You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারত আজ প্রথমবারের মতাে স্বীকার করেছে যে, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে তার সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে, তবে বলেছে যে এটা একবারই ঘটেছে,—বিগত রবিবার—এবং শুধু আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। নয়াদিল্লিতে সংসদে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই স্বীকারােক্তি করেন এবং সেদিনকারইবিলম্বিত প্রহরেএক প্রেস ব্রিফিংএ সরকারি মুখপাত্র এর সবিস্তার বর্ণনা দেন।  প্রধানমন্ত্রী ঘােষণা করেছেন যে, ভারতীয় সৈন্যদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া রয়েছে তারা। যেন আত্মরক্ষার প্রয়ােজন ছাড়া সীমান্ত অতিক্রম না করে। সরকারি মুখপাত্র বলেন যে, এই মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তানে কোনাে ভারতীয় ডিভিশন নেই এবং সেখানে গােটা যুদ্ধটা চলছে পাকিস্তানি ও স্বাধীনতাকামী বাঙালি বিদ্রোহীদের মধ্যে। পাকিস্তানি আক্রমণের অভিযোেগ প্রধানমন্ত্রী ও সরকারি মুখপাত্র উভয়ে বলেছেন যে, কলকাতা থেকে ২৫ মাইল দূরে বয়রা এলাকায় ট্যাঙ্ক ও কামান নিয়ে পাকিস্তানি আক্রমণ ঠেকাতে গত রবিবার ভারতীয় বাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করেছে। পার্লামেন্টে। প্রদত্ত বিবৃতিতে শ্রীমতী গান্ধী বলেন, ‘পাকিস্তানি প্রচার মাধ্যমগুলাে গালগল্প জুড়ে বসেছে যে ভারত অঘােষিত যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এবংট্যাঙ্ক ও সৈন্য নিয়ে বিশালাকার আক্রমণ শুরু করেছে। এসব পুরােপুরি অসত্য। সীমান্ত এলাকায় বিদেশীদের গমনাগমনের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরােপের পাশাপাশি ভারতীয় বাহিনীর সীমান্ত অতিক্রমের এই স্বীকারােক্তি প্রদত্ত হলাে। ঐ নিষেধাজ্ঞা জারির মূল কারণ হলােবিদেশী সাংবাদিকদের  সৈন্য চলাচল প্রত্যক্ষ করা থেকে বিরত রাখা। গতকাল বর্তমান সংবাদদাতা সীমান্ত থেকে ছয় মাইলেরও কম দূরত্বে বয়রায় ভারতীয় সৈন্য ও অস্ত্রপাতির বিরাট বহরকে সীমান্তের দিকে যেতে দেখেছে। এই সীমান্ত সংলগ্ন ” হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের যশাের জেলা এবং গত সপ্তাহান্তে ভারতের সমর্থনে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণাভিযান শুরুর পর এখানটাতেই সবচেয়ে বড় সংঘর্ষ ঘটেছে। তাদের বাহিনী যে। যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ছে এই সত্য রাখঢাক করার কোনাে চেষ্টা অত্র এলাকার ভারতীয় অফিসাররা করেন নি।

জোর লড়াইয়ের সংবাদ

একদিকে বিদেশী সংবাদদাতাদের সম্মাতপূর্ণ এলাকায় প্রবেশ নিষেধ করা হয়েছে, অপরদিকে ভারতীয় সাংবাদিকরা সীমান্ত অতিক্রম করে যাওয়া সম্পর্কে কিছুই রিপাের্ট করছেন না, এই পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানে লড়াইয়ের বিস্তারিত খবর বিশেষ পাওয়া যাচ্ছে না। নির্ভরযােগ্য সূত্রে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে জোর লড়াই চলছে যশাের, দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেটে। প্রধান লক্ষ্য মনে হচ্ছে যশাের ও সিলেট শহর অধিকার করা। যশাের বিমানবন্দরে গােলা বর্ষিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিদ্রোহী বাংলাদেশ সরকারের সূত্র জানিয়েছে যে যশােরের উত্তরে মেহেরপুরের যুদ্ধে গেরিলাদের সমর্থন যুগিয়েছে ভারতীয় ট্যাঙ্ক। ইয়াহিয়া খানকে ভৎসনা গতকাল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জারি করা জরুরি অবস্থা সম্পর্কে পার্লামেন্টে শ্রীমতী গান্ধী বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ওপর থেকে বিশ্বজনমতের দৃষ্টি অন্যত্র ফেরানাে এবং স্বয়ংসৃষ্ট পরিস্থিতির দায়ভার অন্যের ওপর চাপানাের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান-এর) প্রচেষ্টার চূড়ান্ত রূপ এটা। প্রধানমন্ত্রী আরাে বলেন যে, ভারত কেবল পাকিস্তানের মাসাধিককালব্যাপী যুদ্ধংদেহী পদক্ষেপের মােকাবেলা করছে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে অক্টোবরে সীমান্ত জুড়ে সৈন্য মােতায়েন এবং পূর্ব পাকিস্তানে পরিচালিত সামরিক অ্যাকশন, যার ফলে ভারতে পালিয়ে এসেছে নব্বই লক্ষ শরণার্থী।  তিনি বলেন, পরিস্থিতির অবনতি ঘটুক কিংবা সংঘর্ষ শুরু হােক এটা কখনােই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। এখন পর্যন্ত আমরা সৈন্যদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছি আত্মরক্ষার প্রয়ােজন ব্যতীত যেন সীমান্ত অতিক্রম করা না হয়।’ বক্তব্যের সমাপ্তি টেনে তিনি বলেন, “যদিও পাকিস্তান জরুরি অবস্থা ঘােষণা করেছে তা সত্ত্বেও আমরা তুলনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকবাে, যদি না পাকিস্তানের অধিকতর আগ্রাসী প্রচেষ্টা জাতীয় স্বার্থে আমাদের তা করতে বাধ্য করে।  ‘একই সময়ে দেশকে থাকতে হবে অবিচল। আমাদের বীর সেনাবাহিনী ও জনগণ এটা নিশ্চিত করবে যে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের যে-কোনাে অ্যাডভেঞ্চারবাদী প্রচেষ্টার উপযুক্ত জবাব তারা পাবে। | ‘পাকিস্তানের শাসকদের এটা উপলব্ধি করতেই হবে যে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র পদদলিতকরণ এবং যুদ্ধের চেয়ে শান্তির পথ—শান্তিপূর্ণ আলােচনা ও সমঝােতা—অনেক বেশি ফলদায়ক।’ 

সাংবাদিকদের অবহিত করার সময় ভারতীয় মুখপাত্র বলেছেন যে, গত রবিবার সীমান্ত অতিক্রমকালে ভারতীয় ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য বাহিনী ১৩টি পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছে। সীমান্ত অতিক্রমের এটাই প্রথম ঘটনা হিসেবে ভারতীয় বক্তব্য সত্ত্বেও এখানকার সরকারি সূত্রে এ খবরের সমর্থন মেলে যে গত কয়েক সপ্তাহে ভারতীয় সৈন্যরা সংঘর্ষকালে বেশ কয়েকবার সীমান্ত পার হয়ে গেছে। গত রবিবার ভারতীয় সৈন্যরা কতটা ভেতরে ঢুকেছিল এই প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, ‘কতদূর তা আমি বলতে পারবাে না। তবে এটা স্বল্প দূরত্বের।’ – ভারতীয়রা সীমান্ত পার হয়ে কতটা ভেতরে যাবে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, এ ক্ষেত্রে সীমানা টেনে দেওয়া সম্ভব নয়।  কোনৃস্তরে সীমান্ত পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা ঠিক করবেন সংঘর্ষস্থলে অবস্থিত ব্যক্তি নিচের দিকে একক সৈন্যটি অবধি। সীমান্তের কাছে বিরাট বহর সীমান্ত এলাকা থেকে কলকাতায় আসা ভারতীয় নাগরিকরা খবর জানাচ্ছেন যে, ভারতীয় সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে পড়ছে। সীমান্তের ওপার থেকে, বিশেষভাবে রাতে, ভারি গােলাগুলির আওয়াজ পাওয়ার কথাও তাঁরা জানান। | আজ কলকাতা থেকে সীমান্তের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে ৫০তম ছত্রী ব্রিগেডের অন্তত পঞ্চাশটি গাড়ির এক বহর ট্রাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল রিকয়েললেস রাইফেল ও যাবতীয় অস্ত্রপাতি। হেলমেটধারী সৈন্যরা সব যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত, ক্যামােফ্লেজ করা।  কলকাতা বিমানবন্দরকে অর্ধ-নিপ্রদীপ ব্যবস্থাধীনে আনা হয়েছে এবং প্লেনের ওঠানামার পথ কিছুটা পাল্টানাে হয়েছে, যাতে বিমানগুলাে সীমান্ত থেকে অন্তত দশ মাইল দূরে থাকে।

ক্রমেই আরাে বেশি করে সীমান্ত এলাকা সকাল-সন্ধ্যা কারফিউয়ের আওতায় আনা হচ্ছে। বিদেশী সাংবাদিকদের ওপর বাধা-নিষেধ আজ ভারত সরকার প্রচারিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় তথ্যের স্বাধীনতা যাতে ক্ষুন্ন হয়, সেদিকটাতে সরকারের মনােযােগ রয়েছে। সীমান্ত এলাকায় গমনে সংবাদদাতাদের বর্ডার পারমিট প্রদান যাতে দ্রুততর করা যায় এই প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে বলা হয় যে, এমনি অনুমােদন প্রদত্ত হবে জনস্বার্থ, জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক সম্ভাব্যতার নিরিখে’। তবে বর্তমান সংবাদদাতাসহ আরাে কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিক সীমান্তের কাছে    যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ বারাসাতে তাঁদের পথ রােধ করে, কলকাতার কেন্দ্র থেকে এই স্থান মাত্র ১৮ মাইল দূরে। পুলিশ জানায় যেসব বর্ডার পারমিট সবেমাত্র ইস্যু হয়েছে সেসব বাদে বাকি সব বাতিল বলে গণ্য হবে—এই মর্মে তারা নতুন নির্দেশ পেয়েছেন। একজন পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট বললেন, এই নিষেধাজ্ঞা জারির কারণ গতকাল যেসব সংবাদদাতা সীমান্ত এলাকায় গিয়েছিলেন তাঁরা পূর্ব পাকিস্তান অভিমুখী ভারতীয় সৈন্যদের দেখতে পেয়েছেন। বর্তমান সংবাদদাতার মেঘালয় গমনের পারমিটও বাতিল হয়েছে একই কারণে। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমােদন সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব অশােক। কাপুর তা দিতে সম্মত হন নি। তিনি বললেন, “আপনি সদাচারণ করেন নি। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনি নীতিভঙ্গ করেছেন।  

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!