নিউ ইয়র্ক টাইমস, বৃহস্পতিবার, ১৯ আগস্ট, ১৯৭১
বাংলায় শেষ সমাধান
যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব সাহায্যের ছদ্মবেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করছে
-এলিস থর্নার
প্যারিস-আমরা কি বুঝতে পারছি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব বাংলায় একটি “চূড়ান্ত সমাধান” করার জন্য পাকিস্তানের উপর নিরব অথচ ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করছে?
১৫৬ জনের একটি আন্তর্জাতিক ত্রাণ ও পূনর্বাসন দল পূর্ব বাংলায় অবস্থান নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে নিক্সন প্রশাসন একটি প্রস্তাব দেয়। এই প্রস্তাবে পাকিস্তানের সম্মতি আমাদের কাছে একেবারেই বিস্ময়কর ছিল না। ইউএনএর দল পাঠানোর প্রকল্পটি মানবিক সাহায্যের ছদ্মবেশে পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলদের নড়বড়ে শাসন বাঁচানোর জন্য একটি প্রক্রিয়া।
আসুন আমরা ত্রান প্রস্তাবনার প্রকৃত চেহারার দিকে লক্ষ্য করি। যেখানে বলা হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী ‘খাদ্য সংকট এবং রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার আশংকা কমানোর জন্য পাকিস্তানি প্রশাসনকে সাহায্য’ করার জন্য নিয়োজিত দলের তত্ত্বাবধায়নে থাকবে। যে পাকিস্তানি প্রশাসন ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ দলকে সহযোগিতা করবে বলে আশা করা হচ্ছে, তারা কারা? সঠিকভাবে বলতে গেলে, জেনারেল টিক্কা খানের সামরিক (মার্শাল ল’) প্রশাসনের সেনাবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে মজুদ খাদ্য নষ্ট করেছে, বাজারে অগ্নিসংযোগ করেছে এবং চাষীদের গ্রাম থেকে বিতাড়িত করেছে যাতে করে ধানের বীজ বোনা হয়।
একই সামরিক নেতৃত্বের অধীনে থেকে একই সেনারা ইউনিসেফ এর জীপগাড়িগুলো নিজেদের কাজে এবং দীর্ঘ পরিসরে কলেরার মাঠসমীক্ষা ভন্ডুল করার উদ্দেশ্যে যেসব চিকিৎসক নৌকায় করে গ্রামবাসীদের দেখতে যেত, তাদের নৌকা ছিনিয়ে নেয়ার কাজে ব্যবহার করা হত।
একইভাবে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২৫শে মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত যে নীতি অনুসরণ করেছে তা যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয় ও ঘরবাড়ি্ পুনর্বাসনকারি জটিল করে তুলছে। সেনারা শুধু হাজার হাজার গ্রাম ও শহরের আবাসই ধ্বংস করেনি, বরং অনেক ক্ষেত্রে তারা অবাঙালি অথবা তাদের সহযোগীদেরকে হিন্দু, খ্রিস্টান, আওয়ামীলীগের মানুষের ঘরবাড়ি ও সম্পদ অধিকার করার জন্য এবং বুদ্ধিজীবীদের তাদের ঘর থেকে বিতাড়িত করার জন্য প্ররোচনা দিয়েছে। আর তাই যুক্তরাষ্ট্রের কারিগরী সহায়তার অপর লক্ষ্য হলো পশ্চিম পাকিস্তানি প্রশাসনের আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের উপর যত কাজের ভার ছিল তার মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুণর্গঠন, ৪০০০০ নৌযান ও ১০০০০ ট্রাকের প্রাদেশিক নিজস্ব বহর একত্র করাই ছিল প্রধানতম প্রকাশিত দায়িত্ব। এটা সত্যি যে বাঙ্গালি গেরিলারা পরিবহন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় লক্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছিল। তারা ভারতীয় সীমান্তের ওপাড়ের অভয়ারণ্য থেকে, তাদের ছোট্ট স্বাধীনকৃত ছিটমহল থেকে, এই বদ্বীপের বনজঙ্গলের নিরাপদ আবাস থেকে আক্রমণ করে রেলযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে, সেতু উড়িয়ে দিয়েছে, নৌযান ডুবিয়ে দিয়েছে, নদীপথ মাটি ফেলে ভরিয়ে দিয়েছে, জাহাজ মেরামত কারখানা ধ্বংস করেছে। কারন পরিবহন পূর্ব বাংলার সেনাবাহিনীর প্রাণশক্তি। যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের মাঝে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারে, শেষে গিয়ে তাদের বিতাড়িত করতে পারবে।
যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল ত্রাণ প্রকল্পের নামে কিছুটা হলেও যোগাযোগ মাধ্যম পুনঃরুদ্ধার করতে পারবে যাতে করে পূর্ব বাংলার উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত হয়।
যদিও প্রস্তাবিত পুনর্বাসন দলকে সতর্কভাবে ‘আন্তর্জাতিক’ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে আর্থিক সহায়তাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তবুও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা পরিস্কারভাবে বোঝা যায়। যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ব্যবস্থা করা ও ঢাকায় উড়িয়ে আনতে বিশেষজ্ঞ দলকে সাহায্য করার জন্য প্রাথমিকভাবে ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব করে। যখন মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা পাকিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক সম্মতি লাভ করে সাথেসাথেই রেডিও ও অন্যান্য সামগ্রী উড়োজাহাজে করে দ্রুত প্রেরণের জন্য তৈরি করা হয়। সংস্থাটির কয়েকশত কর্মী পূর্ব বাংলায় দায়িত্ব পালন করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অধীনে এই কাজে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্মীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না এই মর্মে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আমেরিকান পুর্ব বাংলা ছেড়ে চলে যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঋণদাতা দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদানের প্রায় অর্ধেক পাকিস্তানে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে তাদের প্রস্তাবে রাজি করাতে পেরেছিল। ১৯৫১ সাল থেকে পাকিস্তানে অজনপ্রিয় জান্তা সরকারের কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার জন্য বড় ধরনের আর্থিক ও সামরিক সাহায্য এই মতবাদকেই সমর্থন করে। যুক্তরাষ্ট্র এই প্রকল্প নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিল তা সাময়িকভাবে হয়ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেছিল। কিন্তু এই ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলায় প্রকৃত শৃঙ্খলা ফিরে আসার সম্ভাবনা পিছিয়ে গেছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত পূর্ব বাংলা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয়া না হয় এবং বাঙালী তাদের নিজেদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণকারী না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কোন সত্যিকারের ত্রাণ অ পুনর্বাসন কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয়।
(অ্যালিস থ্রোনার প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারত বিষয়ক প্রভাষক এবং তাঁর ভারত উপমহাদেশের উপর গবেষণাধর্মী অনেকগুলো লেখা আছে। তিনি ১৯৭১ সালের ১৯শে মার্চ ঢাকায় এসেছিলেন।)