ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এখন সীমান্ত জুড়ে মুখােমুখি অবস্থানে। এখানকার অনেক পশ্চিমী কূটনীতিক এমন ভাবনার পক্ষপাতী যে, অন্তত পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে প্রথম সৈন্য মােতায়েন করেছে পাকিস্তানিরা এবং ভারত পরবর্তী পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে। ভারতীয় পদস্থ মহল থেকে জানা যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানে গত মাস থেকে সামরিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে এবং গত বৃহস্পতিবারের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের সকল পদাতিক ও সাঁজোয়া বহর সীমান্তে অথবা সীমান্তে আঘাত হানা-সক্ষম দূরত্বের মধ্যে মােতায়েন হয়ে গেছে। সূত্র জানায়, প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সীমান্ত এলাকার কোনাে কোনাে খাল প্লাবিত করে দেয়া হয়েছে এবং কয়েকটি সীমান্ত অঞ্চল থেকে বেসামরিক পাকিস্তানি নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এদের কেউ কেউ সেনাবাহিনীর নির্দেশেসরে গেছে, অন্যরা ভয়ে পালিয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি সৈন্য সমাবেশ ঘটেছে সেইসব স্থানে, যেখান দিয়ে ১৯৬৫ সালের তিন সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা ভারতে প্রবেশ করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানে, যেখানে চার বা পাঁচ ডিভিশন সৈন্য রয়েছে বলে ধারণা করা হয়, সেখানকার সীমান্তেও শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে। ভারতীয়রাও সীমান্তে চার-পাঁচ ডিভিশন সৈন্য মােতায়েন করেছে বলে জানা যায়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান অভিযোেগ করেছেন যে, সীমান্তে ভারত আটডিভিশন সৈন্য মােতায়েন করেছে। অধিকন্তু পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতাকামী বাঙালি গেরিলা যােদ্ধাদের ক্রমবর্ধমান হামলার মােকাবেলা করতে হচ্ছে পাকবাহিনীকে। এই গেরিলারা ভারতের কাছ থেকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও নিরাপদ আশ্রয় পাচ্ছে। এক হিসেবে জানা যায়, মার্চ মাসে বিচ্ছিন্নতাবাদী বাঙালি আন্দোলন দমাবার জন্য পাকবাহিনীর অভিযান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত সাড়ে নয় মিলিয়ন পূর্ব পাকিস্তানি ভারতে চলে এসেছে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজার মাইল দূরে পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে ভারতের ১২ থেকে ১৩ ডিভিশন সৈন্য রয়েছে বলে মনে করা হয়। এখানে নয়াদিল্লিতে কোনাে যুদ্ধ উন্মাদনা অথবা শঙ্কা নেই। শুধু কিছু কিছু পরিবার চলে এসেছে সীমান্ত-শহর থেকে, যেখানে নিষ্প্রদীপ ও বেসামরিক প্রতিরক্ষা মহড়া শুরু হয়েছে।
ভারতীয় মহল সীমান্তের সৈন্যসংখ্যা না জানিয়ে শুধু বলেছে, সেখানে আমরা তাদের চেয়ে শক্তিশালী।’ এই উৎস আরাে জানায়, সীমান্তে ভারতীয় মােতায়েন প্রায়-সম্পন্ন অথবা সম্পন্ন হয়েছে।’ গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী এক অফিসার বললেন, “আমরা এখন তৈরি অবস্থায় রয়েছি।’ আরেক ভারতীয় উৎস জানালেন, ১৪ অক্টোবর রাত আমাদের খুব ভয়ে কেটেছে, সেদিন খবর পাওয়া গিয়েছিল যে আজ রাতে পাকিস্তান পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণ শুরু করতে পারে। জেনারেল স্টাফ সারারাত জেগে কাটান। খবরটি পাকিস্তানের উদ্দেশ্যপ্রণােদিত প্রচার হতে পারে অথবা এমন হতে পারে শেষ মুহূর্তে পাকিস্তান তাদের। পরিকল্পনা বদল করেছে। ভারতীয় উৎস ইঙ্গিত দিয়েছে যে, ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় গােলাবর্ষণ, মাইনপোঁতা ইত্যাদি পাকিস্তানি ‘হুমকি’র বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা সরকার ভাবছে। এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছি, পক্ষান্তরে দৃঢ় পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের ওপরও জোরদার চাপ রয়েছে।’ পাল্টা ব্যবস্থা বলতে পাকিস্তানি সৈন্যদের ধাওয়া করে সীমান্তের অপর পারে চলে যাওয়া এবং এর ফলে পুরাে মাত্রায় সংঘর্ষ শুরু বােঝাবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “তেমন ঘটলে পরিণতির জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’ আজ সকালে জনাকীর্ণ এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি সংযত থাকার জন্য তাঁর আহ্বান সম্পর্কে জিগ্যেস করা হয়। তিনি বলেন, পাকিস্তান তার সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে এটা বেশ সুন্দর ও মিষ্টি বচন। কিন্তু সীমান্ত জুড়ে সৈন্য সমাবেশ, ভারত-বিদ্বেষী প্রচারণা, পবিত্র যুদ্ধ-জেহাদের ডাক ইত্যাদির মধ্য দিয়ে পাকিস্তানই পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। এটা একতরফা ব্যাপার নয়। মুঠো পাকানাে হাতের সঙ্গে হাত মেলানাে সম্ভব নয়।’ তিনি বলেন, “আপনারা তাে জানেনই, সবাই আমাদের সংযমের প্রশংসা করছেন। আমরা পাই মৌখিক সহানুভূতি, আর যারা সংযম দেখায় নি, তারা পায় অস্ত্র সাহায্য। পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্রের কতক ধরনের সরবাহ অব্যাহত রাখার প্রতি এটা একটা পরােক্ষ ইঙ্গিত।
সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ