You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভিয়েতকংবা যদি প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরুর ছয়মাসের মধ্যে এইরকম অবস্থায় পৌছুতে পারতাে তবে একে চমকপ্রদ সাফল্য হিসেবে গণ্য করতাে।’ বিদেশী কূটনীতিক এমনি মন্তব্য করলেন মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে, বাংলাদেশ নামকরণকৃত স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য যুদ্ধরত বিদ্রোহীরা ‘মুক্তিবাহিনী হিসেবেই পরিচিত। মার্চের শেষাশেষি বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন দমন করতে পাকবাহিনীর আক্রমণের জবাবে অসংগঠিত হতবুদ্ধি যােদ্ধা দল থেকে মুক্তিবাহিনী তেল চকচকে যুদ্ধমেশিনে না হলেও এখন পরিণত হয়েছে, অন্তত মােটামুটিভাবেসংহত ও বিশেষ কার্যকর গেরিলা শক্তিতে। অস্ত্র, প্রশিক্ষণও নিরাপদ আশ্রয় যুগিয়েছে। ভারত এবং স্পষ্টতই ভারতীয় সহায়তা ছাড়া বিদ্রোহী তৎপরতা বর্তমান স্তরে পৌছুতে পারতােনা। কিন্তু বিদ্রোহী মানুষ ওবিদ্রোহের তাগিদ এসেছে পূর্ব পাকিস্তানিদের ভেতর থেকে, তাদেরকে যদি সম্পূর্ণভাবে নিজের ওপর নির্ভর করতে হতাে তাহলেও পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি প্রতিরােধ পুরােপুরি ধ্বংস করতে পারতাে কি না সন্দেহ। আনুমানিক ৮০,০০০ পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যকে পূর্ব পাকিস্তানে মােতায়েন করা হয়েছে। এছাড়ারয়েছে কয়েক হাজার পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ। রাজাকার হিসেবে পরিচিত প্রায় ১০,০০০ বাঙালিকে দ্রুত প্রশিক্ষণ দিয়ে হােমগার্ড হিসেবে গড়ে তােলা হয়েছে।  এই বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা হবে আনুমানিক ৮০,০০০ থেকে ১০০,০০০। বিদেশী পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, কম সংখ্যাটিই বেশি যথার্থ। এদের  মধ্যে পেশাদার সৈনিকের সংখ্যা ১৫,০০০-এর বেশি হবে না, এদের অনেকেরই আবার উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেই। এঁরা হচ্ছেন সীমান্ত-প্রহরী আধা-সামরিক বাহিনী ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্স এবং উন্নততর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নিয়মিত সেনা ইউনিট ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষে দলত্যাগী সদস্য। এর বাইরে রয়েছে ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০ নতুন রিক্রুট। বেশিরভাগই কলেজের ছাত্র, বয়স ১৮ থেকে ২৫, তবে এর মধ্যে অনেকেই গ্রামের ছেলে। এদের সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

অনেক বাংলাদেশী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও ঘাঁটি এলাকা সীমান্তের ভারতীয় দিকে অবস্থিত। তবে বর্ধমান সংখ্যায় সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের ঠিক ভেতরে ‘মুক্ত এলাকা থেকে অপারেশন পরিচালনা করছে। এইসব এলাকা খুব বড় না হলেও ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে।  নতুন রিক্রুটদের কাউকে কাউকে নিয়মিত সৈনিকের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, অন্যদের গেরিলা প্রশিক্ষণ। গেরিলারা গ্রামের লােক সেজে স্থানীয় জনগােষ্ঠীর সঙ্গে মিশে থাকে। মূলত অস্ত্রের অভাবের দরুন মুক্তিবাহিনীর সদস্যভুক্তির একটা সীমা রয়েছে এবং এর বাইরে রয়েছে অজস্র স্বেচ্ছাসেবক। বিপুলসংখ্যক ছেলে যৎসামান্য প্রাথমিক প্রশিক্ষণলাভের পর এখন সময়ক্ষেপণ করে চলেছে, এদের ট্রেনিং বলতে শারীরিক ব্যায়াম ও গাড়ি চালানাে শেখা এটুকুকেই বােঝায়। | মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র হচ্ছে নানা কিছুর মিশেল। স্টেনগান, হালকা মেশিনগান ও অন্যান্য ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রয়েছে, রয়েছে বেশকিছু পুরনাে সিঙ্গল-শট রাইফেল। সবচেয়ে ভারি অস্ত্র হচ্ছে হালকা ও মাঝারি ধরনের মর্টার, তবে এর সংখ্যা বেশি নয়। এইসব অস্ত্র বিভিন্ন নির্মাতা ও বিভিন্ন সময়ের। কতক অস্ত্র পাকিস্তানিদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া, আর কতক—বাঙালিদের অভিযােগ, মােটেই যথেষ্ট পরিমাণে নয়—দিয়েছে ভারত। এতসব সমস্যা সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান আর্মিকে কার্যকরভাবে উত্যক্ত করে চলছে, কোনাে কোনাে অঞ্চলে তাদের ব্যতিব্যস্ত করে আটকে রাখছে এবং গােটা পূর্ব। পাকিস্তানে তাদের ছড়িয়ে থাকতে বাধ্য করছে। বিশ্বস্ত সূত্রে ইঙ্গিত মেলে যে, পাকিস্তানিদের মধ্যে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। অধিকৃত এলাকায় প্রশাসন চালানাে এবং অন্যান্য কর্মে অবাঙালি ও অপরাপর দালালদের নিয়ে গঠিত পাকবাহিনীর সহযােগী স্থানীয় ‘শান্তি কমিটি’র সদস্যদের হত্যা করা গেরিলারা অব্যাহত রেখেছে। গেরিলাদের মধ্যে হতাহতের সংখ্যা পাওয়া যায় নি, তবে এই সংখ্যা কম বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু প্রতিটি গেরিলা হামলার পর পাকবাহিনী প্রতিশােধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বসতি জ্বালিয়ে দেয়, গ্রামবাসীদের হত্যা করে।

গেরিলাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে রাস্তা, রেললাইন, সেতু উড়িয়ে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের যোেগাযােগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে সেনাবাহিনীর সচলতা ক্ষুন্ন করা। গেরিলা নৌকম্যান্ডােরা ইতিমধ্যে অন্তত এক ডজন সমুদ্রগামী জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত অথবা নিমজ্জিত করেছে। এর মধ্যে বন্দরে নােঙর-করা কয়েকটি বিদেশী জাহাজও রয়েছে। সাতটি বৃটিশ শিপিং লাইন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে জাহাজ যােগাযােগ স্থগিত করেছে। ছয় মাস আগে যে অবস্থায় ছিল মুক্তিবাহিনী এখন তার চেয়ে অনেক সুসংগঠিত হলেও  এটা এককাট্টা লড়িয়ে শক্তি নয়। পিকিংপন্থী কমিউনিস্টসহ বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন গ্রুপ তাদের নিজস্ব অপারেশন শুরু করেছে। ঢাকার এক অকমিউনিস্ট জঙ্গি ছাত্রনেতার পরিচালনাধীন ১৫০০ সদস্যের একটি গােষ্ঠী ভারতীয় সীমান্তরাজ্য ত্রিপুরায় তাঁদের ঘাঁটি স্থাপন করেছে। তবে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ আন্দোলন কিংবা বামঘেঁষা আন্দোলনের মধ্যে কোনাে গুরুতর বিভক্তির লক্ষণ দেখা যায় নি। | বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টিপাতের শেষে এখন মনে করা হচ্ছে যে, মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনী উভয়েই পূর্ব পাকিস্তানে তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করবে। কড়া প্রহরায় সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে মালবাহী ট্রেন কলকাতা এসে পৌঁছেছে। জানা যায়, এসব হচ্ছে মুক্তিবাহিনীর জন্য সামরিক সরবরাহ। এর থেকে ইঙ্গিত মেলে যে গেরিলাদের জন্য সামরিক সহায়তা বৃদ্ধি করতে ভারত সরকার সম্মত হয়েছে। তবে মুক্তিবাহিনীর কম্যান্ডাররা চাচ্ছেন আরাে বেশি কিছু—পূর্ব পাকিস্তানের ভূমির কিয়দংশ দখলের জন্য সম্মুখযুদ্ধ পরিচালনায় তাঁরা ভারতীয় লজিস্টিক ও এয়ার কভার পেতে চান। বর্তমানে কলকাতাস্থিত বাংলাদেশ সরকারকে তাহলে এখানে প্রতিষ্ঠা করা যাবে। এখন পর্যন্ত ভারতীয়রা এই প্রস্তাবে অরাজি রয়েছে, কেননা, তারা মনে করেন, এর ফলে তৎক্ষণাৎ পাকিস্তানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। বাংলাদেশের নেতারা যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, গেরিলা যুদ্ধের সকল কার্যকারিতা সত্ত্বেও আঘাত করাে ও পালাও নীতির বদলা হিসেবে পাকিস্তানিরা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর যে আক্রমণ চালাচ্ছে তার পরিণামে স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে জনসমর্থনে ভাটা দেখা দিতে পারে। | একজন পদস্থ বাঙালি অফিসার জানালেন, অনেক গ্রামবাসীর সমর্থন আমরা হারাবাে। তারা আমাদের বলে, আমাদের সমর্থন পেতে হলে পূর্ণ শক্তি নিয়ে আসুন, আমাদের সঙ্গে থাকুন, সবাইকে রক্ষা করুন।’ 

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!