিলকে দেখতে যান। নিখিল তাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “আমার ডায়েরিটা সম্ভবত পুলিশের হাতে পড়েছে। রাতে বাড়িতে থেকো না।’ ২৬ নভেম্বর হাসপাতালে নিখিলের মৃত্যু হয়। দলের মধ্যে কেউ কেউ সন্দেহ করেন, নিখিল বেঁচে থাকলে অনেক গােপন তথ্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে। তাই তাকে হাসপাতালেই মেরে ফেলা হয়। নিখিলের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার বিটঘর গ্রামে। পরিবারটি ছিল হতদরিদ্র। নিখিলের বাবা ছিলেন খেতমজুর। নিখিলের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবারটির স্বপ্নের মৃত্যু হলাে। | কাইয়ুম পলাশী কলােনিতে থাকতেন। রেডিওতে খবর শুনে তার মা। গফুর মেম্বারের বাড়ির কাছে যান। সেখানে তখন আরও মানুষ ভিড় করেছিল। কাইয়ুমের বাবা ছিলেন সরকারি কর্মচারী। তারা সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন। চাকরি এবং সরকারি বাসা নিয়ে ঝামেলা হতে পারে বলে কাইয়ুমের মা সন্তানের পরিচয় পর্যন্ত দেননি, তার লাশ নিয়ে আসার সাহস পাননি। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে কাইয়ুমকে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে দাফন করা হয়।