You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইতিহাস, ভৌগােলিক অবস্থান, ক্ষমতার ভারসাম্য ও নির্বাচনী ফলাফল সবকিছু মিলেই গড়ে উঠেছে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট। তবে এই রক্তক্ষয়ী উত্তালতাসঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে কেবল, একজন কূটনীতিক যেমন বলেছেন, ‘উপমহাদেশের বিকারতত্ত্বের নিরিখে। ২৫ মার্চ রাতে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন দমন করার জন্য পাকবাহিনী যখন পূর্ব পাকিস্তানেআকস্মিক অভিযান শুরু করলাে তখন থেকেই ন্যায়বিদ্যা ও যুক্তির স্বাভাবিক মান অচল হয়ে পড়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের কাণ্ডজ্ঞানহীননির্মমতা এটাই প্রকাশ করছে, যে-কোনাে মূল্যে ও যে-কোনাে উপায়ে হলেও সামরিক কর্তৃপক্ষ পূর্ব পাকিস্তানের ওপর তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখবে। অপরদিকে এই নির্মমতা থেকে জাত ও পরিপুষ্টিপ্রাপ্ত জনসমর্থনধন্য গেরিলা প্রতিআক্রমণ ক্রমেই কার্যকর হয়ে উঠছে। বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে পাকবাহিনীর প্রতিটি প্রতিশােধমূলক অভিযান জন্ম দিচ্ছে নতুন বাঙালি মুক্তিযােদ্ধার। ক্রুদ্ধ, তিক্ত, বিষন্ন ও ঘৃণাপােষণকারী বাঙালিরা পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ লড়াইয়ে এখন প্রস্তুত বলেই মনে হয়। এর থেকে কম কোনাে কিছু যেমন পূর্ববর্তী লক্ষ্য পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামাের আওতায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্জন, আজ অচ্ছুৎবলে বিবেচিত হচ্ছে। | অনেক পশ্চিমা কূটনীতিক বন্দী পূর্ব পাকিস্তানি নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রকৃত সমাধান অর্জনের চাবিকাঠি হিসেবে গণ্য করেন। তবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করেছেন যে, অধুনা নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ  মুজিবের রুদ্ধদ্বার বিচার অনুষ্ঠিত হবে এবং চরম শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের মুখােমুখি হতে হবে তাঁকে।

এসবই লিখিত বক্তব্য, কোনাে সিদ্ধান্ত এখনাে ঘােষিত হয় নি। ইতিমধ্যে ৭৫ মিলিয়ন অধিবাসীর পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৭ মিলিয়নেরও অধিক শরণার্থী সেনা-সন্ত্রাসের কবল থেকে রক্ষা পেতে ভারতে পালিয়ে এসেছে। গণ্ডগােলের কারণে হেমন্তে যদি দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় তবে আরাে বহু লােক দেশত্যাগ করতে পারে। উদ্বাস্তুরা ভারতের জন্য কেবল বিপুল অর্থনৈতিক বােঝা নয়, একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক শঙ্কাও তাঁরা বহন করছে ভারতের অস্থিতিশীল ও বিশৃঙ্খল পূর্বাঞ্চল, কয়েক বছর আগেই যে অঞ্চলের ওপর দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটেছে, সেখানে চেপে বসছে লাখ লাখ গৃহহীন, কর্মহীন মানুষ এবং যেহেতু পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের অধিকাংশই হচ্ছে পাকবাহিনীর আক্রমণের বিশেষ লক্ষ্য হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত এই সঙ্কট তাই সকল ভারতীয়ের মনে ১৯৪৭ সালের রক্তক্ষয়ী হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার স্মৃতি জাগিয়ে তুলছে। ঐ দাঙ্গার পরিণতিতে উপমহাদেশ খণ্ডিত হয়ে মুসলমানদের আবাসভূমি হিসেবে পাকিস্তান এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু-অধ্যুষিত কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের অত্যুদয়। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক নিপীড়ন ভারতীয়দের চোখে শুভের বিরুদ্ধে অশুভের চক্রান্ত হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।

ভারত ও পাকিস্তানের নেতারা পরস্পরের বিরুদ্ধে তরবারি ঘুরিয়ে চলছে, অনেকবারই ঘটে গেছে সীমান্ত-সংঘর্ষ এবং হুমকি সৃষ্টি হয়েছে আরেকটি যুদ্ধের, স্পষ্টতই যে যুদ্ধের প্রভাব পড়বে বিশ্বব্যাপী। | এই ঘটনার সঙ্গে যে প্রভূত আবেগ জড়িয়ে রয়েছে—স্পষ্টতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক বিদেশী রাষ্ট্র অজ্ঞাত কারণে তার যথাযথ স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যেমন ওয়াশিংটন এখনাে রাজনৈতিক সমাধান অর্জনের আশাবাদ ব্যক্ত করে চলেছে, অথচ সংশ্লিষ্ট কোনাে কূটনীতিক অথবা বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষক স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনাে স্থায়ী সমাধানের কথা ভাবতে পারছেন না। ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখছে এই যুক্তিতে যে, এর ফলে অনুগ্র সমাধান অর্জনে চাপ প্রয়ােগের হাতিয়ার তার হাতে থাকছে। ওয়াশিংটনের এই তথাকথিত বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পাকিস্তানে প্রজ্বলিত আবেগের বৈপরীত্য পর্যবেক্ষকদের চোখে বেশ স্পষ্ট। সামরিক শাসনের অবসান, প্রদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শােষণ বন্ধ এবং যথেষ্ট মাত্রায় স্বশাসন অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত তাদের আন্দোলনকালে বাঙালিরা পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়েছে, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি পায়ে মাড়িয়েছে এবং সেনা বাহিনীকে কটাক্ষ করেছে। তারা আরাে তাৎপর্যপূর্ণ ও বিপ্লবী কাজও করেছে যেমন সামরিক শাসন বয়কট এবং মার্চে কার্যত তাদের নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের কাছে আবেগী ও প্রতীকী অপমানগুলােই ছিল অধিক জ্বালাধরা। একজন মার্কিন কূটনীতিক বলেছেন, “পতাকা, ইসলামি ঐক্য, জিন্নাহ ও সেনাবাহিনী নিয়ে গর্ব— এসব তাদের কাছে পরম ধর্মীয় মর্যাদাসম্পন্ন। এর অবমাননা তাদের ক্রুদ্ধ করে তােলে। সংক্ষেপে, বাঙালি জনগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার কেন তাদের সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিল তার বড় কারণ ছিল পবিত্র যুদ্ধের ভাবনার সঙ্গে জড়িত উন্মত্ততা। এটা বুঝতে কষ্ট হবে না যদি আমরা স্মরণ করি যে, পাকিস্তান হচ্ছে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র, যেখানে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের কোনাে অস্তিত্ব নেই এবং জনগণের ইচ্ছা বারংবার পদপিষ্ট হয়েছে।

সেই প্রথম রাতে পাক আর্মি যখন ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছিল, তারা সেটা উপভােগ করছিল বলেই মনে হয়েছে। নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করে গলির ভেতর থেকে পাঞ্জাবি সৈন্যরা যখন বের হয়ে আসছিল, তারা দু’হাত উঁচিয়ে চিৎকার করে স্লোগান দিয়েছে। ‘নারায়ে তাকবির সৃষ্টিকর্তার জয়), পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ (পাকিস্তানের জয়)। বর্তমান সংঘর্ষের একটি মৌল উপাদান হচ্ছে জাতিগত ঘৃণা—১০০০ মাইল ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা পৃথকীকৃত পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণ নৃতাত্ত্বিকভাবে বিভক্ত বহু শত্রুভাবাপন্ন দেশের জনগণের মধ্যেকার ফারাকের চাইতেও আলাদা এবং তারা এখন শত্রুপক্ষই বটে। তারা কথা বলে দুই ভিন্ন ভাষায় (পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু, পুবে বাংলা), তাদের আহারাদি ভিন্ন (পশ্চিমে মাংস-রুটি, পুবে ভাত-মাছ) এবং তাদের রয়েছে বিপরীত সংস্কৃতি : পাঞ্জাবিরা শক্ত-সমর্থ ধরনের, পছন্দ করে প্রশাসন ও সৈনিকবৃত্তি, পক্ষান্তরে বাঙালিরা আবেগপ্রবণ, ভালােবাসে সাহিত্য ও রাজনীতি। ফিকে-বর্ণ দীর্ঘদেহী পশ্চিম পাকিস্তানিদের শেকড় প্রােথিত মধ্যপ্রাচ্যে, বাঙালিদের সঙ্গে যােগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার হালকা-পাতলা বাদামী জনগােষ্ঠীর। তাদের মধ্যেকার একমাত্র অভিন্ন উপাদন হচ্ছে ধর্ম, ইসলাম, ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে বৃটিশ শাসন অবসানে দুই পক্ষ-বিশিষ্ট অবাস্তব জাতিগঠনের যা ছিল নড়বড়ে ভিত্তি। পাকিস্তান সরকারের ওপর যাদের আধিপত্য সেই পাঞ্জাবিদের সঙ্গে বাঙালিদের নৃতাত্ত্বিক ফারাক ১৯৪৭ সালেও বহাল ছিল, কিন্তু তখন ধর্মভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের উন্মাদনায় সেটা চাপা পড়ে যায়। পরবর্তী দুই দশকে এইসব ফারাক আরাে তীক্ষ হয়ে ওঠে পূর্ব অংশের ওপর পশ্চিমের সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শশাষণের ফলে। যদিও পশ্চিমের ৬৯ মিলিয়ন মানুষের তুলনায় পূর্বের ৭১ মিলিয়ন মানুষ সংখ্যায় গরিষ্ঠতথাপি পশ্চিম, যেখানে সরকারের কেন্দ্রীয় অবস্থান, বরাবর পেয়ে এসেছে উন্নয়ন তহবিল, কলকারখানা, গণপূর্ত প্রকল্প, বৈদেশিক সাহায্য, আমদানি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাদির সিংহভাগ।  পূর্বাঞ্চলে পণ্যের মূল্য বেশি, আয় কম। পূর্ব পাকিস্তানের পাট ও অন্যান্য রপ্তানি থেকে আসে পাকিস্তানের বৈদেশিক উপার্জনের অর্ধেকেরও বেশি। পশ্চিমাঞ্চলের কলকারখানা চালু রাখার কাঁচামাল আমদানি হয় এই অর্থ দিয়েই। পূর্ব পাকিস্তান আবার পশ্চিমের উৎপাদিত পণ্যের প্রধান বাজার, বিশেষত নিম্নমানের সুতিবস্ত্রের।

বিশ্বের আর কোথাও যার বাজার মিলবে না, এখানে সেটাই সরকার-নির্দিষ্ট উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের অভিযােগ যে তাদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশিক শােষণ এক প্রবংশ আগের বৃটিশ শােষণের চাইতেও নিকৃষ্ট। তিক্ততা চরম পরিণতি অর্জন করেছে   দুটো ঘটনার ভেতর দিয়ে। প্রথমটি হলাে গত নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ও সরকারের গা-ছাড়া রিলিফ প্রচেষ্টা, বাঙালিদের দুর্ভাগ্যের প্রতি পশ্চিমাদের অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের স্বরূপ যা নাটকীয়ভাবে তুলে ধরলাে। এক মাস পরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অধিক স্বশাসন দাবিকারী আওয়ামী লীগের নির্বাচনী-প্রচারে এটা বাড়তি ভােট যুক্ত করলাে। | দ্বিতীয় ঘটনা ছিল খােদ নির্বাচন-পাকিস্তানের ইতিহাসের প্রথম সর্বজনীন ও স্বাধীন ভােট গ্রহণ। এই নির্বাচন সম্ভব করে তােলার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। ১৯৬৯ সালের মার্চে আইয়ুব খানের দশকব্যাপী শক্ত শাসনের অবসান ঘটেছিল। রক্তাক্ত দাঙ্গা ও প্রতিবাদ আন্দোলনে এবং বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা ছিল ক্ষমতা অধিগ্রহণকারী ইয়াহিয়া খানের অন্যতম প্রতিশ্রুতি।

অধিকাংশ কূটনীতিক এই প্রতিশ্রুতি পালনে ইয়াহিয়ার আন্তরিকতার স্বীকৃতি দেন। কেউ কেউ এখনাে মনে করেন সর্বময় ক্ষমতা যদি তাঁর হাতে থাকতাে তবে সেনা-নিপীড়ন ঘটতাে না। পাকিস্তানে প্রধান সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয় কয়েকজন জেনারেলের সমন্বয়ে গঠিত এক জুন্টা দ্বারা, এদের অধিকাংশই হচ্ছে কঠোর উগ্রবাদী। জেনারেল ইয়াহিয়া সর্বাধিনায়ক হলেও এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এটা ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয় যে, জেনারেলরা এই ভেবে নির্বাচন অনুষ্ঠান সমর্থন করেছিলেন যে অর্জিত ফলাফল তাদের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখার প্রতিকূলে যাবে না। অনেক পশ্চিমা কূটনীতিকের মতাে তারাও মনে করেছিলেন যে যদিও পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ভালাে ফলাফল দেখাবে তাহলেও সেনাবাহিনীরসমর্থক দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় দলগুলাে দেশের উভয় অংশেযথেষ্টসংখ্যক আসন পাবে যা দিয়ে তারা সংখ্যাধিক্যের জোরে সরকার পরিচালনা করতে পারবে। | কিন্তু ঘূর্ণিঝড় পাল্টে দেয় এই ভবিতব্য। পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র দুটি বাদে সব আসনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ, জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের (ইয়াহিয়ার আরেকটি ছাড়) কারণে এর ফলে তারা অর্জন করে জাতীয়ভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বাঙালিদের কেউ কেউ। মনে করেন নির্বাচনের ফলাফল ঘােষিত হওয়ার সাথে সাথেই জেনারেলরা সামরিক সমাধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আসল ব্যাপার সম্ভবত কখনােই জানা যাবে না। যাই হােক না কেন, ঝড়ের কালাে মেঘের আনাগােনার শুরু তখন থেকেই।

পশ্চিম পাকিস্তানের অগ্রণী রাজনৈতিক গ্রুপ পাকিস্তান পিপলস পার্টি দাবি তুলতে শুরু করে যে, আওয়ামী লীগ তাদের স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচি কাটছাঁট করুক। কিন্তু শেখ মুজিব— তাঁর সমর্থক উগ্রপন্থী ছাত্র-শ্রমিকদের চাপের মুখে এবং সম্ভবত সামরিক রক্তপাত ঘটবার বিপদ সম্পর্কে কাঁচা ধারণা থেকে—আপসরফায় রাজি ছিলেন না। তাঁর ভয় ছিল সেটা করলে পশ্চিম পাকিস্তানি ক্ষমতাগােষ্ঠী কোনাে-না-কোনােভাবে বাঙালিদের ঠকিয়ে ন্যায্যভাবে অর্জিত রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে তাদের বঞ্চিত করবে। এরপর পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতীয় সংসদের আশু অধিবেশনে যােগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। নতুন সংবিধান রচনার জন্য ৩ মার্চ এই অধিবেশন বসার কথা ছিল এবং আকস্মিকভাবে ইয়াহিয়া তা স্থগিত ঘােষণা করেন। পূর্ব  পাকিস্তান জুড়ে প্রতিবাদ ও সংঘর্ষের ঢেউ বয়ে যায়, বাঙালি জনসমাবেশের ওপর যথেচ্ছ গুলিবর্ষণ করে সেনাবাহিনী, হতাহত হয় বহুজন এবং এরপর সামরিক শাসন অগ্রাহ্য করে শেখ মুজিবের অসহযােগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালিরা এর জবাব দেয়। আন্দোলন শেষ পর্যন্ত পরিণতি লাভ করে এক ধরনের কার্যত আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠায়। পাকিস্তান সরকার তখন রাতের অন্ধকারে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য পাঠাতে শুরু করে। ১৫ মার্চ শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনার জন্য ইয়াহিয়া স্বয়ং ঢাকায় আসেন। অধিকাংশ বাঙালি এবং কিছু কিছু বিদেশী পর্যবেক্ষকও এখন মনে করেন আক্রমণের জন্য যথেষ্টসংখ্যক সৈন্য চালান করার মতােসময় নেওয়ার জন্যই আলােচনার অছিলা তৈরি করা হয়েছিল। সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত ঠিক কখন গৃহীত হয়েছিল সেটা জানা যায় না, তবে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণাদি থেকে এই ইঙ্গিত মেলে যে এটা শেষ মুহূর্তে নেওয়া হয় নি। | সে যাই হােক, আলােচনা যখন অব্যাহত ছিল তখন ২৫ মার্চ রাতে ট্যাঙ্ক, রকেট ও অন্যান্য ভারি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকবাহিনী ঢাকায় প্রায় সর্বাংশে বেসামরিক জনগণের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। কোথাও কোথাও তারা দরিদ্র জনগণের গােটা বসতি ধূলিসাৎ করে দেয়। পরবর্তী দিন ও সপ্তাহগুলােতে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা গােটা পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে, একই ধরনের নির্মম অভিযান চালিয়ে জনবসতিগুলাে তছনছ করে দেয়। | এই লেখার সময় পর্যন্ত, বিদেশী কূটনীতিকদের হিসেবে, সেনাবাহিনী অন্ততপক্ষে ২০০,০০০ বাঙালিকে হত্যা করেছে।

প্রদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে এমন দাবি সত্ত্বেও সেনাবাহিনী এখনও আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এমন কি সরকারি প্রশাসনের কোনােরকম কাঠামাে দাঁড় করাতে সমর্থ হয় নি। অপরদিকে ভারত প্রদত্ত সাহায্য, প্রশিক্ষণ ও নিরাপদ আশ্রয় লাভ করে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধ তৎপরতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির ভগ্নদশা অব্যাহত রয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানেও তা সঙ্কট সৃষ্টি করছে। সেনাবাহিনীর মধ্যে জখম ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে এবং একটি ক্ষুদ্র দালাল গােষ্ঠী (অধিকাংশই বিহারিদের মতাে অবাঙালি মুসলমান ও দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় দলের বাঙালি সমর্থক) ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপক জনগণ বৈরী, পােড়খাওয়া এবং অবিচলিত। | যুক্ত পাকিস্তানের ধারণার কবর হয়েছে। সামরিক শাসকরা একটি উপনিবেশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানকে ধরে রাখতে পারবে শুধু জবরদস্তি, সন্ত্রাস ও বর্বর পুলিশি রাষ্ট্র ব্যবস্থা অবলম্বন করে। অব্যাহত সামরিক নিপীড়নের নিরর্থকতা সম্পর্কে পাকিস্তানি জেনারেলদের মধ্যে কোনাে উপলব্ধির লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না। কারাে কারাে ধারণা—যদিও এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে- পূর্ব পাকিস্তানে বাস্তবে কি ঘটছে সে সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে অবহিত করা হচ্ছে না। এদিকে শাসকগােষ্ঠীর অন্যান্য কাজকর্ম আস্থা ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে ঘৃণা ও অবিশ্বাস বাড়াতেই পরিকল্পিত হয়েছে বলে মনে হয়। বাংলা ভাষার ব্যবহার সঙ্কুচিত করা হচ্ছে, পাল্টানাে হচ্ছে রাস্তার নাম, দায়িত্বশীল সরকারি পদ থেকে বাঙালিদের অপসারণ ঘটছে এবং গ্রামে অথবা ভারতে পালিয়ে গেছে যেসব বাঙালি তাদের বাড়িঘর, দোকানপাট দালালদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। 

সংঘর্ষ যতাে প্রলম্বিত হবে, বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন— আদর্শ-উদ্বুদ্ধ নয় বরং যা হচ্ছে জাতীয়দাবাদী অ্যুথান— তার চরিত্র বদল ঘটে মাওবাদী উগ্রপন্থী নেতৃত্বাধীন হওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়বে। কতক চীনাপন্থী মুক্তিযােদ্ধা পূর্ব পাকিস্তানে সক্রিয় রয়েছে। বিদেশী শক্তিগুলাের জন্য এর তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর। এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বিশৃঙ্খলা ও বিদ্রোহের এক বলয় গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন, যার বিস্তৃতি ভারতে ইতিমধ্যে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে পূর্ব পাকিস্তান ছাড়িয়ে বার্মা হয়ে ভিয়েতনাম পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। ভারতের জন্য ঘটনার প্রভাব বিশেষ জটিল। গত মার্চ মাসে ‘গরিবি হটাও কর্মসূচি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিপুলভাবে পুনঃনির্বাচিত হয়েছিলেন কিন্তু লাখ লাখ বাঙালি শরণার্থীর থাকা-খাওয়ার ব্যয় মেটাতে গিয়ে কার্যত সকল উন্নয়ন পরিকল্পনা স্থগিত হয়ে আছে। ভারতকে এখন এমন এক পথ মাড়াতে হচ্ছে যা বর্ধমান বেকারত্ব, অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও তীব্র দারিদ্র্যসম্পন্ন দেশের জন্য বিশেষ বিপজ্জনক। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ অথবা বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান, এমনি চরম কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জনগণ ও রাজনীতিবিদদের চাপ এ-যাবৎ শ্ৰীমতী গান্ধী ঠেকিয়ে আসছেন। তিনি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টারা হয়তাে ভয় পাচ্ছেন যে, বিদ্যমান আবেগ-উত্তেজিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তানকে তা যুদ্ধঘােষণায় প্ররােচিত করতে পারে। শ্রীমতী গান্ধী এটা পরিহার করতে অত্যন্ত উদগ্রীব। কিন্তু স্বীকৃতিদানের জন্য চাপ ক্রমশ বাড়ছে এবংশ্রীমতী গান্ধী হয়তাে শেষ পর্যন্ত জনমতের প্রতি অনুগত হওয়াটাকেই প্রয়ােজনীয় মনে করতে পারেন। পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্তে ভারত প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তার দিক থেকে সংঘর্ষের পথে পদক্ষেপ না নেওয়াটাই অনুসৃত নীতি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সংক্ষেপে, তৃতীয় ভারত-পাক যুদ্ধের অজুহাত সে সৃষ্টি করতে চাইছে না। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা-যােদ্ধাদের জন্য অব্যাহত সামরিক সাহায্য ও নিরাপদ আশ্রয় প্রদান পরিহার করাটা তার লক্ষ্যের মধ্যে নেই। ফলে যুদ্ধের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বাঙালি গেরিলা এলাকা। প্রতিষ্ঠায় ভারত যদি সহায়তা করে, তবে তার সরকার এটাকে পাকিস্তানের ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করবে। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, তেমনটা হলে ‘আমি পুরােপুরি যুদ্ধ ঘােষণা করবাে এবং বিশ্ব একথা জেনে রাখুক।

অধিকন্তু, বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়ে ভারত এক অর্থে পূর্ব পাকিস্তানেবিশৃঙ্খলা বহাল রাখছে এবং এর মাধ্যমে অব্যাহত রাখছে শরণার্থী আগমনের প্রবাহ, যা তার অর্থনীতি ও সামাজিক আবহের ওপর চাপ জোরদার করছে। ভারতের একটি বড় শঙ্কা এবং পাকিস্তানের জন্য ভরসা যে, বাদবাকি বিশ্ব সমস্যাটিকে আরেকটি ভারত-পাক সঙ্কট হিসেবে বিবেচনা করবে এবং এর দ্বারা প্রকৃত সমস্যা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরে যাবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের যুদ্ধংদেহী কথাবার্তা, ভারতের বিবেচনায়, দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়ার এমনি এক কৌশল এবং সম্ভবত বাঙালি গেরিলাদের ক্রমবর্ধমান সাফল্যে দুর্বলচিত্ত প্রতিক্রিয়া।   তবে কোনাে কোনাে ভারতীয় বিশ্লেষক মনে করেন, এমনি পটভূমিকায় পাকিস্তানের ভারত আক্রমণ একান্ত সম্ভবপর। তাঁদের মতে, গেরিলাদের সঙ্গে লড়াইয়ে পূর্ব পাকিস্তানে হেরে গেলে পাকিস্তানি জেনারেলদের মুখ দেখাবার জো থাকবে না এবং এটা পশ্চিম পাকিস্তানেও স্বায়ত্তশাসনকামী বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর অ্যুথানকে উৎসাহিত করতে পারে। বেলুচ, পাঠান এমনি বিভিন্ন জাতি পাঞ্জাবি আধিপত্য নিয়ে বাঙালিদের মতােই ক্ষিপ্ত। তবে, এই তত্ত্ব অনুযায়ী, যদি ভারতের সঙ্গে পবিত্র যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে হারাতে হয়, তবে পরাজয়ের নানা কারণ তারা দেখাতে পারবে এবং ভারত-বিরােধী ঘৃণার গদে পশ্চিম পাকিস্তানকে একত্র জুড়ে রাখতে পারবে। | ভারত-পাক যুদ্ধ শুরু হলে বৃহৎ শক্তিবর্গ—যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত ইউনিয়নও কমিউনিস্ট চীন নিস্পৃহ দর্শক হয়ে থাকতে পারবে না, তবে কতােটা গভীরভাবে তারা কোনাে এক পক্ষে জড়িয়ে পড়বে, সেটা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। মােটামুটিভাবে লাইন-আপ এখন যেমন রয়েছে, তা হলাে : চীন পাকিস্তানকে সমর্থন করছে, সােভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থন করছে ভারতকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করে একদিকে শরণার্থী বাবদ ভারতকে বড়রকম সাহায্য দিচ্ছে, অন্যদিকে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখছে, যা, ওয়াশিংটনের মতে, ইসলামাবাদ সরকারের সঙ্গে সংলাপ চালানাে ও চাপ প্রয়ােগের একটি উপায়।

১৯৬২ সালের সীমান্ত সংঘর্ষের পর থেকে ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক আড়ষ্ট হয়ে আছে। পক্ষান্তরে বিগত কয়েক বছরে চীন হয়ে উঠেছে পাকিস্তানের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী ও বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে ঘনিষ্ঠতম মিত্র। ভারত-পাক যুদ্ধ বাধলে চীন সামরিক হস্তক্ষেপ করবে কি-না, সেটা জানা নেই, তবে ইসলামাবাদের কূটনীতিক মহলের খবর অনুযায়ী বাঙালি-সঙ্কট শুরুর পর থেকে পাকিস্তানে চীনা সামরিক সাহায্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। পূর্বাঞ্চলে বদলি সৈন্য হিসেবে পাঠানাের জন্য অন্তত একটি নতুন পাকিস্তানি ডিভিশনকে অস্ত্রপাতি যােগানাের চুক্তি চীন করেছে। (এইসব কূটনীতিকের মতে, তবে চীন এখনাে প্রকাশ্যে স্বাধীনতা যযাদ্ধাদের সম্পর্কে নিন্দাবাদ করে নি এবংতাঁরা মনে করেন পাকিস্তানের প্রতি পিকিং-এর বর্তমান সহায়তা ভবিষ্যতে বাঙালি বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থনদানে কোনাে বাধা হতে পারে)। | প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সম্প্রতি যখন বলেছিলেন যে, যুদ্ধ বাধলে পাকিস্তান ‘একা’ থাকবে না, তখন তিনি সম্ভবত পিকিংকে বুঝিয়েছিলেন। ভারতীয় সংসদে সঙ্গে সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং জবাব দিয়েছিলেন, সে ক্ষেত্রে ভারতও একা থাকবে না। অনুমান করা যায় তিনি রাশিয়ার কথা বলছিলেন। ষাটের দশক জুড়ে মস্কো যদিও ভারতকে যেমন সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছিল, তেমনি পাকিস্তানকেও অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। তবে বিগত কয়েক বছরে মূলত ভারতের আপত্তির কারণে সেই সাহায্য একেবারেই কমে এসেছিল। মস্কো পাকিস্তানকে পুরােপুরি চীনের হাতে ছেড়ে দিতে চায় নি এবং সাম্প্রতিক সঙ্কটের সময় অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ বা এমনি কোনাে চরম পদক্ষেপ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে | নেয় নি। তবে পাকিস্তানের ওপর বড় রকম বাজি রুশিরা ধরে নি, ২০ বছরের ভারত   রুশ মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর স্পষ্টতই দেখিয়েছে যে, রুশিরা ভারতকেই তাদের মিত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে।

সঙ্কটকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেয়ালের ওপর বসে কালক্ষেপণ করছে এবং তাদের ভূমিকা বিশ্বব্যাপী নজর ও সমালােচনা আকর্ষণ করেছে। ভারতে এটা বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এবং মার্কিন-ভারত সম্পর্ক যথেষ্ট নিম্নগামী হয়েছে। মনে হচ্ছে ওয়াশিংটন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তাল জাগরণকে ঘনিয়ে আসা ভারত-পাক সংঘর্ষ থেকে আলাদা করে দেখা অসম্ভব এবং সাহায্য বন্ধ করা বা সামরিক পীড়নের প্রকাশ্য নিন্দা জ্ঞাপনের মতাে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা উল্টো ফল বয়ে আনবে। উপমহাদেশে ভারতের বিপক্ষে ভারসাম্য হিসেবে পাকিস্তানকে বিবেচনা করার ধারণার প্রতি ওয়াশিংটন এখনও অনুগত রয়েছে বলে মনে হয়। পাকিস্তানে বিপুল পরিমাণ মার্কিন অর্থলগ্নিকে বিসর্জন দিতে অনীহারও প্রকাশ রয়েছে এতে। সর্বোপরি এটা মেনে নিতে আপত্তি রয়েছে যে, পাকিস্তানকে ব্যাপক সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদানের পুরনাে নীতি মােটামুটি ব্যর্থ হয়েছে—এই সাহায্য শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে, বাঙালিদের তিক্ততা বাড়িয়েছে। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত, আদর্শ মার্কিন পাক সম্পর্কের দশকে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সজ্জিত ও প্রশিক্ষিত করেছে আমেরিকা এবং পশ্চিমপন্থী, কমিউনিষ্ট-বিরােধী সামরিক জোট সিয়াটো ও সেন্টোর সদস্য হয়েছে সে দেশ। এই সময়সীমায় যখন রুশ ও চীনাদের নিয়ে পাকিস্তানের সমস্যা ছিল— আমেরিকা পাকিস্তানকে শুধু সামরিক সাহায্যই দিয়েছে ১.১৭ বিলিয়ন ডলারের (তবে এই সংখ্যা আরাে কম হতে পারে)। অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়া হয়েছিল আরাে অনেক বেশি। ১৯৬৫ সালের পর সম্পর্কে নাটকীয় শীতলতা নামে। অনেক কারণেই এটা ঘটেছেঃ ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ পাকিস্তানকে চীনের ঘনিষ্ঠ করে তুলেছিল; ১৯৬৪ সালে আরােপিত মার্কিন অস্ত্র সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা ছিল আরেক কারণ যে সরবরাহের ওপর ভারতের চেয়ে পাকিস্তান বেশি নির্ভরশীল ছিল এবং অস্ত্রখাতে যুক্তরাষ্ট্র সৃষ্ট শূন্যতা পূরণে চীন ও রাশিয়ার আগ্রহ এখানে ভূমিকা রেখেছে। ১৯৬৭ সালে ওয়াশিংটন অস্ত্র সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা আংশিক তুলে নেয় এবং মারাত্মক নয় এমন অস্ত্র, খুচরাে যন্ত্রাংশ ও পূর্বে সরবরাহকৃত অস্ত্রের গােলাগুলি বিক্রয় অনুমােদন করে। 

২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর আক্রমণ অভিযান শুরুর পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের ওপর নতুন করে বিষেধাজ্ঞা ঘােষণা করে এবং জানায় যে কোনাে সামরিক সরবরাহ বর্তমানে পাইপলাইনে নেই। কিন্তু জুনের শেষাশেষি সংবাদপত্রের রিপাের্টে প্রকাশ পায় যে, মার্কিন বন্দর থেকে পাকিস্তানি জাহাজে অস্ত্র চালান অব্যাহত রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রথমে একে আমলাতান্ত্রিক ভুলচুক বলে অভিহিত করে, কিন্তু পরে এই ব্যাখ্যা বাতিল করে জানায় যে, অস্ত্র চালান সম্পূর্ণ আইনসঙ্গত, কেননা, এসবের জন্য চুক্তি ২৫ মার্চের আগে করা হয়েছিল এবং এই চালান অব্যাহত  থাকবে। এইসব চালান রােধে কংগ্রেসের প্রচেষ্টা সফল হয় নি। ওয়াশিংটনের ওয়াকেবহাল সূত্রে প্রকাশ, এ ব্যাপারে নীতি নির্ধারণ করেছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট নিক্সন। ইতিমধ্যে মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্য সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছিল (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষায় ‘বিবেচনাধীন’)। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় যে, পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়ােগের উপায় হিসেবে সাহায্য প্রদানে অস্বীকৃতি আমেরিকা জানাবে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিশ্বব্যাঙ্কের ১১-জাতি এইড-টু-পাকিস্তান কনসাের্টিয়ামের অন্যান্য সদস্যের কঠোর মনােভাবের বিরুদ্ধে একলা-চলা-নীতি অনুসরণে ওয়াশিংটনের অনিচ্ছুক মনােভাবের প্রতিফলন ঘটেছে সাহায্য স্থগিত করার ক্ষেত্রে। জুনে এক বিশেষ বিশ্বব্যাঙ্ক রিপাের্টে বলা হয় যে, সেনাবাহিনীর অভিযান পূর্ব পাকিস্তানকে এতাে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে যে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তা ‘সামান্যই কাজে আসবে এবং অন্তত এক বছর বা তারও বেশি সময় ধরেতা স্থগিত অবস্থায় রাখতে হবে’। কনসাের্টিয়াম সাহায্যের ওপর পাকিস্তান। বড়ভাবে নির্ভরশীল, যার পরিমাণ বার্ষিক ৪৫০ মিলিয়ন ডলার (এর মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেয় ২০০ মিলিয়ন ডলার)। স্বীয় বিশ্ব-ভাবমূর্তি উদ্ধার ও বিদেশী সাহায্য পুনরায় চালু করতে অধীর (বৈদেশিক মুদ্রা-সঞ্চয় শূন্যের কাছাকাছি চলে আসছে) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে ১০০ জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মােতায়েনে সম্মত হয়েছেন। তাঁদের কাজ হবে পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণে সাহায্য করা এবং ভারত থেকে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনে সহায়তা দান। 

ভারতের মাটিতেও এমনি পর্যবেক্ষক দল মােতায়েনের জন্য জাতিসংঘ বলেছিল কিন্তু ভারত ক্রুদ্ধভাবে তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে সন্ত্রাস বন্ধ না হলে শরণার্থী প্রবাহ রুদ্ধ হবে না এবং ভারতে পর্যবেক্ষক বসিয়ে সেই কাজ সিদ্ধ হবে না। ভারত শরণার্থীদের দেশে ফেরা বাধাগ্রস্ত করছে, পাকিস্তানের এই অভিযােগ ভিত্তিহীন প্রচারণা বলে ভারত বাতিল করে দিয়েছে। বস্তুত তাদের প্রত্যাবর্তন কামনা করার অজস্র কারণ ভারতের রয়েছে। পর্যবেক্ষক সংক্রান্ত প্রস্তাবে ভারত পুরনাে জুজু দেখতে পাচ্ছে—সঙ্কটকে যে ক্ষেত্রে নিছক ভারত-পাক সমস্যা হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয় এবং সমস্যার সমাধানে ভারত ও পাকিস্তানের ওপর সমদায়িত্ব অর্পিত হয়। ভারত এটাও উল্লেখ করেছে যে, পর্যবেক্ষক গ্রহণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সম্মতি প্রদত্ত হয়েছে তখনই, যখন পূর্ব পাকিস্তানে গেরিলা তৎপরতা ও তার কার্যকারিতার লক্ষণীয় প্রসার ঘটেছে। | জাতিসংঘ দলের উপস্থিতি পাকবাহিনীর সন্ত্রাস ও প্রতিশােধস্পৃহা রােধে ভূমিকা পালন করতে পারে এবং এর ফলে কিছু শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে আগ্রহী হতে পারে। সেদিক থেকে এটা একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে বর্তমান লেখক ও অন্যান্য বিদেশী পর্যবেক্ষক শরণার্থী শিবিরগুলাে ব্যাপকভাবে ঘুরে আলাপ-আলােচনা করে অনুভব করতে পেরেছেন যে, বেশিরভাগ শরণার্থীই ফিরে যাবেন না। কেননা একদিকে তাঁদের বাড়িঘর, বিষয়সম্পত্তি দালালদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে শরণার্থীদের বৃহদংশ হিন্দু জনগােষ্ঠী সেনাবাহিনীর হত্যালীলার পর পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার চাইতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতেই বেশি নিরাপদ বােধ করবেন। 

তদুপরি, জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি গেরিলা তৎপরতা বন্ধ করতে পারবে না, এর ফলে অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা বহালই থাকবে যদি না সেনাবাহিনী সীমান্ত এলাকা থেকে : অনুবাদক) প্রত্যাহার করা হয়। তবে সে ক্ষেত্রে গেরিলাদের প্রতি ভারতীয় সাহায্য জাতিসংঘে সমালােচনার সম্মুখীন হবে। পাকিস্তান একে স্বাগতই জানাবে। মনে হয় ভারত এই ভেবে বিচলিত যে, সীমান্তে তাদের এলাকায় জাতিসংঘ। পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি প্রতিরােধযােদ্ধাদের প্রতি সমর্থনমূলক কাজকর্মঅস্ত্র, প্রশিক্ষণ, নিরাপদ আশ্রয় যােগানাে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যেহেতু ভারত ও পাকিস্তানে পর্যবেক্ষক মােতায়েনের প্রস্তাবটির উদ্যোক্তা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এর ফলে তাই আমেরিকার কাছ থেকে ভারত আরাে দূরে সরে গেছে। এশিয়াবিষয়ক অধিকাংশবিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার নীতি আঁকড়ে থেকে এবং বর্তমান সঙ্কটকে ভারত-পাক বিরােধ হিসেবে বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র এক অবাস্তব ও অদূরদর্শী নীতি অনুসরণ করছে। তাঁরা মনে করেন যে, পাকিস্তান ও ভারতকে আকার, গুরুত্ব, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য অথবা স্থিতিশীলতার নিরিখে এক পাল্লায় তুলে বিচার করা যায় না। ওয়াশিংটনের জন্য বাস্তববাচিত নীতি হবে পাকিস্তানকে অলীক কল্পনাবিলাস ছেড়ে উপমহাদেশের রাজনীতিতে প্রধানের বদলে অপ্রধান ভূমিকা মেনে নিতে সাহায্য করা। | পূর্ব পাকিস্তানের মূল রাজনৈতিক সমস্যা থেকে আলাদাভাবে শরণার্থী ও মানবিক সমস্যাকে বিচার করার ওয়াশিংটনীয় প্রবণতাও একইরকমভাবে অবাস্তব। উপমহাদেশ সম্পর্কে ওয়াকিবহালদের অধিকাংশের মতে, অন্যান্য মার্কিন পদক্ষেপের মতাে পর্যবেক্ষক প্রেরণের প্রস্তাবও বাস্তবসঙ্কট এড়িয়ে সাময়িক স্থিতাবস্থা আনয়নের প্রয়াস বলে প্রতীয়মান হয়, যার ফলে পাকিস্তানের অবশ্যম্ভাবী বিভক্তি কেবল বিলম্বিত হতে পারে মাত্র। 

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!