কড়া নিরাপত্তা প্রহরায় সামরিক সরঞ্জাম বহনকারী বেশ কটি বিশেষ ট্রেন এখন প্রতিদিন এখানে এসে পৌছুচ্ছে। নির্ভরযােগ্য সূত্রে প্রকাশ, এইসব অস্ত্র আসছে বাঙালি গেরিলাদের জন্য, যারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে। এবং প্রতীয়মান হচ্ছে পাক আর্মির বিরুদ্ধে তৎপরতা বৃদ্ধির জন্য তাঁরা এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে। | গেরিলাদের দিক দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে তাঁদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনে ভারত কতদূর পর্যন্ত এগােবে। এযাবৎ ভারতীয়রা নিরাপদ আশ্রয়, প্রশিক্ষণ ও কিছু পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র যুগিয়ে চলেছে। ছয় মাস বয়েসী স্বাধীনতা সংগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কলকাতায় যাঁদের ঘাঁটি, অভিযােগ করছেন যে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্তসবাইকে হাতিয়ার যােগানাের মতাে যথেষ্ট অস্ত্র ভারত তাঁদের দিচ্ছে না। অধিকন্তু ভারত, মূলত তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র সােভিয়েত ইউনিয়নের পরামর্শে, বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় নি। এই সংযত থাকার পেছনে মূল ভাবনা যেটা কাজ করেছে তা হলাে স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। কঠোর প্রহরায় মালবাহী ট্রেনের কলকাতা আগমন-প্রবাহ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ভারত গেরিলাদের আরাে অস্ত্র যােগাতে সম্মত হয়েছে। তবে তার অর্থ এই নয় যে ভারত দিতে প্রস্তুত হয়েছে গেরিলারা আসলে যা চাচ্ছে—সম্মুখযুদ্ধ করে উল্লেখযোেগ্য পরিমাণ ভূমি দখলের চেষ্টায় ভারতের গােলা, অস্ত্র ও বিমান সমর্থন। ভারতীয় সৈন্যরা এমনি অভিযানেসংশ্লিষ্ট না হলেও পাকিস্তানিরা একে যুদ্ধ ঘােষণার শামিল বলেই বিবেচনা করবে। বিভক্ত পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় সীমান্তেই ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মধ্যে সন্দেহের মাত্রা বেড়ে চলেছে। নির্ভরযােগ্য সূত্রের সংবাদে জানা যায় বরাবরকার উত্তেজনাপ্রবণ সীমান্ত এলাকায় উভয় পক্ষই শক্তি জোরদার করছে। বর্তমান সংবাদদাতা পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতীয় সৈন্য চলাচল দেখতে পেয়েছে। পেট্রাপােলের একটি সীমান্ত কেন্দ্রে ভারতীয় সৈন্যরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে ব্যবহারযােগ্য রিকয়েললেস রাইফেল নিয়ে।
আরেকটি ভারত-পাক যুদ্ধের সম্ভাব্যতা নিয়ে নানা গুজব রয়েছে। তবে এমন কোনাে প্রমাণ নেই যে তা অত্যাসন্ন। সৈন্য চলাচলের ব্যাপারটা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অংশও হতে পারে। সাম্প্রতিককালে ভারতের সংবাদমাধ্যম জুড়ে রয়েছে পাকিস্তানের সামরিক প্রস্তুতি, কতক সীমান্ত থেকে বেসামরিক নাগরিকদের স্থানান্তর এবং যুদ্ধোন্মাদনা ও ভারত-বিদ্বেষী প্রচারণা সংক্রান্ত রিপোের্ট। একইরকমভাবে পাকিস্তানি পত্র-পত্রিকা ভরে আছে ভারতের যুদ্ধসাজ ও সীমান্তে গােলাবর্ষণের মতাে উস্কানিমূলক তৎপরতার সংবাদ। উপরন্তু বাঙালি শরণার্থীদের শিবিরগুলাের চারপাশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছে পাকিস্তানি এজেন্টরা এইসব শিবিরে অনুপ্রবেশ করেছে। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্টঅব ইন্ডিয়া জানিয়েছে যে, পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত রাজ্য আসামের তেল শশাধনাগার ও ভাণ্ডার এলাকায় নিষ্প্রদীপ ব্যবস্থা ও অন্যান্য বিমান হামলা প্রতিরােধক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। এই সমস্ত টুকরাে টুকরাে সংবাদ মিলে কোনাে পূর্ণাঙ্গ ছবি ফুটে না উঠলেও এটা বেশ বােঝা যায় মেীসুমি বৃষ্টি ও বন্যা সবে সমাপ্ত হওয়ার পর পাক আর্মি ও বাঙালি গেরিলা উভয় পক্ষই তাদের তৎপরতা জোরদার করতে যাচ্ছে। আর ভারতের দিকে শরণার্থী সমস্যাজনিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ বেড়েই চলেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের মতে ৯ মিলিয়নের বেশি শরণার্থী সীমান্ত অতিক্রম করেছে এবংঅব্যাহতভাবে প্রতিদিন আসছে প্রায় ৩০,০০০ উদ্বাস্তু। পাকিস্তানিদের হিসেবে অবশ্য এই সংখ্যা অনেক কম। বিদেশী কূটনীতিকদের প্রশ্ন হলাে এর শেষ কোথায়, কোন পর্যায়ে গিয়ে ভারত সিদ্ধান্ত নেবে যে এর চাপ এতাে বেশি যে শরণার্থী আগমন ঠেকাতে তাকে প্রত্যক্ষ সামরিক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। এ-দুই দেশের সরকার যাই করুক না কেন, এখানে প্রাপ্ত খবরে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে গেরিলারা শিগগিরই তাঁদের আক্রমণ জোরদার করতে চলেছে। ইতিমধ্যেই তাঁরা কতক শক্ত আঘাত হেনেছে। প্রধান রেল যােগাযােগ ও মূল মূল সড়ক তাঁরা বিচ্ছিন্ন করেছে এবং এখনও চালু হতে দিচ্ছে না।
উড়িয়ে দিয়েছে অসংখ্য সেতু এবং লাগাতার আঘাত করে চলেছে গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রগুলােতে। আগস্টের পর থেকে গেরিলা ফ্রগম্যানরা পূর্ব পাকিস্তানের বন্দরে নােঙরকরা জাহাজ আক্রমণ করতে শুরু করেছে। এর ফলে বৃটিশ জাহাজগুলাে পূর্ব পাকিস্তানের বন্দরে মাল খালাস করা বন্ধ করে দিয়েছে। গেরিলারা বড় রকম সাফল্য দাবি করছে গেরিলারা দাবি করছে তাঁরা এ-যাবৎ ২০ থেতে ৩০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য হত্যা করেছে। এই দাবি অতিরঞ্জিত মনে হলেও পাকিস্তানিদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখযােগ্য বলেই মনে হয়। গেরিলাদের হতাহতের কোনাে হিসেব পাওয়া যায় নি। পূর্ব পাকিস্তানে আনুমানিক প্রায় ৮০,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য রয়েছে। এছাড়া আছে। আরাে ১০,০০০ দ্রুত প্রশিক্ষণ দেওয়া অবাঙালি আধা-সামরিক বাহিনী। গেরিলাদের সংখ্যা হবে ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০-এর মধ্যে। মার্চ মাসে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ শুরুর পর এদের বেশির ভাগ প্রশিক্ষণ নিয়েছে। পেশাদার সৈনিকদের ভরকেন্দ্রটি গঠিত হয়েছে ১৫,০০০ সদস্য সমবায়ে, যাঁরা আধাসামরিক সীমান্তরক্ষী দল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং নিয়মিত সেনা ইউনিট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পরিত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছেন। গেরিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ঘাঁটি এলাকাগুলাের বেশির ভাগই সীমান্তের ভারতীয় দিকে অবস্থিত। তবে ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় বাঙালিরা সীমান্ত সংলগ্ন পূর্ব পাকিস্তান ভূখণ্ড থেকে তৎপরতা পরিচালনা করছে। | নতুন রিক্রুটদের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে গেরিলা ও নিয়মিত সৈনিক হিসেবে। একজন পদস্থ কর্মকর্তা আমাকে জানালেন, “আমাদের উভয় ধরনের যােদ্ধাই দরকার। কেননা গেরিলারা পারে কেবল আঘাত করে শত্রুকে দুর্বল ও নরম করে ফেলতে। আমাদের এমন এক বাহিনী প্রয়ােজন যারা ভূখণ্ড অধিকার করে রাখতে পারে।’
সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ