You dont have javascript enabled! Please enable it!

 

 

পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় বাহিনীর অভিযান শুরুর তেরাে দিন পর আজ ঢাকার কেন্দ্রস্থলে রেসকোর্স নামে পরিচিত ঘাসে ছাওয়া ময়দানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। ৭ মার্চ এই রেসকোর্স ময়দানেই সমবেত হাজার হাজার বাঙালিজনের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে শেখ মুজিব আহ্বান জানিয়েছিলেন সামরিক আইনের অবসান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের, স্বায়ত্তশাসনকামী যে দলটি নির্বাচনে অর্জন করেছিল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আজ আর কোনাে ভাষণছিল না—ঘাসের ওপর পাতা একটি টেবিলের সামনেবসেছিলেন কেবল দু’জন মানুষ—লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে.এস.অরােরা এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজি, পূর্ব পাকিস্তানে ৭০,০০০ পাকিস্তানি সৈন্যের কম্যান্ডার, যিনি স্বাক্ষর দিলেন পাকিস্তানি আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক দলিলপত্রে।  ভারতীয় অভিযানের শেষ প্রহরগুলাে, রেসকোর্সের আনুষ্ঠানিকতায় যার পরিণতি, কেটেছিল মেশিনগান ও ভারি কামানের পালানুক্রমিক অগ্নিউদ্‌গারণে যখন ঢাকার ঠিক বাইরে লক্ষ্যা নদীর পারে দুই দলের মধ্যে চলছিল লড়াই। | ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে ঢাকা প্রবেশ করতে পেরেছে মাত্র সাতজন পশ্চিমা সাংবাদিক এবং তাঁদের মধ্যে বর্তমান সংবাদদাতাও একজন। পাকিস্তানিদের দিকে তাক করে ভারতীয় বাহিনী যখন গােলা নিক্ষেপ করছিল তখন গ্রামবাসীরা দল বেঁধে চুপিসারে বসে তা দেখছিল। আজ সকালে ঢাকা থেকে নয় মাইল দূরে বরপা গ্রামের ধানের খেতে এমনি দৃশ্যের অবতারণা ঘটেছিল। এখানে ছয়টি ৭৫ মি.মি. মাউন্টেন গানের ব্যাটারি নদীর অপর পারে পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর গােলাবর্ষণ করছিল। প্রায় একশত গজ দূরে বসে শতাধিক লােক এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে গর্জমান কামানের গােলা নিক্ষেপ দেখছিল। অগ্রবর্তী পরিদর্শকের কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে কম্যান্ড পােষ্টের একজন অফিসার চিৎকার করে উঠলেন, “চমৎকার শুটিং হয়েছে। কিছু গাড়ির ওপর আমরা আঘাত হানতে পেরেছি।’ যুদ্ধবিরতি, তবে তখন সময় ছিল বেলা দশটা।

একটি যুদ্ধ-বিরতি কার্যকর হয়েছে তবে ভারতীয় অফিসাররা বলছেন সেটা কেবল ঢাকার ক্ষেত্রে প্রযােজ্য এবং তাদের বাহিনী ঢাকা পর্যন্ত। কামান দাগায় নি। ঢাকার কিছুটা আগের অবস্থান তাঁদের লক্ষ্য। তাছাড়া উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসরমান এই ব্রিগেডের কেউ পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ সম্পর্কে কোনাে কিছু জানে না। বিপরীত দিকের পাকিস্তানি পক্ষও অন্ধকারে রয়েছে। কেননা এর অল্পকাল পরেই ঢাকার রাস্তায় আরেকটু এগিয়ে যে অবস্থান, সেখানে শুরু হলাে ট্যাঙ্ক, পদাতিক ও গােলন্দাজ বাহিনীর প্রচণ্ড লড়াই। এর আগের লড়াইয়ে ছিনিয়ে নেওয়া দু’টি হালকা পাকিস্তানি ট্যাঙ্ককে ভারতীয় বাহিনী মােতায়েন করলাে সুবিধাজনক অবস্থানে, একটি আমবাগিচায় এবং অপরটিকে বাঁধের ধারে ১০০ গজ বামদিকে। | এবার আশপাশের সবার কানের পর্দা ফাটিয়ে গর্জন করে উঠলাে ট্যাঙ্ক। নদীর ওপারে দূরে যেখানটায় পাকবাহিনী অবস্থান নিয়ে ভারতীয়দের অগ্রগতি ব্যাহত করছিল তার সংলগ্ন কারখানা এলাকা আরাে চরমভাবে বিধ্বস্ত হলাে এই গােলাবর্ষণে। ফ্যাক্টরি ভবন। থেকে উঠতে লাগলাে কুণ্ডলী পাকানাে ধোঁয়া। পদাতিক বাহিনীর অগ্রগতি বিশ মিনিট ধরে গােটা এলাকা গােলায় দুরমুজ করার পর শুরু হলাে ট্যাঙ্কের মেশিনগানের গুলিবর্ষণ। ভবনের সামনে যেখানে বাঙ্কার করে পাকিস্তানিরা ছিল, প্রায় ঝাঁঝরা হয়ে গেল তখন বাঁধের নিচ দিয়ে ভারতীয় পদাতিক বাহিনীর একটি কলাম এগােতে শুরু করলাে। তাঁরা ডানদিকে মােড় নিয়ে একটি জলার ওপর দিয়ে এগােতে লাগলাে নদীর দিকে। বেলা সাড়ে বারােটা নাগাদ ঝলমলে রােদে পদাতিক বাহিনীর তৎপরতা দেখানাের জন্য সাংবাদিক দলটিকে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় ইউনিট।

পাকিস্তানিদের অবস্থান থেকে এখন আর পাল্টা গুলির কোনাে শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা বাঁধ বেয়ে ওপরের রাস্তায় উঠলাম এবংনীল আকাশের পটভূমিকায় নিজেদের শরীরের ছায়া-পরিলেখ।  অঙ্কন করলাম। আস্থার সঙ্গে আমরা হাঁটছিলাম সামনের দিকে। প্রায় মিনিটখানেক হবে। | হঠাৎ গর্জে উঠলাে একটি পাকিস্তানি মেশিনগান এবং পাশ দিয়ে হিসহিসিয়ে ছুটে গেল বুলেট। আমরা যে যেভাবে পারি বাঁধের বিপরীত দিকে ঝাঁপ দেই এবং গড়গড়িয়ে পড়ার সময় উড়িয়ে দেই ধুলাে ও কাঁকর। ভারতীয় মেজর আমাদের আশ্বস্ত করার জন্য বললেন, গুলি আমাদের ১০-১৫ গজ দূর দিয়ে ছুটে গেছে।  পাকিস্তানিদের অব্যাহত গােলাগুলির ভেতর আমরা সাবধানে বাঁধের আড়াল ধরে এগােতে থাকি। কালভার্টের ওপর ছুটে বেড়ানাে একটি বাচ্চা ছাগলের গায়ে এসে লাগে তাদের গুলি। একেবারে গুটিয়ে গেল ছাগশিশুটি। দশ মিনিটের মধ্যে আমরা একটি ভারতীয় প্লাটুনের কাছে পৌছুই। এরা বাঁধের ওপর শুয়ে পাকিস্তানিদের দিকে তাক করে রেখেছে রাইফেল ও মেশিনগান। পাকিস্তানিরা আমাদের পরিবর্তে এবার এঁদের উদ্দেশে গুলিবর্ষণ শুরু করলাে। T ভারতীয়রাও গুলিবর্ষণের জবাব দিতে লাগলাে। অবিরাম এই গােলাগুলির মধ্যে আমাদের সঙ্গের এক মেজর ফিল্ড রেডিওর বার্তা শুনতে পেলেন যে পাকিস্তানিরা | আত্মসমর্পণ করেছে। বিপরীত দিকের পাকিস্তানিদের নিঃসন্দেহে এ-সম্পর্কে অবহিত করা হয় নি। হেডকোয়ার্টারের সাথে কতক পাকিস্তানি ইউনিটের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

ওড়ানাে হলাে বড় আকারের রুমাল

তখন সময় ১২-৪০ মিনিট। পাকিস্তানিরা প্রায় এক ঘণ্টা যাবৎভারতীয়দের নিজ অবস্থানে। | অনড় করে রেখেছে। তারপর প্রায় ১-৪৫ মিনিটে একজন পাকিস্তানি সৈনিক, সম্ভবত | অফিসার, বিপরীত তীরের খােলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে ওড়াতে লাগলেন বড় এক রুমাল। | ভারতীয় মেজর এস, এস, ধিলন বাঁধের ওপর উঠে নদীর তীরে নামলেন। একটি দেয়ালের আড়াল নিয়ে তিনি চিৎকার করে পাকিস্তানিদের অবিলম্বে আত্মসমর্পণ করার জন্য বললেন।  তােমার বের হচ্ছে কি হচ্ছে না বলাে, ‘ চিৎকার করে উঠলেন মেজর। আমি চাই তােমরা বের হয়ে এসাে। এক মিনিট সময় দিলাম, এরপর আমার ধৈর্য থাকবে না। আমি চাই তােমরা বের হয়ে এসাে। তােমার লােকদের জড়ো করাে এবং সামনে এগিয়ে এসে নদী পার হবার ব্যবস্থা নাও। তােমার ঐ বেজন্মা স্টেনগান মাটিতে ফেলে দাও। কামানের গােলায় তােমাদের ছিন্নভিন্ন করে দিতে বাধ্য করাে না আমাকে। আমি আবারাে বলছি, বের হয়ে এসাে, বের হয়ে এসাে।’  মেজরের পিছু পিছু সাংবাদিকরাও এগিয়ে এসেছিলেন দেয়ালের কাছে। কিন্তু তাঁরা যেখানটায় গুটিসুটি মেরে ছিল সেখান থেকে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। মেজর সদাশয়তার পরিচয় দিয়ে অবস্থা বর্ণনা করছিলেন, “ওখানে একজন অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে আছে আরাে চারজন লােক। সে শাদা রুমাল নাড়াচ্ছে। এবার ওরা আত্মসমর্পণ করছে।  সব মিলিয়ে ১০ জন। বাদবাকি পাকিস্তানি, সংখ্যা তাদের যাই হােক, স্পষ্টতই পালিয়েছে। এই দৃশ্য—যা সম্ভবত পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধের শেষ লড়াই—সম্পন্ন হতে সময় লেগেছিল ২০ মিনিট। এই সময় পাশের এক অগভীর পদ্মপুকুরের ধারে বসে গােঙাচ্ছিল যন্ত্রণাকাতর আহত দুই ভারতীয় সৈনিক। মেজর যখন আত্মসমর্পণকারী প্লাটুনকে জড়াে করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন রাস্তায় ধুলাের ওড়াউড়ি দেখে ইঙ্গিত পাওয়া গেল ব্রিগেড হঠাৎ করে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে।

প্রতিটি মুখে আনন্দের ছোঁয়া

দূরে পিস্তল-বন্দুকের গুলির আওয়াজ পাওয়া গেলেও গুরুতর প্রতিরােধের কার্যত অবসান ঘটেছে। ভারতীয় পদাতিক বাহিনীর কলাম প্রতিটি সৈনিকের চোখে-মুখে আনন্দের ছোঁয়া— এগিয়ে যাচ্ছিল প্রাদেশিক রাজধানীর দিকে। মাত্র কিছুক্ষণ আগে যে ট্যাঙ্কগুলাে পাকিস্তানিদের দফারফা করছিল তারই একটিতে সওয়ারী হয়ে এগােলেন বর্তমান সংবাদদাতা। | রাস্তা ভরে আছে ঢাকাগামী সৈন্য ও বাঙালিতে, তাঁদের অবলম্বন ট্যাঙ্ক, ট্রাক, স্কুটার, সাইকেল, রিশা এবং স্রেফ পদযুগল। যে যেভাবে পারছে সওয়ারী হচ্ছে মুক্ত রাজধানীর উদ্দেশে। একটি সামরিক বহরের চাইতে দৃশ্যটা বরং অনেকখানি সার্কাসের প্যারেডের মতাে। | সৈন্যদের যাত্রাপথেরসবখানেই বাচ্চাদের কোলে নিয়ে তুলে ধরছে পিতা, তাদের হাত ধরে নেড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে ভারতীয় সৈন্যদের। শীতলক্ষ্যা নদীর পারে এসে জলচর ট্যাঙ্কটির নদী পাড়ি দেয়ার জন্য যাত্রী কিছু ঝেড়ে ফেলতে হলাে। আমি একটি দেশী নৌকো নিয়ে নদী পার হই। অপর পাড়ে এসে আরাে কতক অফিসার, সৈনিক, সাংবাদিক মিলে সওয়ার হই জিপে, জিপের চালক ব্রিগেড কম্যান্ডার ব্রিগেডিয়ার আর.এন. মিশ্র। যুদ্ধের কিছু ক্ষত পুরু মােচের কম্যান্ডার ঢাকার পথে গাড়ি চালাচ্ছিলেন ধীরে ধীরে, সামনের বনেটের ওপর বসা যাত্রীদের গাদাগাদি ভিড়ের ফাঁক দিয়ে কোনােক্রমে রাস্তা দেখে নিতে চেষ্টা করছিলেন। আমরা যে গ্রাম এলাকার মধ্য দিয়ে চলছিলাম সেখানে যুদ্ধের বিশেষ ধ্বংসচিহ্ন নেই। সবখানেই প্রায় একই দৃশ্য। রাস্তার মাঝেমধ্যে পড়ে আছে অগ্নিদগ্ধ যান, কামান অথবা মর্টারের গােলায় বিস্ফোরিত, আরাে দেখা যায় বােমায় বিধ্বস্ত পাকিস্তানি বাঙ্কার। আর যেসব জায়গায় পাকিস্তানিরা প্রতিরােধ দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছে দেখা যাবে কালচিটে অথবা ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন ও কুঁড়েঘর। | পশ্চাদপসরণকালে যেসব সড়ক ও রেলসেতু পাকিস্তানিরা ধ্বংস করেছে তাছাড়া গােটা অঞ্চল মােটামুটিভাবে বড়রকম ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। কোথাও কোথাও এমনকি দেখা যায় ধানখেতের পাশের নালায় মাছের উদ্দেশে ঝাঁপ দিচ্ছে মাছরাঙা পাখি। 

কাছেকার কলাবাগানে সবুজ নারকেল বীথির নিচে চরে বেড়াচ্ছে গরু। বস্তুত অনেকসময় এটা বােঝা কঠিন হয়ে ওঠে যে এই দেশকে স্পর্শ করেছে একটা যুদ্ধ—সেকথা জানান। দিচ্ছে কেবল মৃতদের নীরবতা এবং নিরুদ্দিষ্টরা, আর কখনােই যারা ফিরে আসবে না। | তা সত্ত্বেও যুদ্ধের এক সুস্পষ্ট চিহ্ন বিদ্যমান রাস্তার ধারে পাকিস্তানি সৈন্যরা, যারা অপেক্ষা করছে আত্মসমর্পণের । তাদের অস্ত্র গ্রহণ কিংবা আত্মসমর্পণ এলাকায় একত্র করার মতাে সময় পাওয়া যায় নি এবং অস্ত্রসহই তারা রয়েছে রাস্তার ধারে। ২৫ মার্চ ও তার পর স্বায়ত্তশাসনকামী বাঙালিদের আন্দোলন দমন করতে নিরস্ত্র সাধারণজনের। বিরুদ্ধে এই অস্ত্রের ব্যবহার প্রত্যক্ষ করেছেন যেসব পথচারী, তাঁদের জন্য এ এক রক্ত হিম-করা দৃশ্য। | পাকিস্তানিদের দেখাচ্ছে কেমন একটা ঘােরে আচ্ছন্ন এবং তাদের মনােবল নেই বলেই মনে হয়। তারা সান্ত্বনা খুঁজে বেড়ালেও যে-জনগণ তাদের বুলেটের রাজত্বে এতাে যন্ত্রণা | ভােগ করেছে, সেখান থেকে তেমন কিছু পাওয়া সুদূরপরাহত। | কম্যান্ড পােষ্টের ব্যারাকের সামনে ব্রিগেডিয়ার মিশ্র তাঁর জিপ থামালেন। পাকিস্তানি অফিসারকে নির্দেশ দিলেন আত্মসমর্পণ গ্রহণের জন্য ভারতীয় সৈন্যরা এসে পৌছনাে অবধি তার লােকজনদের ভেতরে রাখতে। সতর্ক করে দিয়ে বললেন, “কেউ রাস্তায় যাবেন না। ওখানে মুক্তিবাহিনী থাকতে পারে। | মুক্তিবাহিনীর অনেক সদস্যই প্রতিশােধ নিতে উদগ্রীব। তাঁদের রাজনৈতিক টার্গেট | কেবল পাকিস্তানি সৈন্যরা নয়, সেনাবাহিনী প্রশিক্ষিত রাজাকার বা হােমগার্ড এবং অবাঙালি ও অন্য আর বেসামরিক দালালরাও।  জিপে বসা এক অফিসার বললেন, “এই ডামাডােলের মধ্যে আমরা যদি পাকিস্তানিদের রক্ষা না করি তবে মুক্তিবাহিনী তাদের কচুকাটা করবে।’ অস্বস্তিকর সজ্ঞাত জিপ যখন ঢাকার দিকে এগিয়ে চলছিল হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলাে কয়েক শত বাঙালি, আনন্দে উদ্বেল তাঁরা সবাই, উচ্চকণ্ঠে স্বাগতিক স্লোগান দিয়ে এগিয়ে আসছিল ভারতীয় বাহিনীর দিকে। 

এদিকে, ৫০ ক্যালিবর মেশিনগান বসানাে একটি পাকিস্তানি জিপও এগােচ্ছিল জটলার দিকে। পাকিস্তানিরা মনে করলােজনতা বুঝি তাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং মেশিনগানের এলােপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করলাে কয়েক দফা। দুই ব্যক্তি পড়ে গেল মাটিতে, আহতদের ধরাধরি করে তুলে জনতা আবার মিলিয়ে গেল। কুদ্ধ ব্রিগেডিয়ার মিশ্র ও ভারতীয় বাহিনী চার পাকিস্তানিকে পাকড়াও করে তাদের অস্ত্রপাতি কেড়ে নিল। সমানে গালাগাল করে চললাে তাদের যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা ভয়ে একেবারে মিইয়ে গেল, ভেবেছিল এখুনি বুঝি তাদের প্রাণে মারা হবে। তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হলাে অন্যত্র প্রহরাধীনে রেখে কোর্ট মার্শাল করার জন্য। | পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে বােঝাই একটি বাস দেখা গেল    ঢাকার দিকে যাচ্ছে। বাসের ছাদেও লােকজন। নারী ও শিশুরা যেভাবে পুরুষ সঙ্গীর লগ্ন। হয়ে আছে, স্মরণ করিয়ে দেয় তা ভীত শরণার্থীদের চিত্র। ভারতীয় বাহিনীর ঢাকা আক্রমণ শুরুর আগেই যেহেতু পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ। করেছে, তাই শহরের কোনাে বড়রকম ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। বিমানবন্দর ও মিলিটারি। ক্যান্টনমেন্টে বােমা বর্ষণের ক্ষতি ছাড়া তেমন আর বিশেষ কিছু ঘটে নি। বিমানবন্দর অভিমুখী রাস্তায় এখনাে বড় বড় গর্ত হয়ে আছে। রানওয়ে মেরামত করা হয়েছে। তবে একদিকে স্থূপ করা আছে একদা যা ছিল জঙ্গি বিমান, তার ভাঙাচোরা ধ্বংসপ। টারমিনাল ভবনের জানালার সব কাচ বিমান হামলায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। বহু বাড়িঘর দোকানপাট এখনাে তালাবন্ধ, অপেক্ষা করছে গৃহকর্তা ও মালিকের প্রত্যাবর্তনের। এরপরও নীরবে জমে উঠছে ভিড়। যেন শূন্য থেকে উদয় হচ্ছে এঁদের। তাঁরা ঘিরে ধরছিল আমাদের গাড়ি আনন্দধ্বনি করে ‘ভাই’ বলে ডাকছিল আমাদের এবং হাতে হাত মেলাচ্ছিল। স্পর্শ করতে চাইছিলাে আরেকজন মানুষকে। সূর্যাস্তের কাছাকাছি সময়ে দশটি ভারতীয় হেলিকপ্টারের বহর একসঙ্গে উড়ে এসে ।

বিমানক্ষেত্রে অবতরণ করে। জেনারেল অরােরা ও অপরাপর ভারতীয় অফিসারদের তারা বহন করে নিয়ে এসেছে কলকাতা থেকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের জন্য এঁরা সবাই এসেছেন। টারমাকে অপেক্ষা করছিলেন জেনারেল নিয়াজি, কসরৎ করে আত্মসম্মানের মুখােশ এঁটে রাখছিলেন, মাথায় তার কালাে টুপি, হাতে একটি ভাঁজ-করা বহনযােগ্য। শিকারির আসন, যদিও এর ভাঁজ খুলে বসেন নি তিনি কখনাে। তার পাশে দাঁড়িয়ে জেনারেল অরােরার চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে.এফ.আর. জ্যাকব, অল্প কিছুক্ষণ আগেও আনন্দ-উন্মত্ত বাঙালি জনতার অধীর আলিঙ্গনে অস্থির হয়ে ছিলেন তিনি। উভয়েই স্বাগত জানাতে এগিয়ে গেলেন জেনারেল অরােরার হেলিকপ্টারের দিকে। মাইক ও ক্যামেরা বেষ্টিত থাকার পর তাঁরা আত্মর্পণ-দলিল স্বাক্ষরের জন্য গাড়ি করে । রেসকোর্স ময়দানের দিকে চললেন। দলিল স্বাক্ষরের পর দুই জেনারেল উঠে দাঁড়িয়ে হাত মেলালেন। একটি জিপে করে। ফিরে চললেন জেনারেল নিয়াজি, স্টাফ করে জেনারেল অরােরা। | ভারতীয় সামরিক দলটি যখন ফিরে যাচ্ছিল, বিমানবন্দরে তখনাে বিক্ষিপ্ত গুলির। আওয়াজ শােনা যাচ্ছিল। ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে তাঁরা কলকাতার উদ্দেশে ফিরতিযাত্রা। শুরু করেন। সারাদিন জুড়েই শহরে চলছিল বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ। রেডক্রস ঘােষিত নিরপেক্ষ এলাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলের সামনে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে ঘটে বন্দুক লড়াই। রাতে আত্মসমর্পণ-স্থলে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে দীর্ঘ সারিতে দাঁড় করানাে। পাকিস্তানি সৈন্যদের দেখাচ্ছিল আগ্রহী ও আশ্বস্ত, কেননা, সেখানে বাঙালিদের হাত থেকে। তাদের রক্ষা করবে ভারতীয় বাহিনী। 

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!