You dont have javascript enabled! Please enable it!

পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত সর্বশেষ শরণার্থী দল জানাচ্ছে যে, স্বাভা বিকতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বাঙালি জনগণের আস্থা অর্জনে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকাশ্য ঘােষণা সত্ত্বেও পাকবাহিনী ও তাদের বেসামরিক সহযােগীরা হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ অব্যাহত রেখেছে। | বিগত এক সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে পালিয়ে আসা এমনি কয়েক ডজন শরণার্থীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন বর্তমান সংবাদদাতা এবং তাঁরা সবাই সৈন্যদের দ্বারা বেসামরিক নাগরিক হত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য ধরনের নিপীড়ন পরিচালনার বর্ণনা দিয়েছেন। কলকাতা থেকে ৬০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে এবং সীমান্ত থেকে প্রায় চার মাইল ভেতরে এই গ্রামে জল থকথকে, শরণার্থী-ওপচানাে শিবিরে কথা বলার সময় সীমান্ত এলাকা। থেকে গােলাবর্ষণের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। পাকবাহিনী, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী দল, নাকি বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী, কারা যে এই গােলা ছুঁড়ছে হলফ করে বলা মুশকিল। যেসব শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে তাঁদেরঅধিকাংশই এসেছেন ফরিদপুর থেকে, কারাবন্দী বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুররহমানের পৈতৃক জেলা এটি। প্রায় সবাই হিন্দু শরণার্থীরা জানায়, সাধারণভাবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হলেও প্রাণনাশের শঙ্কা দেখা-না-দিলে তাঁরা থেকেই যেতেন। নবাগত উদ্বাস্তুদের প্রায় সবাই হিন্দু তাঁরা জানান, সামরিক কর্তৃপক্ষ এখনও হিন্দুদের আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তু করে। রেখেছে। তারা আরাে জানান, তাঁদের এলাকায়  গেরিলারা তৎপর রয়েছে এবং প্রতিটি গেরিলা হামলার পর বেসামরিক নাগরিকদের ওপর প্রতিশােধমূলক আক্রমণ চালানাে হয়।  ফরিদপুর জেলার এক চাল ব্যবসায়ী নিত্যপদ সাহা গেরিলাদের আহার ও আশ্রয়প্রদানকারী তাঁর বাড়ির নিকটবর্তী গ্রামের দুর্ভাগ্য বর্ণনা করেন। তাঁর দেশত্যাগের পাঁচদিন আগে পাক আর্মি গ্রাম আক্রমণ করে, প্রথমে গােলাবর্ষণ করে এবং পরে ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তিনি বলেন, গ্রামবাসীদের কেউ কেউ চটজলদি পালাতে পারে নি। সৈন্যরা তাদের ধরে হাত-পা বেঁধে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে।’ শ্রী সাহা বলেন, গ্রামে ৫০০০ লােকের বাস ছিল, এদের বেশিরভাগই হিন্দু। গ্রামে এখন একটি বাড়িও অক্ষত নেই।

‘বাজে কাজ করছে অন্যরা শরণার্থীদের মতে, সেনাবাহিনী যাবতীয় ‘নােংরা কাজ সম্পাদনের দায়ভার ছেড়ে দিয়েছে। বেসামরিক সহযােগীদের ওপর। সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিনের সমর্থক দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় দল জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের সমর্থকদের তারা অস্ত্র প্রদান করেছে। রাজাকার বা হােমগার্ড এবং এইসব সশস্ত্র ব্যক্তি যাবতীয় ‘নােংরা কাজের দায়িত্ব পেয়েছে। উদ্বাস্তুরা জানায়, গেরিলাদের সাহায্যকারীদের পরিচয়, তাঁদের বাড়ি ও গ্রাম চিনিয়ে দিতে দালালরা পাক আর্মির গােয়েন্দা এজেন্ট ও দক্ষিণহস্ত হিসেবে কাজ করছে। প্রায়শ দালালরা কোনাে কারণ ছাড়াই লােকজনকে যথেচ্ছ গ্রেফতার করছে। | বরিশাল জেলার রেডিও মেকানিক দীপককুমার বিশ্বাস জানান, ‘রাজাকার ও অন্যরা গ্রামে ঢুকে প্রথমে যে কোনাে একটা বাড়ি বাছাই করে। এরপর তারা সেই বাড়িতে শক্তসমর্থ যাকেই পাবে ধরে নিয়ে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেবে। এদের নিয়ে পাকবাহিনী কি করে আমার তা জানা নেই। তবে তারা আর কখনাে ফিরে আসে না। শরণার্থীরা জানান, প্রতিশােধমূলক তৎপরতা ও কড়া নজরদারী সত্ত্বেও স্থানীয় জনগণ গেরিলাদের তথ্য, আহার ও আশ্রয় যুগিয়ে চলেছে। | ধানচাষী মাখনলাল তালুকদার জানালেন, কয়েকদিন আগে গ্রামের হাটে হঠাৎ চড়াও হয়ে ভিড়ের ওপর রাজাকারদের এলােপাতাড়ি গুলিবর্ষণের পর তিনি পালিয়ে এসেছেন। গুলিতে ছয়জন নিহত ও অনেকে হতাহত হয়। শরণার্থী আগমন চলছে। পরিবারের আটজন সদস্যকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে এসেছেন শ্রী তালুকদার। তবে চলৎক্ষমতাহীন বয়ােবৃদ্ধ পিতাকে লুকিয়ে রেখে আসতে হয়েছে।

হাটের ঐ ঘটনার পর তাঁদের এলাকা থেকে প্রায় ১৫,০০০ লােক পালিয়ে ভারত চলে এসেছে বলে শ্রী তালুকদার জানান। প্রতিদিন ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ শরণার্থী ভারতে আসছে—যােগ দিচ্ছে ইতিমধ্যে এখানে আশ্রয়গ্রহণকারী লক্ষজনের সঙ্গে, সর্বশেষ  হিসেবে যে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮.৬ মিলিয়ন। পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান শরণার্থীদের ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রত্যাবর্তনকালে তাদের সর্বাত্মক সহায়তাদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এবং গেরিলাদের জন্য ঘােষণা করেছেন সাধারণ ক্ষমা। এইসব প্রতিশ্রুতি শরণার্থীদের মধ্যে তিক্ত হাসির উদ্রেক ঘটায়। অপর এক চাষী। রাজেন্দ্র দাস বলেন, “প্রাণ বাঁচাতে আমরা পালিয়ে এসেছি। পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা ফিরে যাব না।’ | শরণার্থী এলাকাগুলােতে চালের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে, এর ফলে দাম বেড়ে গেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। তবে অন্যান্য খাদ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে বলে প্রকাশ। উদ্বাস্তুরা জানায়, অনেককেই উপােষ থাকতে হচ্ছে। কেননা তাঁদের কোনাে কাজের সংস্থান নেই, হাতে টাকা নেই। | সেনাবাহিনীর আক্রমণ শুরুর পর থেকে অর্থনৈতিক জীবনে গভীর বিপর্যয় ঘটেছে। বিশেষভাবে কষ্টকর হয়ে উঠেছে খেতমজুরদের এবংসরকারি গণপূর্ত প্রকল্পের আওতাধীন শ্রমিকদের জীবন, কেননা এইসব কাজের বেশিরভাগই এখন বন্ধ রয়েছে। 

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!