অপুষ্টি এবং তজ্জনিত রােগের কারণে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থী-শিশু মৃত্যুবরণ করছে এবং গুরুতর অপুষ্টিতে ভুগছে লক্ষ শিশু, দাঁড়িয়েছে মৃত্যুর কিনারে এসে। মৃত্যুহারের সঠিক হিসেব পাওয়া যাচ্ছে না, কেননা শরণার্থী শিবিরের ভারতীয় কর্মকর্তারা শিশু-মৃত্যুর পৃথক খতিয়ান রাখেন না। তবে বিভিন্ন ক্যাম্পেসরেজমিন তদন্ত করে বর্তমান সংবাদদাতা এটা সুস্পষ্টভাবে দেখতে পেয়েছেন যে ১ থেকে ৮ পর্যন্ত নাজুক বয়েসের শিশুদের মধ্যে প্রতিদিন ঘটছে শত শত মৃত্যু। কোনাে কোনােবিদেশী সাহায্যকর্মী মনে করেন মৃত্যুহার আরাে অনেক বেশি। বৃটিশ সাহায্য সংস্থা অক্সফামের অভিজ্ঞ মাঠকর্মী অ্যালান লেদার জানান, ‘হাজারে হাজারে শিশু মারা যাচ্ছে। এবং আমি মনে করি আরাে লক্ষ শিশুর মৃত্যু হবে যদি না অবিলম্বে ব্যাপক আকারে শিশু-আহার কর্মসূচি শুরু হয়।’ নতুন কর্মসূচি অনুমােদিত দুই মাসের দ্বিধাও আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতার পর অপারেশন লাইফলাইন নামে এমনি এক কর্মসূচি সবেভারত সরকারকর্তৃকঅনুমােদিত হয়েছে। এর কার্যকারিতা নির্ভর করবে কতত দ্রুত এটা পুরাে মাত্রায় চালু করা যায় তার ওপর। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন এটা করতে এক থেকে দুই মাস সময় লাগবে। পাক সরকারের ছয় মাসব্যাপী সামরিক অভিযানের কবল থেকে রক্ষা পেতে পালিয়ে আসা ৯ মিলিয়ন বাঙালি শরণার্থীর বেশির ভাগ যেসব জিজিরে শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে তার সবগুলােতেই দেখা যায় দুঃস্থ শিশুদের করুণ চিত্র। কোনােক্রমে দাঁড় করানাে ফিল্ড হাসাপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে মৃত্যুপথযাত্রী শিশু, তাদের লিকলিকে শরীরের খাঁচার ওপর লেপ্টে আছে কুঁচকানাে চামড়া। পাশেদাঁড়িয়ে হতবিহ্বল মায়েরা। একটুকরাে কাপড় কিংবা শক্ত কাগজ দিয়ে বাতাস করছে সন্তানকে কিংবা চেষ্টা করছে যৎসামান্য খাবার। খাওয়াতে যা আবার তৎক্ষণাৎ উগড়ে বমি করে ফেলছে শিশুরা। ‘ও কী বাঁচবে?’, নড়তে-চড়তে, এমনকি কাঁদতেও অক্ষম দুই মাসের কঙ্কালসার এক শিশুকে দেখিয়ে একজন দর্শনার্থী জানতে চাইলাে। ভারতীয় নার্স জবাব দিলেন, ‘কোনাে আশা নেই। মায়ের চোখের নীরব ভাষায় সেই হতাশারই সমর্থন প্রকাশ পেল।
অপুষ্টির ব্যাপকতা
শরণার্থী শিবিরে এসে পৌছুবার সময়ও বহু শিশু অপুষ্টিতে ভুগছিল, কেননা স্বাভাবিক সময়েও পূর্ব পাকিস্তানে অপুষ্টির ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়। শরণার্থীরা যেখানে আশ্রয় নিয়েছে ভারতের সেই সীমান্ত এলাকগুলােতেও পরিস্থিতি ভিন্নতর নয়। কিন্তু শরণার্থী শিবিরগুলােতে অপুষ্টির মাত্রা আরাে তীব্র হয়েছে এখানকার গাদাগাদি ভিড়, পয়ঃনিষ্কাশনের দুর্বল ব্যবস্থা, দূষিত জল ইত্যাকার কারণে। তার সঙ্গে যােগ হয়েছে দীর্ঘ পথ হেঁটে আসার কারণে শরণার্থীদের দুর্দশা। ফলে উপমহাদেশে অপুষ্টির যে মাত্রা তার চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থা শরণার্থী শিবিরগুলাের। সভ্রান্ত প্রতিষ্ঠান অল ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স পরিচালিত মাঠ পর্যায়ের এক জরিপ থেকে দেখা যায় যে ৫ বছরের কমবয়েসী শরণার্থী শিশুদের প্রায়। ৫০ শতাংশ প্রােটিন ও ভিটামিন ঘাটতিজনিত ‘মােটামুটি তীব্র অথবা তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে, প্রায় সকল ক্ষেত্রেই অপুষ্টির সঙ্গে যােগ হয়েছে অন্যান্য রােগ ও সংক্রমণ, যেমন ডায়রিয়া, পাতলা পায়খানা, নিউমােনিয়া ইত্যাদি। অনেক শিশুই একসঙ্গে তিন-চারটি রােগে আক্রান্ত হয়েছে। | রিপাের্টে বলা হয়েছে : এমন কি সাধারণ অসুখও এইসব বঞ্চিত শিশুর বাঁচা-মরার পাল্লা হেলিয়ে দেয়। নিরসনমূলক ব্যবস্থা জরুরিভাবে না নেওয়া হলে বিপুল সংখ্যক বাচ্চা ও শিশুর মৃত্যু ঘটবে। তাছাড়া এই শিশুদের মধ্যে ব্যাপকভাবে জড়বিকাশের সমস্যা দেখা দেওয়ার প্রশ্ন তাে রয়েছেই।
দুই মাসের পুরনাে রিপাের্টে
ভারত সরকারকে তৎপর করে তােলার ক্ষেত্রে এই রিপাের্টের বিশেষ অবদান রয়েছে বলা হলেও এটা লক্ষণীয়, আজ থেকে দু-মাস আগে সরকারের কাছে এটা হস্তান্তর করা হয়েছে। রিপাের্টে বলা হয়েছে যে, প্রায় ৩ লক্ষ শিশু ‘জীবনমৃত্যুর এমন বিপজ্জনক প্রান্তে এসে পৌঁছেছে, যেখানে কোনাে ধরনের রােগ সংক্রমণ তাদের বেশিরভাগের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে। প্রােটিন ও ক্যালরিযুক্ত সহায়ক খাবারের জরুরি কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে রিপাের্টে বলা হয় যে, সবকিছুর মূলে রয়েছে কত কম সময় নেওয়া হয় সেই প্রশ্ন। অন্যান্য পুষ্টি-বিশারদরাও সঙ্কটাপন্ন শিশুর সংখ্যা ৩ লক্ষ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে এই হিসেব করা হয়েছিল যখন শরণার্থীদের সংখ্যা ছিল অনেক কম। বর্তমানে প্রতিদিন যখন ৩০,০০০ উদ্বাস্তু ভারতে প্রবেশ করছে সেক্ষেত্রে আট বছরের কম বয়েসী শিশুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১.৭ মিলিয়ন বা ১৭ লক্ষ। আর এটাও মনে রাখতে হবে এটা হচ্ছে যারা শিবিরে বাস করছে তাদের সংখ্যা। ৯০ লক্ষ শরণার্থীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আশ্রয় শিবিরের বাইরে আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে বাস করছেন। অধিকন্তু শিবিরবাসীদের মধ্যে রয়েছে প্রায় ৫ লক্ষ সন্তানসম্ভবা ও বুকের দুগ্ধদানকারী মাতা, যাঁদের জন্যও দরকার সহায়ক আহার্য কর্মসূচি।
কর্মসূচির দুই অংশ
২০ লক্ষ এমনি দুঃস্থপীড়িতদের জন্য মেডিক্যাল ইন্সটিটিউটের রিপাের্টে যে অপারেশন লাইফলাইন কর্মসূচির সুপারিশ করা হয়েছে তার রয়েছে সুস্পষ্ট দুটি অংশ। প্রথম অংশের নাম দেয়া হয়েছে আলফা, মূলত নিবারণমূলক উদ্দেশ্যে এটি প্রণীত হয়েছে। এর লক্ষ্য হলাে শিবিরগুলােতে ১০০০ বা ততােধিক ফিডিং স্টেশন প্রতিষ্ঠা যা চরম পীড়িতদের গুঁড়াে দুধ ও উচ্চপ্রাণশক্তিসম্পন্ন খাবার যােগাবে। রিপাের্ট অনুসারে এর উদ্দেশ্য হলাে, যেসব শিশু পুষ্টিজনিত ঘাটতির প্রাথমিক স্তরে রয়েছে এবং অসুস্থ হয়ে পড়ছে তারা যেন আর অধিকতর তীব্র অপুষ্টির শিকার না হয় সেজন্য প্রতিরােধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। কিছু কিছু আলফা স্টেশন ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে। দ্বিতীয় অংশ, এখনও যা শুরু হয় নি, হচ্ছে কঠিন অসুস্থদের জন্য চিকিৎসামূলক কর্মসূচি বেটা। ৬,২৫,০০০ শিশুকে নিরাময় করে তােলারলক্ষ্যে এটি প্রণীত। এই উদ্দেশ্যে শিবির হাসপাতালের সঙ্গে ৫০০ পুষ্টিমূলক থেরাপি সেন্টার খােলা হবে, যেখানে জীবনরক্ষামূলক প্রয়াস হিসেবে অপুষ্টিজনিত জটিল রােগাক্রান্ত শিশুদের ভর্তি করে দরকার মতাে এক থেকে দুই মাস অবধি রেখে পরম সেবা প্রদত্ত হবে। ইউনিসেফ-এর সহায়তা গােটা কর্মসূচির জন্য প্রয়ােজনীয় উপকরণ যােগাবে ইউনিসেফ এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রদত্ত সাহায্য তহবিলের অর্থ দিয়ে এইসব সামগ্রী কেনা হবে। তবে প্রকল্প পরিচালনা করবে অন্যেরা, আলফা চালাবে স্বেচ্ছাসেবী রিলিফ সংস্থার সহযােগিতায় ভারতীয় রেডক্রস এবং বেটা পরিচালনা করবে ভারত সরকারের পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়। প্রকল্প গ্রহণে বিলম্ব ঘটার অন্যতম কারণ হচ্ছে বেটা পরিচালনা নিয়ে পুনর্বাসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে টানাহ্যাচড়া। তবে বিলম্বের প্রধান কারণ হচ্ছে যেখানে স্থানীয় জনসাধারণের ভেতরে প্রকট না হলেও একই ধরনের সব সমস্যাবিদ্যমান, সেখানে শুধু শরণার্থীদের জন্য সহায়ক আহার্য যােগানাের এমন একটি ব্যাপক কর্মসূচি প্রবর্তনে ভারত সরকারের অনীহা। শরণার্থী শিবিরে পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে, বিশেষভাবে বর্ষার কারণে, ভারত সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তারা কর্মসূচি অনুমােদন করে। রিলিফ কর্মীরা সরকারকে এই আশ্বাস দিয়েছে যে অপুষ্টির কারণে গুরুতরভাবে পীড়িত স্থানীয় শিশুদের বেটা কেন্দ্র থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, যেখানে ৯ মিলিয়ন শরণার্থীর প্রায় ৭ মিলিয়ন আশ্রয় নিয়েছে, একটি সাংবৎসরিক দুর্গত এলাকা, সম্ভবত এটি ভারতের চরম দারিদ্র্যপীড়িত এলাকা।
উত্তেজনার প্রসার
স্থানীয় জনগণ ইতিমধ্যেই সােচ্চার অভিযােগ তুলছে শরণার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত বিনামূল্যের রেশনের পরিমাণ নিয়ে পশ্চিমবাংলার অধিকাংশ দরিদ্রজনের এমনি খাবার কেনার সঙ্গতি নেই। স্থানীয় জনগণ ও শরণার্থীদের মধ্যে টেনশন বেড়ে চলছে। উদাহরণত শরণার্থী শিবিরগুলােতে সবরকম চিকিৎসা সমস্যা মােকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত ডাক্তার না থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের পশ্চাৎপদ এলাকা ও সীমান্ত রাজ্যগুলােতে আনুপাতিক হারে চিকিৎসক রয়েছে তার চেয়েও কম। অত্র অঞ্চলে শিশুমৃত্যুর হার শিবিরগুলাের হারের মতােই উঁচু। পশ্চিমবাংলার কিছু কিছু জেলায় ১৫ বৎসর বয়স হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করে এক-চতুর্থাংশ শিশু। শরণার্থী শিবিরের পরিস্থিতি বাইরে থেকে যেমন দেখা যায় বাস্তব অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। পরিসংখ্যান পাওয়া যায় খুব সামান্য। যেটুকুইবা পাওয়া যায় সেটা ক্যাম্প। হাসপাতাল থেকেই মেলে। এর বাইরেও অস্থায়ী আচ্ছাদনের অন্ধকার কোণে বহু শিশুর । মৃত্যু ঘটছে এবং তাদের বাবা-মায়েরা এমন মৃত্যুর খবর নথিবদ্ধও করে না, কেননা তা ” করা মানেই একজনের বরাদ্দকৃত রেশন হারানাে। | তাছাড়া বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী জ্বর বাডায়রিয়ায় শিশু যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন সাগু ও বার্লি জলে মিশিয়ে পথ্য হিসেবে খাওয়ানাে হয় এবং কোনােরকম শক্ত খাবার তাকে দেওয়া হয় না। এর অর্থ অপুষ্ট শিশুর যখন খাবারের প্রয়ােজন সবচেয়ে বেশি তখন তাকে দেওয়া হয় সবচেয়ে কম খাবার। শীতকাল এলে শিবিরে দুর্গতি আরাে বাড়বে। কম্বল প্রয়ােজন অন্তত ৩ মিলিয়ন, এপর্যন্ত এসে পৌঁছেছে খুব সামান্যই। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য ঘাটতি বৃদ্ধি পেলেও শরণার্থী আগমন বেড়ে যাবে। কর্মকর্তারা অনুমান করছেন সীমান্তবর্তী জেলাগুলাে প্রায় ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর নতুন শরণার্থীদের আগমন ঘটবে দেশের অনেক ভেতর থেকে, তার অর্থ যে ৯ মিলিয়ন শরণার্থী এ-পর্যন্ত এসেছে তাদের চেয়ে দীর্ঘতর পথ অতিক্রম করে দুর্বলতর অবস্থায় এসে পৌছুবে নবাগতরা। বিগত সপ্তাহগুলােতে যেসব শরণার্থী এসেছে তাদের বেশির ভাগই দূরবর্তী জেলার লােক। কলকাতার কাছাকাছি এক শিবিরের শিশু হাসপাতালের ডাক্তার বললেন, “এদের অনেকে এমন অবস্থায় এখানে এসে হাজির হয়েছে যে আর কিছু করার নেই—অত্যন্ত সঙ্গিন অবস্থা তাদের। আমাদের আর কিছু করার থাকে না।
সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ