You dont have javascript enabled! Please enable it!

আজ বিপুল সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য এখান থেকে নিকটবর্তী পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের দিকে এগিয়ে গেছে এবং তাদের অফিসারদের মতে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে। সীমান্ত থেকে ছয় মাইল দূরের এই শহর দিয়ে সৈন্যরা এগিয়ে গেছে কামান, জলচর যান এবং খাদ্য ও গােলাগুলির পূর্ণ সরবরাহ নিয়ে। ভারতীয় অফিসাররা জানাচ্ছেন যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্বপাকিস্তানের এই সেক্টরে খুব একটা শক্ত প্রতিরােধ দাঁড় করাচ্ছে না। সেক্টরটি হলাে বয়রা সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে ২০ মাইল দূরের যশাের শহর-কেন্দ্রিক বিশাল এলাকা। বর্তমান সংবাদদাতাকে ছয় মাইল উত্তরে বয়রার দিকে এগােতে দেওয়া হয় নি। তাই ভারতীয় সৈন্য আসলেই পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে কি না সেটা প্রত্যক্ষ করা যায় নি। তবে এখানে বয়রার অভিযান-সূচনা কেন্দ্রে যেসব অফিসার রয়েছেন, তাঁদের কেউ প্রমাণাদি গােপন করার চেষ্টা করেন নি যে বাঙালি বিদ্রোহীদেরসূচিত আক্রমণাভিযানের সমর্থনে-নামা ভারতীয় সৈন্যরা সীমান্ত পার হয়ে অ্যাকশন চালাচ্ছেন। জোরদার মনােবল একজন অফিসার বললেন, ‘এগিয়ে যাওয়ার জন্য এক মাস ধরে অপেক্ষায় আছে আমার লােকেরা। তাঁদের মনােবল খুব জোরদার।’ অন্যান্য বিদেশী সংবাদদাতা জানিয়েছেন যে, তাঁরা বনগাঁর কয়েক মাইল দক্ষিণের রাস্তায় সেনাবাহী জলচর যানসহ সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্রের বিশাল বহরকে সীমান্তের দিকে এগিয়ে যেতে দেখেছেন। এদিকে নয়াদিল্লিতে প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা  সংসদে উল্লসিত সদস্যদের অবহিত করেছেন যে, গতকাল ভারতীয় ন্যাট জঙ্গি বিমানগুলাে তিন-চারটি পাকিস্তানি বিমান ভূপাতিত করেছে। গতকাল বিকেলে বয়রার কাছে এই পাকিস্তানি প্লেনগুলাে ভারতীয় আকাশসীমায় প্রবেশ করেছিল। কর্মকর্তারা আরাে জানিয়েছেন যে বিধ্বস্ত বিমানের তিনজন পাকিস্তানি পাইলটের মধ্যে দু’জন ধরা পড়েছে। তবে রাওয়ালপিন্ডিতে একজন পাকিস্তানি মুখপাত্র জানিয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানের সীমানায় সঙ্গটিত আকাশ-যুদ্ধে উভয় পক্ষের দু’টি করে বিমান ঘায়েল হয়েছে।

বয়রায় যেসব সামরিক যান সীমান্তের দিকে যাচ্ছে তার সবগুলাে ক্যামােফ্লেজ করা এবং পাগড়ি-বাঁধা বহু শিখসহ সব সৈন্যই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও গােলাবারুদ সমেত পুরাে যুদ্ধসাজে রয়েছে। যানবাহনের অধিকাংশই সেনাবাহিনীর অধিকৃত বেসরকারি ট্রাক। তাতে বহন করা হচ্ছে সেতুর সাজসরঞ্জাম থেকে শুরু করে কম্যান্ড পােস্টের আসবাব পর্যন্ত, বড়ােসড়াে যুদ্ধাভিযানের জন্য প্রয়ােজনীয় সবকিছু। ভারতীয়রা জলচর যানও নিয়ে যাচ্ছে এবং দৃশ্যত কিছু ট্যাঙ্কও।  এখানে সদ্য স্থাপিত ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের কাছাকাছি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে এই সংবাদদাতা দুই ঘণ্টারও কম সময়ে শত শত ভারতীয় নিয়মিত সৈনিককে ট্রাকবহরে সীমান্তের দিকে এগিয়ে যেতে দেখেছেন। ট্যাঙ্কবাহী একটি ফাঁকা যান সীমান্তের দিক থেকে ফিরে এলাে। দূরে ভারি কামানের গােলা নিক্ষেপের শব্দ ভেসে আসছে। এই সংবাদদাতা ফিরে আসার সময়েও সেনাবহরের যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। যে ভারতীয় সেনাদল পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে পড়ছে তাদের সংখ্যা তাই নিশ্চিতভাবেই কয়েক সহস্র হবে।  আজ অধিক রাতে বিশ্বস্ত সূত্রে কলকাতায় যেসব খবর পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, ভারতের দু’টি পদাতিক ব্রিগেড ও একটি আর্মার্ড রেজিমেন্ট যশাের জেলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। যশােরে পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রণাধীন বিমানবন্দর কামানের গােলার আওতায় এসে গেছে। এই রিপাের্ট অনুয়ায়ী ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর সবচেয়ে ব্যাপক আক্রমণ ঘটেছে। যশাের, রংপুর, সিলেট, কুমিল্লা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায়। বাগদায় ভারতীয় অফিসাররা জানিয়েছেন যে, অভিযানের সুবিধার্থ পূর্ব পাকিস্তানকে পাঁচটি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে এবং তাঁরা অনুমান করেন অন্যান্য সেক্টরেও যশােরের মতাে অভিযান ভালােভাবে এগিয়ে চলছে। একজন অফিসার জানালেন, তিনি মনে করেন, যশােরের অভিযান এক সপ্তাহের মধ্যে সমাপ্ত হবে। 

ভারত যে পূর্ব পাকিস্তানে পুরােদস্তুর আক্রমণ-অভিযান শুরু করেছে, পাকিস্তানের এই অভিযােগ ভারত শুধু অস্বীকারই করছে না, তাদের সৈন্যরা যে সীমান্ত অতিক্রম করেছে এটাও তারা মেনে নিচ্ছে না। সরকার এখনাে বলে চলেছে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যে জোর লড়াই চলছে তা একান্তভাবে পাকিস্তান আর্মি ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে ঘটছে। নির্ভরযােগ্য রিপাের্ট থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় মুক্তিবাহিনী লড়াইয়ের সঙ্গে ব্যাপকভাবে   যুক্ত, তবে দৃশ্যমান প্রমাণাদি এই ইঙ্গিতও দেয় ভারতের ভূমিকা মুখ্য না হলেও ব্যাপক তাে বটেই। ভারত নয়টি পদাতিক ডিভিশন ও দুইটি ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট নিয়ে আক্রমণ রচনা করেছে বলে পাকিস্তান যে অভিযােগ করেছে, এখানকার অধিকাংশ বিদেশী কূটনীতিক ও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক তাকে অবশ্য অতিরঞ্জিত বলে নাকচ করে দিয়েছেন। ভারত ‘অঘােষিত যুদ্ধ শুরু করেছে বলে জাতিসংঘে পাকিস্তান যে অভিযােগ করেছে আজ পার্লামেন্টে ভারত সরকার তা অস্বীকার করেছে।  প্রতিরক্ষা শিল্প সংক্রান্ত মন্ত্রী ভি.সি.শুক্লা বলেছেন, এমনটা বলার অর্থ পাকিস্তানের প্রচারণার ফাঁদে পড়া এবং বাংলাদেশ সম্মাতের আন্তর্জাতিকীকরণ প্রয়াস ও জাতিসংঘকে জড়িত করার প্রচেষ্টার শিকার হওয়া আজ বিকেলে বাগদায় আর্মি হেডকোয়ার্টারের কম্পাউন্ডে ব্যস্তসমস্ত সংবাদবাহকদের আনাগােনা লক্ষ্য করা গেল। কম্পাউন্ড থেকে বের হয়ে সীমান্তের দিকে এগিয়ে গেল। রিকয়েললেস বন্দুক-বসানাে তিনটি জিপ। জিপে আসীন পােড়খাওয়া শিখ সৈনিকরা, গাড়ির বহরের ধুলাে থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁদের মুখে পাগড়ির খুট প্যাচানাে রয়েছে। সীমান্তের দিক থেকে ফিরে এলাে এক-ইঞ্জিনবিশিষ্ট ভারতীয় পরিদর্শক বিমান। স্কুল ভবনের বারান্দায় বসে আছেন চিকিৎসাদলের সদস্যবৃন্দ, অপেক্ষা করছেন আহতদের আগমনের। এখানকার সংঘর্ষে হতাহতের সংখ্যা বিশেষ কম এবং অন্তত বাগদাতেও এর বিপরীত কোনাে লক্ষণ দৃষ্টিগােচর হয় নি। সীমান্ত এলাকায় আজ সারাদিনের ঘােরাঘুরি করেও বর্তমান সংবাদদাতা দেখতে পান নি কোনাে বি.এস.এফ সদস্যের—এই আধাসামরিক বাহিনীই বরাবর সীমান্ত পাহারা দিয়ে থাকে। সৈন্যদের সকলেই নিয়মিত বাহিনীর লােক।

বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর কাউকেও এই অঞ্চলে দেখা যায় নি। ভারতীয় সৈন্যদের বেশিরভাগই কোনাে বিদেশীর সঙ্গে কথা বলতে অনিচ্ছুক। তবে গাড়িতে সীমান্তের দিকে যাওয়ার সময় তাঁদেরকে বেশ প্রত্যয়ী মনে হলাে, এমনকি কিছুটা উত্যও। সীমান্তের নাজুক এলাকাগুলােতে বিদেশী সাংবাদিকদের গমন নিষিদ্ধ করে কয়েক সপ্তাহ আগে জারিকৃত ঘােষণা বহাল থাকলেও সৈন্য চলাচলের এই ডামাডােলের ভেতর নির্বিঘ্নে সেনা তৎপরতার ঘনিষ্ঠ অবলােকন সম্ভব হয়েছিল। এই সংবাদদাতা প্রথম থামেন বাগদা থেকে ১৫ মাইল দক্ষিণে ভারতের পেট্রাপােল সীমান্তের কাছে সৈন্যদের অবস্থানে। এখানে গভীর বাঙ্কার খুড়ে যে ভারতীয় সৈন্যরা অবস্থান নিয়েছিল তারা জানালে মুখােমুখি অর্ধবৃত্তাকারে রয়েছে প্রায় ২০০ পাকিস্তানি সৈন্য এবং যশাের অভিমুখী সড়কের প্রথম অংশটুকু তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে।  তখন বেলা একটার সময় অবস্থানটি বেশ নীরব, মাঝেমধ্যে কেবল একজন পাকিস্তানি রাইফেলধারীর গুলির শব্দ শােনা যাচ্ছিল। অফিসাররা অতিথিদের কমলার রস দিয়ে আপ্যায়িত করলেন এবং এখানকার পরিস্থিতি কি রকম শান্ত সে-বিষয়ে কথাবার্তা বললেন। তাঁরা বললেন যে, যশাের জেলার অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর একটি অভিযান সম্পর্কে তাঁরা শুনেছেন তবে এই এলাকায় তার কোনাে জের উপচে পড়ে নি। আরাে জানালেন যে, লড়াইয়ের সঙ্গে কোনাে ভারতীয় সৈন্য জড়িত নয়। তাঁদের কথাবার্তার সময় অনেক দূর থেকে ভেসে আসা ভারি গােলার গুডুম গুডুম শব্দ   শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। ওখান থেকে বিদায় নিয়ে আমরা আরাে কয়েক মাইল যাওয়ার পর বিপরীত দিক থেকে আসতে দেখি ১২টি ট্রাকের এক বহর। প্রত্যেক ট্রাকের ওপর রয়েছে একটি করে ১৩৫ মি. মি. কামান। বহরটি যাচ্ছে পেট্রাপােলের দিকে।

তিন ঘণ্টা পর বিকেল পাঁচটার দিকে কলকাতা ফিরে আসার সময় সফরকারীরা শুনতে পান পেট্রাপােলের দিক থেকে ভেসে আসা ভারি কামানের থেকে থেকে গােলাবর্ষণের শব্দ। কখনাে কখনাে পরপর পাঁচ-ছয়টি গােলাবর্ষণের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। স্থানীয় লােকজনদের অনেকে বললেন, তাঁরা অনুমান করছেন সম্মুখস্থ পাকিস্তানি কম্পানিকে অবস্থানচ্যুত করে ট্রাক ও ট্যাঙ্কের চলাচলের জন্য যশাের রােড খুলে দিতে ভারতীয় সৈন্যরা গােলাবর্ষণ করছে। বর্তমান সংবাদদাতা পুনরায় পেট্রাপােল ফিরে যাবার চেষ্টা নিলে এবার স্থানীয় পুলিশ পথরােধ করে। তারা জানায় যে এটি নিষিদ্ধ এলাকা। জোর সামরিক তৎপরতা ও সীমান্তের কাছ থেকে যুদ্ধের গােলাগুলির শব্দ সত্ত্বেও সর্বত্রই ভারতীয় গ্রামবাসীদের অবিচলিত মনে হচ্ছে। কখনাে হয়তাে-বা গ্রামের চাষী দাঁড়িয়ে পড়ে তাকিয়ে দেখে ট্যাঙ্কবাহী অতিকায় যান, তবে এটা বিশেষ ব্যতিক্রম। যে-রাস্তা দিয়ে সেনাদল যাচ্ছে তার পাশের খালের জলে ছেলেরা সাঁতার কাটছে। মেয়েরা শাড়িকাপড় ধুচ্ছে এবং পুরুষেরা রৌদে শুকোবার জন্য মেলে দিচ্ছে রুপােলি পাট।  

 

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!