You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.02 | কঠোর নীতি নিচ্ছে ভারত নয়াদিল্লি ভারত নভেম্বর ২- ১৯৭১ - সংগ্রামের নোটবুক

ব্যাপক কূটনীতিক ও সামরিক চাপের মুখে প্রতীয়মান হচ্ছে। ভারত পাকিস্তান এবং পশ্চিমী দেশসমূহ বিশেষভাবে আমেরিকার প্রতি তাঁর নীতি কঠোর করেতুলছে। ভারতের বিবেচনায় পশ্চিমী দেশসমূহ, সমস্যা অনুধাবনেঘাটতির পরিচয় দিচ্ছে।  প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমা দেশে তাঁর তিন সপ্তাহের সফর কর্মসূচি বহাল রেখেছেন। আগামীকাল তিনি এসে পৌছুবেন আমেরিকায়। এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে ভারতের আত্মবিশ্বাস এবং পাকিস্তানকে আক্রমণ করতে তার অনাগ্রহ। ইদানীং যেসব উগ্র ভাষণ দিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রাম তার লক্ষ্য মনে হচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই শুরু করলে যে চড়া মূল্য পাকিস্তানকে দিতে হবে সেসম্পর্কে তাদের সতর্ক করে দেওয়া। এটা সুস্পষ্টতই অনুধাবন করা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে আগামীকাল শ্রীমতী গান্ধী যখন সাক্ষাৎ করবেন তখন তিনি। কঠোর নীতিই মেলে ধরবেন। তবে তিনি সহানুভূতিসম্পন্ন সাড়া পাবেন কিনা সেটা ঠিক বােঝা যাচ্ছে না। এখানকার বিশ্লেষকদের মতে ওয়াশিংটনের স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য মনে হচ্ছে উপমহাদেশের সঙ্কট যেন পিকিং ও মস্কোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে প্রেসিডেন্টের বিশ্বজনীন পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে না পারে, সেটা দেখা। মার্কিন উম্মা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহে ভারতের সর্বশেষ অবস্থান নিয়ে হােয়াইট হাউজের ক্রমবর্ধমান উম্মা প্রকাশ পেয়েছে। ভারতের এইসব পদক্ষেপের  ভেতরে রয়েছে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক গ্রহণে অসম্মতি, পূর্ব পাকিস্তানে তাদের বর্বরতা থামিয়ে পাকিস্তান যতদিন পর্যন্ত না শরণার্থী প্রবাহ বন্ধ করে ততদিন পর্যন্ত সীমান্ত থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি এবং পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত নেতৃত্বের সঙ্গে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত আলােচনার কিছু নেই—এই বক্তব্যের ভিত্তিতে জাতিসংঘ অথবা তৃতীয় দেশের মধ্যস্থতা গ্রহণে তাদের আপত্তি।

মার্কিন কর্মকর্তারা আড়ালে-আবডালে এখন বলে থাকেন যে, ভারত তার পুরনাে শত্রু পাকিস্তানকে দুর্বল করতে আগ্রহী; পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি বিদ্রোহীদের সহায়তা ভারতীয় স্বার্থরক্ষার জন্য প্রদত্ত হয় নি, বরং পাকিস্তানের সংহতি-নাশ ত্বরান্বিত করাই এর উদ্দেশ্য। সংক্ষেপে মার্কিন কর্মকর্তারা যা বলছেন, তা হলাে, ভারত যুক্তির পথে চলছে না। তবে এখানকার বেশির ভাগ কূটনীতিক একদিকে যেমন স্বীকার করছেন যে ভারতের নীতি আরাে শিথিল করার সুযােগ থাকা দরকার ছিল, তেমনি এটাও বলছেন যে, অযৌক্তিক অবস্থান নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাঁরা উল্লেখ করছেন যে, আমেরিকানরা ভারতকে সংযত থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন অথচ তাকে কোনাে ধরনের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন না এবং পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার মূল উৎপাটন ও সেই সূত্রে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী-সৃষ্ট চাপ অপসারণের জন্য কোনাে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও দিচ্ছেন না। সবচেয়ে খারাপ দিক হলাে, এইসব। কূটনীতিকে মতে, পাকিস্তানের সামরিক অপারেশনের প্রকাশ্য সমালােচনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এবং অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখে ওয়াশিংটন নিজেকে পাকিস্তানের সমর্থক প্রতীয়মান করেছে। এক কূটনীতিক বললেন, “যে কূটনৈতিক উদ্যোগ মূল সমস্যার প্রতি সহানুভূতি অথবা কোনাে ইতিবাচক প্রস্তাবনা ছাড়া শুধু সংযত থাকার পরামর্শ দেয়, তার সাফল্য সম্পর্কে আমার সন্দেহ রয়েছে।’ সফর শুরুর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে শ্রীমতী গান্ধী ঘােষণা করেছেন, আপনারা জানেন সকলেই আমাদের সংযত আচরণের প্রশংসা করছেন। আমরা পাচ্ছি মৌখিক প্রশংসা আর যারা সংযত নেই তারা পাচ্ছে অস্ত্রের সহায়তা।’ ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কসর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসার পাশাপাশি সােভিয়েতের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন শিখর স্পর্শ করেছে। আগস্ট মাসে ভারতের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং পাকিস্তানি আক্রমণ ঘটলে মস্কো ভারতের পক্ষে থাকবে এই আশ্বাস প্রদান করে। রুশিরা একদিকে শশাভনভাবে ভারতকে সংযত থাকার পরামর্শ দিতে পারছে এবং অপরদিকে কেবল ভারতে নয়, পূর্ব পাকিস্তানেও তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যােগসূত্র ছিন্ন না করেই তারা এইসব করতে সমর্থ হয়েছে এবং পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন ১৯৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধের পর তাশখন্দের মতাে এবারও মস্কো মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের সম্ভাব্যতা দেখতে পাচ্ছে। 

ভারত-মার্কিন সদিচ্ছার ভাণ্ডার ফুরিয়ে এলেও একেবারে শূন্য হয়ে যায় নি। তবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আরেকটি যুদ্ধ যদি শুরু হয় তবে ভারতীয়দের অনেকে আমেরিকাকে পরম শত্রু হিসেবে বিবেচনা করবে। এখানে বিশ্লেষকরা সবাই একমত যে আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হচ্ছে  না। তবে তাঁরা এটাও মনে করেন পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টেও যেতে পারে—এটা নির্ভর করছে পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ও বিশ্বসমাজ কতটা এগিয়ে আসে, তার ওপর। বিদেশী পর্যবেক্ষকরা উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে বলেই মনে করছেন। একদিকে ভারতের সহায়তায় বাঙালি বিদ্রোহীরা পাক আর্মির ওপর চাপ বৃদ্ধি করবে, অপরদিকে আর্মিও তাদের উৎখাত করার প্রচেষ্টা জোরদার করবে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন আমেরিকায় শ্ৰীমতী গান্ধীর লক্ষ্য হচ্ছে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে এটা বােঝানাে যে তিনি যদি পাকিস্তানকে বর্তমান নীতি পরিবর্তনে সম্মত করাতে না পারেন তবে যুদ্ধ পরিহার করা হয়তাে সম্ভব হবে না। ওয়াশিংটনে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ও টেলিভিশনে ভাষণ দানের সুবাদে ৫৩ বৎসর বয়েসী প্রধানমন্ত্রী মার্কিন জনমতকে সংগঠিত করে প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টিরও প্রয়াস। নেবেন। কয়েক মাস আগে এখানকার এক ইউরােপীয় কূটনীতিক মন্তব্য করেছিলেন, ‘পাকিস্তান জলে নিমজ্জমান কুকুর। তার মাথা চেপে আর ডুবিয়ে দেওয়ার দরকার নেই ভারতের। তবে পাকিস্তান ভারতের প্রতি সজোরে ঘেউ ঘেউ করছে ঠিকই, অনেক পর্যবেক্ষক। মনে করেন, হুমকি বােধ করলে ভারতও ধাক্কা লাগাবার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।  

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ