You dont have javascript enabled! Please enable it!

ন্ধকার মাটির ঘর থেকে সন্তর্পণে বেরিয়ে এলাে বয়স্করা। কিন্তু শিশুরা, যুদ্ধের মােড় ফেরার কারণে যারা সহজে ফিরে পেয়েছে আগের প্রাণ, দলে দলে ছুটে এলাে তাজ্জব বিদেশী অতিথিদের দেখতে, হাসিমুখে কলকলিয়ে উঠতে। কেউ কেউ সাগ্রহে হাতে তুলে নিল সবুজ-রঙা আইসক্রিম, নিয়ে এসেছিলেন সদানন্দ বাবুর স্থানীয় এক সংস্করণ, ইছামতি নদী ধরে। এক মাইল দূরে ভারত সীমান্ত থেকে যিনি নৌকাযােগে এসেছিলেন। শিশুরা সবকিছু স্বাভাবিক করে তুলছে, কিন্তু পাটখালি হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের একটি অস্বাভাবিক গ্রাম। নিরাপদ অঞ্চলে চলে যাওয়া পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ধূলিসাৎ করার জন্য মার্চ মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী আক্রমণাভিযানকরে। পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী এই গ্রামে এসে সন্ত্রস্ত করে তুলে মানুষজনকে ধান ও পাটের আবাদ হ্রাস করতে বাধ্য করে। কেটে ফেলতে হুকুম করে কলা ও আমের গাছ, যেন বিদ্রোহী বাঙালি গেরিলারা আক্রমণ রচনার জন্যে কোনাে আড়াল খুজে না পায়। বহু ঘরবাড়ি সৈন্যরা ভেঙে ফেলে, পুড়িয়ে দেয়। কিন্তু গ্রামে তারা কাউকে হত্যা করে নি। তাহলেও এই সংযম কদিন বজায় থাকে সে-বিষয়ে গ্রামবাসীরা ভীত ছিল এবং তাঁদের বেশির ভাগই ইছামতি পার হয়ে ভারতে চলে যায়। তিন মাস পর জুলাইয়ের শুরুর দিকে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী নিজেদের পুনঃসংগঠিত করে এলাকায় ফিরে আসে। বহুদূর অবধি ছড়িয়ে পড়ার কারণে হালকা হয়ে আসা পাকবাহিনীকে তাঁরা ক্রমাগত হয়রানি করে চলে এবং নিরাপদ এলাকায়  চলে যেতে বাধ্য করে। গ্রামবাসীরা ফিরে আসতে শুরু করে প্রথমে ধীরে ধীরে, পরে সদলবলে এবং গ্রামের লােকসংখ্যা দাঁড়ায় ১৪০০-তে, প্রায় স্বাভাবিক সময়ের সমান। ফেরে নি কেবল হিন্দুরা, মুসলিম পাকবাহিনীর আক্রমণের যাঁরা বিশেষ লক্ষ্য। গ্রামের একটি হিন্দু পরিবারও ভারত থেকে ফিরে আসে নি, এবং তাঁরা ফিরবে বলেও গ্রামবাসীরা মনে করে না। | পাটখালি হচ্ছে কতিপয় ‘মুক্ত এলাকার একটি, ভারত সংলগ্ন এবং প্রায় সম্পূর্ণ ভারতবেষ্টিত পূর্ব পাকিস্তানের এই ভূখণ্ড।

বাংলাদেশ বাহিনীর কমান্ডার জানান যে, যশাের জেলাস্থ এই মুক্ত এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গমাইল এবং খুলনা জেলার এমনি। আরেক ভূখণ্ডের সঙ্গে এটা যুক্ত, যার আয়তন ২০০ বর্গমাইল। উভয় ভূখণ্ড মিলিয়ে এখানে। প্রায় ১,৫০,০০০ লােকের বসবাস। সঠিক হিসেব লভ্য না হলেও ওয়াকেবহাল মহলের অনুমান সবগুলাে মুক্তাঞ্চল মিলিয়ে আয়তন দাঁড়াবে প্রায় ১০০০ বর্গমাইল। এটা যথেষ্ট বড় সংখ্যা মনে হতে পারে যদি না আমরা খেয়াল রাখি যে পূর্ব পাকিস্তানের মােট আয়তন হচ্ছে ৫৫,০০০ বর্গমাইল। গেরিলারা তাঁদের নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে প্রসারিত করে চলেছে ঠিকই কিন্তু ‘মুক্তাঞ্চল অভিধাটি খুব বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠতে পারে। এর কিছু অংশ জলাভূমি, কিছুটা জঙ্গল যা আর্মি সবসময়েই অগম্য ও প্রতিরােধের প্রয়ােজনহীন বিবেচনা করেছে। কতক ক্ষেত্রে মুক্ত এলাকার অভ্যন্তরে শক্ত ঘাঁটিতে পাকিস্তানি সৈন্যরা এখনও অবস্থান করছে। ফিতের মতাে লম্বা পাটখালি থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে সিকড়ি গ্রামে পাকবাহিনীর একটি দল রয়েছে। এই আর্মি বাংকারে গেরিলারা অনবরত নজরদারি ও হামলা চালিয়ে আসছে। বিদেশী অভ্যাগতদের আসার আগে গতরাতেও এমনি এক হামলা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা ঘাঁটি ছাড়ছে না। উত্তরমুখী রেললাইন ধরে বড় এক সেনাদল মাঝে মাঝে তাদের জন্য রসদ নিয়ে আসে। গেরিলাদের আওতাধীনে পাটখালির গ্রামবাসী মােটামুটি নিরাপদ বােধ করছে। ‘মুক্তিবাহিনী এখানে এসেছে, তাই আমরাও এসেছি,’ আইজুদ্দিন মণ্ডল নামের একজন কৃষক বললেন, “আমরা এখন নিরাপদ। জবরদস্তিভাবে ফসল নষ্ট করে দেওয়ার ফলে এখন এক কঠিন সময় চলছে। দুর্গতি আরাে বেড়েছে সাম্প্রতিক বন্যার কারণে। কিন্তু এঁরা হচ্ছে দৃঢ়, বেঁচে থাকার প্রত্যয়দৃপ্ত মানুষ যাঁরা প্রায় প্রতি বৎসর লড়াই করছে মানব-সৃষ্ট না হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে। এবং আবারও তাঁরা নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে। ফসলের কিছুটা পাক আর্মির নজর এড়িয়ে গিয়েছিল, উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে কিছু পরিমাণ পাট, চাষীর ঘরের উঠোনের বেড়ায় এখন উচুমানের রুপােলি এই পাট শুকোতে দেওয়া হয়েছে রৌদ্রের কড়া তাপে। শুকনাে ও গাঁট বাঁধা আরাে কিছু পাট নৌকোয় তােলা হচ্ছে, ভারতে নিয়ে বিক্রির জন্য। বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যাবে, পাকিস্তানি ও ভারতীয় টাকা, তা দিয়ে কেনা হবে খাবার ও অন্যান্য দুর্লভ পণ্য, যেমন লবণ, ভােজ্যতেল, কেরােসিন, জামাকাপড় ইত্যাদি। লণ্ডভণ্ড পাটখেতে চাষীরা ধান লাগিয়েছে, বেশ বড় হয়ে উঠেছে চারাগুলাে অর্থকরী।  

ফসলের চেয়ে পেটের খিদে মেটানাের চাহিদা বড়।

ধূলিসাৎ ডিসপেনসারি

মাটির ঘরগুলাের কিছু কিছু ঠিকঠাক করা হয়েছে। হিন্দু পরিবারের ফেলে যাওয়া অন্য ঘরগুলাের ধ্বংসস্তুপ পড়ে আছে। গ্রামের একমাত্র ডিসপেনসারি ধুলােয় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগুনে পুড়ে গেছে ক্লাবঘর। প্রাইমারি বিদ্যালয়ের একতলা টানা ঘরটি অক্ষত রয়েছে কিন্তু বেঞ্চ টেবিল সব পুড়িয়ে দিয়েছে পাক আর্মি। স্কুল এখন বন্ধ। ঘরের সামনে সাঁটানাে রয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের বন্দী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। স্কুল যে চলছে গ্রামের ক্ষয়ক্ষতির সেটা সবচেয়ে হাল্কা দিক। মনের দিক দিয়ে সবচেয়ে বিপর্যস্ত হয়েছে বৃদ্ধরা। ধবধবে সফেদ দাড়ির কুঞ্চিত চর্মসার এক বৃদ্ধ তাঁর ভাঙা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অশ্রুময় চোখে বললেন, “দেখাে ওরা আমাদের কি দশা করেছে। সবকিছু ওরা ধ্বংস করেছে—গাছগাছালি পর্যন্ত। আমাদের দয়া করে সাহায্য করাে।’ এক অন্ধ রমণী অন্য বাড়ি থেকে আনা ধান ভানছিলেন টেকিতে। কাজটি খুব কষ্টসাধ্য। “এছাড়া আর কিই-বা করার আছে,’ তিনি বললেন। “পেটের খিদে মেটাতে যে দু’চার পয়সা আসে তাই সই। গেরিলারা এই এলাকার নিয়ন্ত্রণে রইলেও সরকার বলতে সাধারণভাবে যা বােঝায় তার ধারেকাছে কিছু নেই। উপ-প্রধান গেরিলা অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জামালউদ্দিন চৌধুরী, বিমানবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য, অভ্যাগতদের পাসপাের্টে ছয় ঘণ্টার ভিসা মঞ্জুরের ছাপ দেয়ার বিস্তারিত আয়ােজনরাখলেও, বােঝা যায়, এটা মূলত পত্রিকারআলােকচিত্রীদের মুখ চেয়ে করা হয়েছে। কর আদায় বন্ধ অর্থনৈতিক কারণে বেসামরিক প্রশাসনের কর আদায় কাজ হচ্ছে না এবং আইনগত বিবাদ মােকাবেলা করা হচ্ছে প্রশান্ত দৃষ্টিতে। লেফটেন্যান্ট চৌধুরী বললেন, প্রশাসনিক কাজ বলতে বােঝায় কেবল আইন-শৃঙ্খলা বলবৎরাখা। যদি জমির বিবাদ নিয়ে দুই পক্ষ এসে হাজির হয় আমাদের কাছে আমরা উভয়ের বক্তব্য শুনে সালিশির চেষ্টা করি। সহজ সরল বিচার-ব্যবস্থা আর কি!’ | স্থানীয় প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়ােজিত ১৫৮ সদস্যের কম্পানি কমান্ডার হচ্ছেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আখতার-উজ-জামান, ২৫ বছরের এই কলেজ স্নাতক অতি সম্প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমি থেকে পাশ করে বের হয়েছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর বাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন কমিশন-প্রাপ্তির জন্য, তখনই যুদ্ধ শুরু হয়। তাঁর সৈন্যদল এবং তাঁদের সিঙ্গল-শটবন্দুকপাতি একটি দীন চেহারাই ফুটিয়ে তুলছে, তবে তাঁদের মনােবল খুব দৃঢ়। অথচ অধিকাংশ সৈনিকই অপেশাদার ও অন্যান্য জেলা  থেকে আগত এবং তাঁদের পরিবার এখন কোন্ অবস্থায় আছে তাঁরা তার কিছুই জানে না। | স্পষ্টভাষী ও দৃঢ়চেতা তরুণ এই লেফটেন্যান্ট তাঁর লােকদের আত্মদানকারী মনােভাবের কথা বারবারই বলছিলেন, “আমাদের শৃঙ্খলা ও মনােবলের কোনাে সমস্যা নেই। জীবন উৎসর্গ করতেই এ-যুদ্ধে যােগ দিয়েছে সবাই। সকলেই মানসিকভাবে সচেতন।

সামনে দীর্ঘ সংগ্রাম

যুদ্ধ আর কতকাল চলবে এটা জানতে চাইলে তিনি কোনাে দ্বিধা না করে জবাব দিলেন, ‘এটা দু-বৎসরসময় নিতে পারে। তাঁর পাশের কয়েকজন বাঙালি রাজনৈতিক কর্মী গুঞ্জন। করে উঠে এই মতের বিরােধিতা করলেন। তাঁদের বক্তব্য হলাে বিজয় খুবই নিকটে, কিন্তু লেফটেন্যান্ট নিজের মতে অনড় রইলেন। | কেবল একটি বিষয়েই লেফটেন্যান্ট অস্পষ্ট রইলেন, তা হলােহতাহতের সংখ্যা। তিনি বললেন, তাঁদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সামান্যই, পক্ষান্তরে পাকিস্তানের প্রচুর হতাহত হয়েছে। লেফটেন্যান্ট আখতার-উজ-জামান মােটামুটি ভালােই ইংরেজি বলেন এবংতাঁর ইংরেজি কিছুটা মার্কিনি কেতারও বটে। আমেরিকান স্ল্যাং বা গালমন্দ শুনে হেসে উঠলেন তিনি। অভ্যাগতদের একজনকে জানালেন তাঁর গায়ের টি-শার্টের মতাে অবিকল একটি জামা তাঁরও রয়েছে। ১৯৬৪ সালে যশােরে তিনি যখন কলেজের ছাত্র, তখন সেখানে আগত আমেরিকান শান্তি বাহিনীর (পিস কর্পস্) দুই সদস্যের একজন তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। তিনি তাঁদের নামও বললেন—ফরেষ্ট নল, ক্যালিফোর্নিয়ার উইলিয়াম রাসেল এবং বােস্টনের ডােনাল্ড ভিলেনকোর্ট। অভ্যাগতরা যখন বিদায় নিচ্ছিল বেশ গর্বের সঙ্গে তিনি বললেন, “অনুগ্রহ করে ওঁদেরকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ে দেবেন এবং বলবেন আমি লড়াই করছি বাংলাদেশের ভেতরে থেকে।’ 

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!