You dont have javascript enabled! Please enable it!

যে কোনাে যুদ্ধের মতাে সবকিছু এখানে রয়েছে—ভালাে লােক। আর খারাপ লােক, মুক্তিদাতাদের বুকে টেনে নিচ্ছে হর্ষোৎফুল্ল সাধারণ মানুষ, আনন্দেবিসর্জন করছে অশ্রু—যুদ্ধে পরাজিত যে খারাপ লােকেরা তারাও, লােকবলে অস্ত্রবলে বিপুল শক্তিশালী পক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, লড়াই ও মৃত্যুবরণ করার জন্যে। অনিচ্ছুক সম্মান আকর্ষণ করেন। এবং এর অঙ্গাঙ্গী অংশ হিসেবে রয়েছে একটি জাতির জন্ম। জাতিগতভাবে ভিন্ন, শ্রেণীগতভাবে অবজ্ঞা প্রকাশকারী শােষকদের দীর্ঘ শাসন-শােষণ জনগণ এখন উৎখাত করতে চলেছে ভারতীয়দের সহায়তায়। সংক্ষেপে বলতে অল্প কিছুকাল পরে এই ভূখণ্ড হয়ে উঠবে বাংলাদেশ, ৭৫ মিলিয়ন মানুষ একে করে তুলবে বিশ্বের সপ্তম জনবহুল রাষ্ট্র। ভারতীয় সেনাবাহিনী, যাঁরা ইতিমধ্যে দেশের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত আঞ্চলিক রাজধানী ঢাকার দিকে এগিয়ে চলছে, কীভাবে এত দ্রুত সেটা করতে পারলাে ? শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকার কথা ছিল পাকিস্তানিদের। গােটা দেশে আঁকিবুকি করে আছে গতিপথচঞ্চল নদী ও খাল। ভূভাগের অধিকাংশ হচ্ছে নরম ও জলাভূমি। ভারতীয় ট্যাঙ্কের চলাচলের জন্য মােটেই অনুকূল নয়। কিন্তু অন্য সব সুবিধাই ভারতীয়দের রয়েছে। ১৩৫০ মাইল-দীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে যে-কোনাে ভারতীয় অনুপ্রবেশ-প্রচেষ্টা রােধ করার চেষ্টায় পাকিস্তানিরা অতিরিক্ত ছড়িয়ে পড়ে নিজেদের অবস্থান হালকা করে ফেলেছে। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সৈন্যসংখ্যা ৭০ থেকে ৮০ হাজার। ভারতীয় সৈন্যসংখ্যা এর দ্বিগুণ। পাকিস্তানিদের জঙ্গি বিমান রয়েছে  মাত্র ২৩টিপুরনাে এফ-৮৬ স্যার জেট। ভারতীয়দের বিমানের সংখ্যা বেশি, এবং সেগুলাে নতুন ও উন্নততর। যুদ্ধের দু’দিন না যেতেই দুই-তিনটি বাদে সবগুলাে স্যাবর জেটই বাংলার আকাশ থেকে ভূপাতিত করা হয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে প্রত্যয়দীপ্ত যুদ্ধবিবরণী প্রদানের পর গত শুক্রবার পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র স্বীকার করেছেন যে, ‘অতিপরিশ্রান্ত’ পাকিস্তানি সৈন্যদের কোনাে বিমান সমর্থন নেই। | তবে এই যুদ্ধে অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে পাকিস্তানি সৈনিকের বিচ্ছিন্নতা। জনগােষ্ঠীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ঘৃণার পাত্র সে, কেননা আট মাস আগে তাকে হত্যা ও বর্বরতার অবাধ অধিকার দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল এখানে, যতক্ষণ পর্যন্ত। না জনগােষ্ঠীকে অবদমিত ও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করা যায়।

কিন্তু পাকিস্তানিদের কল্পনাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল বাঙালিদের রুখে দাঁড়াবার শক্তি। এবংএখন পাকিস্তানিদের দশা হয়েছে বৈরী সাগরে মাছের মতাে। যখনই সে পিছিয়ে যাচ্ছে। সবসময়েই শঙ্কা বহন করছে কোথাও থেকে কোনাে বাঙালি গেরিলা হয়তাে ঝাঁপ দিয়ে পড়বে তার ওপর। হাতের আঙুল কেটে ফেলে ধীরে ধীরে দেখবে তার মৃত্যু। ভারতীয় অগ্রাভিযানের মুখে অনেক পাকিস্তানি সৈন্য চেষ্টা করছে উর্দি ছেড়ে সাধারণ পােশাকে গ্রামাঞ্চলে মিলিয়ে যেতে। কিন্তু এটা এক ব্যর্থ প্রয়াস। বাঙালিদের ভূমিতে একজন পাকিস্তানির লুকোবার কোনাে উপায় নেই। এই দেশের মানুষের চেয়ে সে দীর্ঘাঙ্গ, শক্তসমর্থ আর ফর্সা। বাংলা ভাষা সে রপ্ত করলেও উচ্চারণভঙ্গিতে ধরা পড়ে যাবে অবধারিতভাবে। আর যদি উর্দুঅথবা পশতু ভাষা ছাড়া অন্য কিছু তার জানা না থাকে তবে তাে আত্মসমর্পণই একমাত্র ভরসা। এটা সত্য যে ভারতীয়রা সবসময়েই পাকিস্তানিদের বে-রাস্তা দিয়ে আক্রমণে কাবু করেছে। বড় রাস্তায় বাঙ্কার ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দাঁড় করিয়ে পাকিস্তানিদের গড়া শক্ত বাধা ভারতীয়রা পাশ কাটিয়ে গেছে ছােট রাস্তা ও দেশীয় সড়ক দিয়ে। এবং কোনাে বিদেশভূমিতে যুদ্ধ পরিচালনাকালে সম্ভাব্য সর্বশ্রেষ্ঠ স্থানীয় গােয়েন্দা-সহায়তা পাচ্ছে ভারতীয়রা। এটাও সত্যি যে পাকিস্তানিরা যশােরের মতাে এমন সব জায়গা থেকে পিছিয়ে এসেছে। যেখানে তাদের ছিল সুবিন্যস্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং তাদের অবস্থানচ্যুত করতে ভারতীয়দের আরাে কঠিন ও দীর্ঘ সময় প্রয়ােজন হতাে। এবং পাকিস্তানিরা পিছিয়ে আসছে এমন ভাব নিয়ে যেন যত পেছনে ততই নিরাপদ। এতসব সত্ত্বেও যখনই পাকিস্তানিরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ইউনিটের বাকি অংশকে রক্ষা করার জন্যই হােক অথবা একেবারে উপায়হীন হয়েই হােক তখন তারা লড়াই করেছে। ভয়ঙ্কর, প্রায় ভূতগ্রস্তের মতাে এবং ভারতীয়রা যতটা না স্বীকার করতে প্রস্তুত তাঁদের হতাহত হয়েছে তার চাইতেও বেশি। তবে এখন ভারতীয় সৈন্যরা ক্রমেই আরাে এগিয়ে আসছে। ঢাকার ৩০,০০০ সৈন্যের চারপাশের ফাঁস প্রায় গুটিয়ে আনছে ও এমনিভাবে দেশের বিভিন্ন পকেটে পাকিস্তানিদের অবস্থান বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। পালাবার সব পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যেখানে  পাকিস্তানিরা নদীবন্দরে পিছিয়ে এসেছে ভারতীয়রা বন্দর দিয়ে বের হবার উপায় নষ্ট করে। দিয়েছে—যে কোনাে নৌযান বের হবার উপক্রম করতেই ভূমি ও আকাশ থেকে আক্রমণ করে তা বানচাল করা হচ্ছে। | পাকিস্তানিদের প্রতি আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছে ভারতীয়রা কিন্তু পাকিস্তানি জেনারেলদের মুসলিম জেহাদি মনােভাব সুপরিচিত এবং এমনটা খুবই সম্ভব যে শেষ মানুষটি ও শেষ কার্তুজটি পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার হুকুম তারা দেবে—পাগলামি বটে, তবে অসম্ভব কিছু নয়। একটি রক্তস্নান ঘটবে, একটি ডানকার্ক, তবে এমনিভাবে কোনাে জাতির জন্ম এটাই তাে প্রথম নয়। 

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!