বাংলার বাণী
ঢাকা: ২১শে জুন, বৃহস্পতিবার ৬ই আষাঢ়, ১৩৮০
দেশীয় কাঁচামাল এবং আমাদের শিল্প সম্ভাবনা
দেশ আমাদের শিল্পোন্নত নয়। এমন কি কোন পরিকল্পনা ও বিগত উপনিবেশিক আমলে গ্রহণ করা হয়নি। যা কিছু কাঁচামাল আমাদের দেশে উৎপন্ন হয় তাও বিদেশে রপ্তানী করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানকে শিল্পায়িত করার একটা প্রবণতা ঔপনিবেশিক শাসন সম্প্রদায়ের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। আমাদের প্রচুর পাট বিদেশের শিল্প কারখানার কাঁচামাল এর চাহিদা পূরণ করেছে। মুনাফা জমেছে বিদেশি পুঁজিপতিদের হাতে। চামড়া রফতানি করা হয়েছে কিন্তু কোন বাস্তব পরিকল্পনা গ্রহণ করে চামড়াজাত দ্রব্য উৎপাদনের সরকারি উৎসাহ প্রদান করা হয়নি। এছাড়া রয়েছে আমাদের দেশে প্রচুর সম্পদ আহরণ করার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এগুলো আহরণ করা হলে হয়তো তার উপর ভিত্তি করে শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
গত পরশু ফেনীর নতুন মুন্সিরহাট খাদি শিল্প সমিতির এক প্রতিনিধি দল গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলে বঙ্গবন্ধু তাদের দেশীয় কাঁচামাল এর উপর ভিত্তি করে শিল্প গড়ে তোলার ব্যাপারে তাঁর সরকারের সম্ভাব্য সকল সাহায্য এবং সহযোগিতার আশ্বাস দেন। প্রতিনিধিদল পার্বত্য চট্টগ্রামে উৎপাদিত তুলা থেকে প্রস্তুত খাদ্যের কিছু নমুনা বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেন। তারা আগামী শীত মৌসুমের পূর্বে এই দেশীয় তুলা দিয়ে এক লাখ খন্ড খাদ্য প্রস্তুত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ বস্ত্রা ভাব রয়েছে এই বস্ত্র শিল্পের দিক থেকে আমরা আমাদের চাহিদার তুলনায় অনেক পেছনে পড়ে রয়েছি। তাঁত শিল্প আমাদের চাহিদার যতোটুকু পূরণ করতেও কাঁচামালের অভাবে তাও আর সম্ভব হয়ে উঠছে না। সরকার তুলা আমদানি করেছিলেন আগামীতেও করবেন। উপনিবেশিক আমলে একসময়ের তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কোন কোন অঞ্চলে তুলা চাষ সম্ভব বলে জনৈক বিশেষজ্ঞ আশাবাদ পোষণ করেছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সম্ভবত আশা করা গিয়েছিল যে সরকার এদিককার দিকে দৃষ্টি দেবেন। কিন্তু নানা কারণে তা সম্ভব হয়নি। আশা করবো সরকার এখন বস্ত্র সংকট কাটিয়ে উঠবার জন্য এ দিকে বিশেষ নজর দেবেন। বাংলাদেশর ঔপনিবেশিক জালে আটকা পড়ে নেই। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আমাদের মুখ খোলা উচিত খাদ্য বস্ত্র সমূহ বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলা। রাতারাতি বড় বড় শিল্প গড়ে তোলার মতো হটকারী মানসিকতা অবশ্যই প্রশ্রয় পাবেনা। আর সে সংগতি ও আমাদের নেই। বিশেষ করে যে শিল্পের জন্য আমাদের বাইরের কাঁচামালের উপর নির্ভর করে থাকতে হবে সে শিল্প গড়ে তোলার ব্যাপারে যতগুলো সম্ভব সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। শিল্পের ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিতে হবে সেই সকল শিল্পকে যা আমাদের দেশীয় কাঁচামাল এর উপর নির্ভরশীল।
আমাদের দেশের শিল্প গড়ে ওঠেনি হতে পারিনি আমরা খাদ্যের দিক থেকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ। এমত অবস্থায় কাঁচামাল রপ্তানি করে এসে টাকায় খাদ্য আমদানির দেউলিয়া নীতি যাতে আমাদের পেন আবশেষে দিকে অবশ্যই সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। বলা হয়েছে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারব। এটা আসার কথা ভালো কথা। একইসঙ্গে যদি সরকার আমাদের অনাহারীত সম্পদ আছে তা আহরণ এবং দেশীয় কাঁচামাল সমূহের উপর ভিত্তি করে শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগী হন তবে তাদেরকে তার মূল লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সবচাইতে বেশি সহায়তা করবে। এ ব্যাপারে আমাদের বিশ্বাস বন্ধু রাষ্ট্রসমূহ আমাদের দিকে সাহায্য সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত করবেন।
বন্যার পদধ্বনি
আবার বন্যার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদ তিস্তা ধরলা দুধকুমার ফুলকুমার এবং এদের শাখা-প্রশাখা নদীগুলোর বন্যায় রংপুর জেলার ৩১টি থানার কমপক্ষে ১৬টি এবং কুশিয়ারা নদীর বন্যা সিলেটের সুনামগঞ্জ মহাকুমার দুটি থানার ৭টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশ।
রংপুর সদর ও কুড়িগ্রাম মহকুমার বিরাট এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে গত মঙ্গলবার গোহাটি থেকে পিটিআই জানিয়েছেন ব্রহ্মপুত্র নদ ও তার শাখা-প্রশাখা নদীগুলোর পানি মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে সিরাজগঞ্জের কাছে যমুনা নদীর পানিও বিপদসীমার মাত্র দুই ইঞ্চি নিচে দিয়ে বয়ে চলেছে।
গত ১৫-১৬ জুন উজানে ভারতের আসামে প্রবল বৃষ্টিপাতের দরুন সুনামগঞ্জ থানার পলাশ, লক্ষীপুরের গঙ্গার ধার এবং ছাতক থানার টেন্ডার ও ইসলামপুর এবং গোরাবাজার ইউনিয়ন কুশিয়ারার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিগত ২৫ বছরের পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের ফলে বাংলাদেশে বন্যা নামক মহা শত্রুর হাত থেকে রেহাই পায়নি। দেশের জনসাধারণের চোখে ধুলো দেবার জন্য বন্যানিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার নামে দিস্তা দিস্তা কাগজ নষ্ট হয়েছে হয়েছে প্রচুর অর্থের অপচয়। অথচ সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি শুধু তাই নয় উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপ বাবার জন্য ভারতকে দোষারোপ করা হয়েছে সুপরিকল্পিত ও সুচিন্তিতভাবে।
সুতরাং এমতাবস্থায় বন্যা সমস্যার মতো একটি বৃহৎ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান সহজ কথা নয়। এর জন্য সময়-সুযোগের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর নানা প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্বেও বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রতি নজর দিয়েছেন সরকার। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক হয়েছে। এছাড়াও দীর্ঘদিন অবহেলা ও অযত্নের ফলে বিভিন্ন নদীতে চলা পড়ে গেছে। ড্রেজার দিয়ে নদী খনন করা হয়নি আজ পর্যন্ত।
এমনই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বন্যার ছোবলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গ্রাম বাংলার মানুষ। ফসল বিন্যাস, মড়ক মহামারী ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি মহামারী তো রয়েছেই।
অকস্মাৎ বিভিন্ন নদীতে পানি বৃদ্ধিতে যে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে তা মোকাবেলা করার জন্য সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। বন্যার কবলে আক্রান্ত মানুষগুলো যেতে সময় মত সাহায্য পায় সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখা উচিত। খাদ্যদ্রব্য আর্থিক সাহায্য মহামারী রোধের জন্য টিকা ও ইনজেকশন পাঠানোর দিকে অবশ্যই গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। আর এ কাজটি করতে পারেন স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ। তারা যদি একটু সজাগ দৃষ্টি রাখেন, সময়মতো সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়ান তাহলে বন্যার কবলে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম বাংলার মানুষ গুলো অন্তত খানিকটা স্বস্তি ও সান্তনা পাবেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক