You dont have javascript enabled! Please enable it!

গত কয়েক মাসে নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্কের গুরুতর  অবনতি ঘটেছে। ভারত ও আমেরিকার মধ্যে ভুল বােঝাবুঝি ব্যতিক্রমের চাইতে নিয়ম হিসেবেই সবসময় থেকেছে বেশি, তা সত্ত্বেও এবারের ফারাক মনে হচ্ছে  অনেক গভীর, তিক্ত ও মৌলিক এবং খুব  সহজে এর প্রশমন হবে বলেও মনে হচ্ছে না। ভারতীয় পক্ষের তিক্ততার কারণ খুব পরিষ্কার–পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে পাকবাহিনী  পরিচালিত পাঁচমাসকালের সামরিক অত্যাচারের প্রকাশ্য নিন্দাবাদ করার ক্ষেত্রে নিক্সন প্রশাসনের অস্বীকৃতি। পুরনাে এক চুক্তির আওতায় পাকিস্তানকে কিছু কিছু অস্ত্রের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে নিক্সন প্রশাসনের সিদ্ধান্তও ভারতের উম্মার কারণ ঘটিয়েছে। এখানকার কূটনীতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন যে, ওয়াশিংটন হয় বুঝতে পারে নি অস্ত্রের চালান ভারতে কতটা ক্রোধের সঞ্চার ঘটাবে অথবা তারা এর কোনাে পরােয়াই করে না। অস্ত্রের চালান যদি কয়েক বাক্স বুলেট ও খুচরাে যন্ত্রাংশ হতাে তাহলেও দেখা দিতাে মার্কিন-বিরােধী ক্ষোভ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে অস্ত্র সরবরাহের পরিমাণ হচ্ছে ৬.২ মিলিয়ন ডলার। কোনাে কোনাে সিনেটরের মতে এই পরিমাণ ৩৫ মিলিয়ন ডলারের মতাে সুউচ্চ। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে আশি লক্ষ শরণার্থী ভারতে পালিয়ে এসেছে তাঁরা দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতি এবং পূর্ব ভারতের বিস্ফোরণােন্মুখ সামাজিক বাতাবরণের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে। 

উত্তেজনাকর মােকাবেলা

এই সঙ্কটের ফলে প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত ভারত ও মুসলিম দেশ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী মুখােমুখি হয়েছে চরম উত্তেজনা নিয়ে। পরিস্থিতি জাগিয়ে তুলছে পুরনাে তিক্ত স্মৃতি, দেশবিভাগের সময়কার হিন্দু-মুসলিম রক্তস্নান এবং ১৯৪৭ ও ১৯৬৫ সালের স্বল্পস্থায়ী ভারত-পাক যুদ্ধ। এই পটভূমিকায় যে আবেগ এখানে মথিত হয়ে উঠছে তা অনুমানযােগ্য। বিশ্লেষকরা মনে করেন মার্কিন নীতির এই বিভ্রাটের কোনাে একটি বিশেষ কার্যকারণ যদি নির্দেশ করতে হয়, তাহলে বলতে হবে, ভারতীয়দের মনস্তত্ত্ব ও মনােভাব উপেক্ষা করা হয়েছে। বিদেশ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, “এখানে যে একটি নৈতিক প্রশ্ন জড়িত রয়েছে তা আমেরিকা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই ঘটনার শিকার। এটা পাইকারি গণহত্যার ঘটনা। এটা নিশ্চিতভাবে অমানবিক ঘটনা। এবং এটা আমেরিকার দিক থেকে চরম শীতল মনােভাব পােষণের নিদর্শন। এই মনােভঙ্গি কেবল সরকারে সীমিত নেই, ভারতীয় জীবনের সকল স্তরে এর দেখা মিলবে। গড়পড়তা ভারতীয়রা মনে করেন আমেরিকা দাঁড়িয়েছে অশুভের পক্ষে, গণহত্যার সমর্থনে ও ভারতের শত্রু পাকিস্তানের পাশে। বাঙালি শরণার্থীদের জন্য প্রদত্ত আমেরিকার উল্লেখযােগ্য পরিমাণ সহায়তা জনচিত্তে সামান্যই দাগ কাটতে পেরেছে।

মার্কিনপন্থীরা সমালােচনামুখর

এমন কি সচরাচর যাঁরা মার্কিনপন্থী তাঁরাও হয়ে উঠেছেন বৈরীভাবাপন্ন। সম্প্রতি প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে : ‘অদ্যাবধি নিক্সন প্রশাসন বিপুলা এই মানব-ট্র্যাজেডির মুখােমুখি হয়ে ইচ্ছেকৃতভাবে একটা সিনিক দৃষ্টিভঙ্গি বহাল রেখে চলেছে। এই নীতি তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে মার্কিন জনমত থেকেও, মার্কিন পত্রপত্রিকা ও অন্যান্য গণমাধ্যমে যার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।’ সহানুভূতিসম্পন্ন আমেরিকান জনগণ ও ‘শীতল’ প্রশাসনের মধ্যে যে ফারাক টেনে চলেছে ভারতীয়েরা তার প্রতিফলন দেখা যায় উদ্ধৃত বাক্যটির শেষাংশে। মার্কিন-বিরােধী মনােভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ের কিছু নেই এবং এখানে বসবাসরত আমেরিকানদের প্রতি শারীরিক হুমকির কোনাে প্রকাশ কোথাও দেখা দেয় নি। এখানকার আমেরিকান কূটনীতিকরা বলছেন মার্কিন নীতি প্রণীত হয়েছে বাস্তববাদী, আবেগমুক্ত, নীরব, গঠনমূলক ও পরিশীলিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। উভয় শিবিরে অবস্থান বজায় রাখা, ভারতকে সংযত ও নতুন একটা যুদ্ধ শুরু করা থেকে পাকিস্তানকে বিরত রাখা এবং উপমহাদেশের স্থিতিশীলতা অর্জন হচ্ছে এই নীতির লক্ষ্য। এই কূটনীতিকরা আরাে বলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোনাে কঠোর বিবৃতিদান অথবা পদক্ষেপ গ্রহণ পরিহার করে আমেরিকা প্রেসিডেন্ট আগা এম. ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারের ওপর চাপ প্রয়ােগের ক্ষমতা হাতে রাখতে চাইছে। নির্ভরযােগ্য সূত্রের অভিমত হলাে, আমেরিকা পূর্ব পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক সমাধান অর্জিত হওয়ার আশা রাখে এবং বর্তমান ইয়াহিয়া সরকারাধীন অখণ্ড পাকিস্তানই এটা অর্জন করার শ্রেষ্ঠ  করে।

এই সূত্র আরাে জানায় যে, পরিস্থিতির অবনতি ঘটানাের জন্য মার্কিন প্রশাসন ভারতের প্রতি বিরক্ত। বাঙালি গেরিলাদের নিরাপদ আশ্রয় ও সামরিক সহায়তা যুগিয়ে ভারত এটা করছে। প্রেসিডেন্ট নিক্সন জনসমক্ষে তাঁর নীতি নিয়ে কেবল একবারই কথা বলেছেন। পূর্ব পাকিস্তানে ‘মােটামুটি স্থিতিশীলতা’ প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানেসব ধরনের সাহায্য প্রদান স্থগিত রাখা সংক্রান্ত একটি বিল প্রতিনিধি পরিষদে গৃহীত হওয়ার পরের দিন ৪ আগস্ট ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনের মুখবন্ধ করার সময় তিনি এ বিষয়ে আলােকপাত করেন। নিক্সনের ব্যাখ্যা প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রতিনিধি পরিষদের পদক্ষেপের সমালােচনা করে বলেন যে, এর ফলে পাকিস্তানের শক্তি ‘গুরুতরভাবে বিপদগ্রস্ত হবে। তিনি আরাে বলেন, “আমাদের বিবেচনায় সবচেয়ে গঠনমূলক যে ভূমিকা আমরা পালন করতে পারি তা হলাে পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের অর্থনৈতিক সহায়তা অব্যাহত রাখা এবং ঘটনার গতিধারা প্রভাবিত করতে সক্ষম থাকা। পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের ওপর কোনাে প্রকাশ্য চাপ সৃষ্টি করতে যাচ্ছি না আমরা। এটা হবে সম্পূর্ণ নিষ্ফলা।’ নয়াদিল্লির কর্মকর্তারা মনে করেন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাম্প্রতিক বিশ্বজনীন চাল বিশেষভাবে কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপনে তাঁর পদক্ষেপ—ওয়াশিংটনের কাছে ভারতের গুরুত্ব আরাে কমিয়ে দিয়েছে। একজন বৈদেশিক পর্যবেক্ষক বলেছেন, নতুন সােভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তি কোনাে বাস্তব ফলাফল দিক আর নাদিক, ‘ভারতীয়রা এটা মনে রাখবে যে প্রয়ােজনের সময় রাশিয়ানরা তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল এবং তাদের। পরিত্যাগ করেছিল আমেরিকানরা। মার্কিন-ভারত সম্পর্কে যে ফাটল ধরেছে তাসংস্কার করার জন্য উভয় দিক থেকে এখন কোনাে বড় উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এখানে সর্বজনস্বীকৃত মত হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে মেরামতি যাই করা হােক উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক কখনােই আর আগের মতাে হবে না। মার্কিন নীতিতে কোনাে নাটকীয় পরিবর্তন অথবা একটি ডেমােক্রেটিক দলীয় প্রশাসন। হয়তাে অবস্থা পাল্টে দিতে পারে কিন্তু তাহলেও আবেগপ্রবণ ভারতীয় স্মৃতি থেকে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলির ছাপ কখনােই সম্পূর্ণ মুছে যাবে না। নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি এবং ভারত-সােভিয়েত চুক্তি ও অন্যান্য বিষয় ব্যাখ্যার জন্য প্রধান প্রধান পশ্চিমা দেশ সফরকালে ওয়াশিংটনেও আসবেন। তখন হয়তাে ওপর-ভাসাভাবে সম্পর্কোন্নয়নে কিছু কাজ করা হবে।

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!