You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাঙালি দমনের নীতি  নয়াদিল্লি ভারত জুলাই ১৪- ১৯৭১

ইদানীংকালে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী শহরের জনবিরল পথেশ্রম-শিবিরেরজন্য রাষ্ট্রবিরােধী’ বন্দীদের বহনকারী আর্মি ট্রাকের চলাচল বেড়ে গেছে। বন্দীদের মাথার চুল ছাঁটা, পায়ে জুতাে নেই, হাফপ্যান্ট ছাড়া পরনে আর কোনাে বস্ত্র নেই—সব মিলিয়ে পালানাে বেশ দুষ্কর।  প্রতিদিন ঢাকা বিমানবন্দরে হাজার মাইল অনুসরণ করছে। দূরের পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত বিমান পশ্চিম পাকিস্তান নামিয়ে দিয়ে যায় সৈন্যদের, নজর এড়ানাের জন্য তারা উপজাতীয় ঢােলা পাজামা-পাঞ্জাবি। ৩০ জুন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিষ্কৃত নিউইয়র্ক পরে থাকে। টাইমস-এর নয়াদিল্লি সংবাদদাতানিম্নোক্ত বিবরণ।  বাঙালি সংস্কৃতি উৎসাদনের লক্ষ্যে রাস্তার পাঠিয়েছেন। নামফলক থেকে সকল হিন্দু নাম, এমন কি জাতীয়তাবাদী মুসলিম নামও, মুছে ফেলা হচ্ছে। বাঙালিরা যাকে বলে থাকে ‘কসাই’, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসক সেই লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের নামে। ঢাকার শাখারী বাজার রােডের নতুন নামকরণ ঘটেছে। এসব হচ্ছে অসংখ্য ঘটনার কয়েকটি মাত্র, বর্তমান সংবাদদাতা পাকিস্তানের পূর্ব প্রদেশের সাম্প্রতিক সফরকালে যা দেখতে পেয়েছে, এবং সেসব থেকে বােঝা যায় যে পাকিস্তানের সামরিক সরকার ৭৫ মিলিয়ন জনগণের এই অঞ্চল পদানত রাখা ও তাদের দখলদারী বহাল রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ভঙ্গুর অর্থনীতি, সরকারি প্রশাসনের ভগ্নদশা, বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ক্রমবিস্তৃত গেরিলা তৎপরতা, সেনাবাহিনীতে হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি ও জনগণের সঙ্গে বর্ধমান ফারাক সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানিরা একগুয়ে প্রচেষ্টাঅব্যাহত রাখছে। পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্যসংখ্যা বাড়াবার উদ্দেশ্যে সরকার ইতিমধ্যে আইরিশ  মালিকানাধীন ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজ-এর কাছ থেকে দু’টি বােয়িং-৭০৭ ভাড়া করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে মােতায়েনকৃত সৈন্য সংখ্যা ৭০,০০০ থেকে ৮০,০০০ বলে জানা গেছে।

প্রতিদিন সৈন্য নিয়ে আসা ছাড়াও সরকার দলে দলে পাকিস্তানিদের নিয়ে আসছে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি দায়িত্বে বসাবার জন্য। দায়িত্বশীল পদে কোনাে বাঙালির ওপরই তাদের আস্থা নেই ; এমন কি ঢাকা বিমানবন্দরে ঘাস কাটে যে ব্যক্তি সেও একজন অবাঙালি।  বাঙালি ট্যাক্সি ড্রাইভারদের দেখাও বিশেষ মেলে না। তাদের বদলে নেওয়া হয়েছে। ভারত থেকে আগত উদ্বাস্তু অবাঙালি বিহারি মুসলমানদের যারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের আধিপত্যাধীন সরকারের পক্ষ নিয়েছে এবং সেনাবাহিনীর বেসামরিক বাহু হিসেবে কাজ করে তাদের খবরাখবর ও মদদ যােগাচ্ছে। | পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষার ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে তার পরিবর্তে উর্দু চালু করতে চাইছে। সৈনিকরা অবজ্ঞার সঙ্গে বাঙালিদের জানাচ্ছে যে তাদের ভাষা কোনাে সভ্য ভাষা নয় এবং জীবনে কিছু করতে চাইলে তাদের উচিত হবে ছেলেমেয়েদের উর্দু শিক্ষাদান। ভীত ব্যবসায়ীরা বাংলার বদলে ইংরেজি সাইনবাের্ড বসাচ্ছে, কেননা উর্দুভাষা তাদের অজানা। শান্তি কমিটি গঠন গােটা পূর্ব পাকিস্তানে আর্মি নতুন আধা-সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং ‘অনুগত নাগরিকদের সশস্ত্র করে তুলছে, যাদের কাউকে কাউকে নিয়ে আবার শান্তি কমিটি গঠন করছে। বিহারি এবং অন্যান্য অবাঙালি উর্দুভাষী রিক্রুট ছাড়াও রয়েছে সেনাবাহিনীর দীর্ঘকালের সমর্থক এক ক্ষুদ্র বাঙালি মুসলিম গােষ্ঠী—এরা মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর মতাে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের সমর্থক।

বিগত ডিসেম্বরের নির্বাচনে এই দলগুলাে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় সংসদের একটি আসনেও জয়লাভ করতে পারে নি। এক অর্থে নির্বাচনই সঙ্কট বয়ে এনেছে, কেননা প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের জন্য। আন্দোলনকারী দল আওয়ামী লীগ অপ্রত্যাশিতভাবে জাতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ইতিপূর্বে অবদমিত বাঙালিরা যখন জাতীয় ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা নিতে যাচ্ছিল তখন পশ্চিম পাকিস্তানের অগ্রণী রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশনে যােগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় এই অধিবেশনে নতুন সংবিধান রচনার মাধ্যমে পাকিস্তানে বেসামরিক শাসন সূচিত হওয়ার কথা ছিল এবং পিপলস পার্টির পদক্ষেপে সাড়া দিয়ে প্রেসিডেন্ট আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করেন। আলােচনা ও আক্রমণ। পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদ ও দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু হয়ে যায় এবং সামরিক শাসন অগ্রাহ্য করে  আওয়ামী লীগ আহূত অসহযােগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেয় বাঙালিরা। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলােচনার জন্য বিমানযােগে ঢাকা আসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। আলােচনা চলাকালে ২৫ মার্চ রাতে স্বাধিকার আন্দোলন দমন করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের ওপর আকস্মিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘােষিত হয় এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে শেখ মুজিবকে বন্দী করা হয়। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পক্ষবদলকারী সদস্যদের পরিচালনায় প্রথমদিককার বাঙালি প্রতিরােধ দ্রুতই ছত্রখান করে দেয়া হয়। কিন্তু এখন ভারতীয় সীমান্তবর্তী নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে নতুন রিক্রুট ও সরবরাহ ব্যবস্থায় বলীয়ান হয়ে গড়ে উঠছে ভিয়েতনাম-ধাঁচের গেরিলা যুদ্ধ—পাকবাহিনীর জন্য এই যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়ছে। আক্রমণ শুরুর পর থেকে পাকবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে অসংখ্য বাঙালি—বিদেশী কূটনীতিকদের হিসেবে ২০০,০০০ থেকে ২৫০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে—যার বেশিরভাগ প্রাণ দিয়েছে গণহত্যাযজ্ঞে। যদিও পাক আর্মির প্রথমদিককার টার্গেট ছিল বাঙালি মুসলমান ও ১০ মিলিয়ন হিন্দু জনগােষ্ঠী, এখন আর্মি হিন্দুদের ওপরই মনােনিবেশ করছে বেশি এবং বিদেশী পর্যবেক্ষকরা একে ধর্মযুদ্ধ বলে চিহ্নিত করছে। 

পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা বহুকাল যাবৎ হিন্দুদের ইসলামের অনিষ্টকারী হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। এখন তারা এদের দেখছে হিন্দু ভারতের এজেন্ট হিসেবে, প্রতিবেশী যে দেশ পাকিস্তান ভাঙার লক্ষ্যে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের ষড়যন্ত্র বিস্তার করেছে বলে পাকিস্তানের অভিযােগ। সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যে ছয় মিলিয়ন বাঙালি ভারতে পালিয়ে গেছে বলে মনে করা হয়, তাদের মধ্যে অন্তত চার মিলিয়ন হচ্ছে হিন্দু। সেনাবাহিনী এখনও হিন্দুদের হত্যা করছে, তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তবে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা দাবি করছে যে, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। এবং হিন্দুদের প্রতি তাদের বাড়িঘরে ফিরে আসার জন্য আবেদন জানিয়ে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে তাদের আর ভয়ের কিছু নেই। শুধু মুষ্টিমেয় কয়েকজন উদ্বাস্তু ফিরে এসেছে। এবং বিদেশীদের দেখাবার জন্য সরকার যেসব অভ্যর্থনা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিল সেগুলাে প্রায় ফাঁকা হয়ে আছে। সাহায্য পুনরায় চালুর আবেদন সেনা কম্যান্ডাররা সম্প্রতি বলে বেড়াচ্ছে যে, নিম্নবর্ণের হিন্দুদের তাদের বাড়িঘরে ফিরে আসাকে স্বাগত জানানাে হবে। পর্যবেক্ষকরা এই সদিচ্ছা প্রকাশকে সন্দেহের চোখে দেখছেন, তাঁরা উল্লেখ করছেন যে ধাঙড়, ঝাড়ুদার, ধােপা ইত্যাদি নিম্নবর্ণের হিন্দু ছাড়া নােংরা কাজ করানাের জন্য আর কোনাে নির্ভর আর্মির নেই। ভারতে চলে যাওয়া উদ্বাস্তু ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানে আরাে লক্ষ লক্ষ গৃহচ্যুত বাঙালি রয়েছে সেনা অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে যাঁরা ঘর ছেড়ে পালিয়েছিল এবং এখনও ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছে।

জনচক্ষুর অপেক্ষাকৃত অগােচরে এবং অধিকতর সূক্ষ্মভাবে অপারেশন পরিচালনার জন্য ইদানীং সেনাবাহিনীকে যে আদেশ দেয়া হয়েছে তার কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বিদেশী কূটনীতিকদের মতে, এই আদেশ দেওয়া হয়েছে অর্থনৈতিক সাহায্য পুনরায় চালু করতে ১১-জাতি কনসাের্টিয়ামকে উদ্বুদ্ধকরণে পাকিস্তানি আকাঙ্ক্ষা থেকে। সেনাবাহিনীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-স্বরূপ সাহায্য সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে। | সাহায্য কর্মসূচিরসমন্বয়কারী বিশ্বব্যাঙ্কের একটি বিশেষ মিশনসম্প্রতি রিপাের্ট করেছে। যে, পূর্ব পাকিস্তানে মিলিটারি যে ধ্বংসযজ্ঞ করেছে তাতে অন্তত এক বছর উন্নয়ন কর্মসূচি স্থগিত থাকবে। মে-জুন মাসে পূর্ব প্রদেশে এই মিশন ব্যাপক জরিপ চালিয়েছিল। সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশীদের যথেচ্ছ চলাফেরার অনুমােদন এবং সেনা অভিযানের শুরুতে বহিস্কৃত বিদেশী সাংবাদিকদের পুনরায় প্রবেশের অনুমতিদানকে ঢাকাস্থ কূটনীতিকরা সাহায্য পুনরায় চালুর অভিযানের অংশ হিসেবে বিবেচনা করছে। এতদসত্ত্বেও হত্যাকাণ্ড থামে নি, যদিও এখন তা অনেক নির্বাচিত এবং ততাে পাইকারি। নয়। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন পরিস্থিতি একটি দীর্ঘ রক্তাক্ত সগ্রামের দিকে গড়াবে। | বিদেশী মিশনারিরা, যারা এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের দূরবর্তী কোণেও কর্মরত রয়েছেন, তাঁরা প্রতিদিনই নতুন নতুন গণহত্যার সংবাদ জানাচ্ছেন। একজন মিশনারি বলেছেন যে, দক্ষিণে বরিশাল জেলার এক অঞ্চলে পাক আর্মি প্রতিদিন এক হাজারেরও বেশি হিন্দুকে হত্যা করছে। আরেক খবরে জানা যায় যে, উত্তর-পশ্চিমে সিলেট জেলায়, ‘শান্তি কমিটি একটি সভা আহ্বান করে, সৌহার্দ্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে। সবাই যখন এসে জড়াে হয়েছে তখন সৈন্যরা সেখানে হাজির হয়। সমাবেশ থেকে তারা ৩০০ জন হিন্দুকে বাছাই করে দূরে সরিয়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।’ 

যখনই কোনাে বাঙালি প্রকাশ্যে বিদেশী কারাে সঙ্গে কথা বলেন তিনি বিপদের ঝুঁকি নেন। ফেরি পারাপারের সময় বর্তমান সংবাদদাতার গাড়ির কাছে এসে বাঙালিরা ফিসফিসিয়ে জানায় আর্মির সন্ত্রাস সম্পর্কে বিক্ষিপ্ত তথ্য অথবা চকিত হেসে জানায় মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা হামলার খবর। ছয়-সাতজন লােক একত্র হলেই পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য বা পুলিশ এগিয়ে এসে কটমটিয়ে তাকায় বাঙালিদের দিকে এবংতারা ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ে। | সৈন্য ও বেসামরিক গুপ্তচরদের উপস্থিতি সত্ত্বেও বাঙালিরা বিদেশী সংবাদদাতাদের তাঁদের কাহিনী জানাবার কোনাে-না-কোনাে উপায় বের করে নেয়—কখনাে গাড়িতে কাগজ গুজে দেয় কিংবা আয়ােজন করে গােপন সভার। ঢাকা থেকে সামান্য দূরে এক শহরে এমনি সাক্ষাৎকালে জনৈক ব্যবসায়ী জানান কীভাবে কোনাে কারণ ছাড়াই সৈন্যরা তাঁকে গ্রেফতার করে টাকা-পয়সা, ঘড়ি ছিনিয়ে নেয় এবং থানায় সােপর্দ করে। সেখানে এক রাত কাটাবার পর তিনি ছাড়া পান, তাঁর মতে, অলৌকিকভাবে। ব্যবসায়ী ভদ্রলােক জানান, তিনি সারারাত নামাজ আদায় করে ও দেয়ালের নানা  লেখাজোখা পড়ে কাটান—আগে যারা এখানে আটক ছিলেন তাঁরা এইসব কথা লিখে রেখেছেন। সবগুলাে লেখা প্রায় এক ধরনের, নিজেদের নাম-ধাম, বন্দী হওয়ার তারিখ দিয়ে লেখা হয়েছে, আমি হয়তাে বাঁচবাে না। আমার কি ঘটেছে অনুগ্রহ করে জানাবেন। আমার পরিবারের লােকদের। সহায়সম্পদের বিপুল ক্ষতি হত্যার সঙ্গে সমতালে সর্বত্র সহায়সম্পদের প্রভূত ক্ষতিসাধন করেছে পাকবাহিনী। গ্রাম এলাকায় রাস্তার দু’ধারে কখনাে কখনাে মাইলের পর মাইল বাড়িঘর জ্বালিয়ে ধূলিসাৎকরা হয়েছে। মহানগরী ও শহরগুলােতে ভারি কামানের গােলায় বড় বড় এলাকা ধ্বংসস্থূপে পরিণত করা হয়েছে।

বাঙালিরা বলে সেন্যরা যথেচ্ছ ধ্বংসযজ্ঞে মেতেছে। আমি জানায়, তাদের ওপর আঘাত করা না হলে তারা গুলি ছোঁড়ে না। অথচ ফিল্ড কম্যান্ডাররা গর্বের সঙ্গে জানাচ্ছেন, বেশিরভাগ শহরেই প্রতিরােধ যৎসামান্য কিংবা নেই বললেই চলে। তাহলে কেন এতাে ধ্বংসলীলা? একথা জিজ্ঞেস করলে বাঁধা জবাব মেলে, সব হচ্ছে। ‘দুষ্কৃতকারীদের কারসাজি। যদিও কিছু কিছু বাঙালি জন-অধ্যুষিত এলাকাগুলােতে ফিরে যাচ্ছে, বেশিরভাগ শহরই প্রায় ফাঁকা, অথবা জনসংখ্যা আগের চাইতে কম। দেশের কতক এলাকা, যেমন উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, কার্যত ফাঁকা হয়ে গেছে। | অযত্নে পড়ে থাকা ধানখেত আগাছায় ভরে গেছে। যেসব পাটখেতে আগে কয়েক ডজন দিনমজুর কাজ করতাে এখন সেখানে উবু হয়ে কাজ করছে গুটিকয় কামলা। পূর্ব পাকিস্তানের পাট, যা থেকে বস্তার শক্ত সুতাে তৈরি হয়, জাতীয় অর্থনীতির মূল নির্ভর। পাট হচ্ছে সর্ববৃহৎ একক রপ্তানি পণ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী। যেসব ইঙ্গিত মিলছে তার থেকে বােঝা যায় এবার ফলন হবে কম। | উৎপাদন যদি বেশিও হয় তাহলেও দক্ষ শ্রমিকদের বিপুলভাবে কারখানা ত্যাগের ফলে। পাটকলগুলাে তা সামাল দিতে পারবে না। কারখানাগুলাে উৎপাদন ক্ষমতার অনেক নিচে চালু রয়েছে। নৌ-চলাচল ব্যাহত সামরিক পরিবহন বিঘ্নিত এবং নৌপথে উৎপাদিত পাট কারখানায় পৌছনাে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে বিদ্রোহীরা নৌচলাচলের ওপর অব্যাহতভাবে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। যশাের-খুলনা অঞ্চলে ইতিমধ্যে তারা কয়েকটি পাট বােঝাই বার্জ ডুবিয়ে দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের চা শিল্পের ক্ষয়-ক্ষতি আরাে মারাত্মক। পশ্চিম পাকিস্তানের চাহিদা মেটাতে ইতিমধ্যে পাকিস্তান সরকার বিদেশে দুই মিলিয়ন পাউন্ডের ওপর অর্ডার পাঠিয়েছে। রক্তপাত সঙ্টনের অন্যতম কারণ হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি। আরেকটি  কারণ হচ্ছে হালকা-বর্ণ মধ্যপ্রাচ্যীয় পাঞ্জাবি, পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর যাদের আধিপত্য, তাদের সঙ্গে পূর্বের দক্ষিণ-এশীয় গাঢ়বর্ণ বাঙালিদের নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য। অভিন্ন ধর্ম ইসলাম ছাড়া এই দুই জনগােষ্ঠীর মধ্যে মিল বলে কিছু নেই। ২৪ বছর আগে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংখ্যালঘু (৫৫ মিলিয়ন) অথচ সমৃদ্ধতর পশ্চিম পাকিস্তানিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের হীন দৃষ্টিতে দেখেছে, শােষণ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানিরা যত দেখেছে তাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের আধিপত্যাধীন সেনাবাহিনী এবং সেই অঞ্চলের শিল্প ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যয় নির্বাহ হয়েছে, ততােই তারা তিক্ত বােধ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে যে গুটিকয় উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে সেসবের কাজও এখন বন্ধ রয়েছে। সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা ও দেশের অভ্যন্তরে বেসামরিক প্রশাসনের শূন্যতাহেতু।

প্রতিরােধের শক্তি বৃদ্ধি

সেনাবাহিনী জবরদস্তিভাবে শ্রমিক সংগ্রহ করে শেষ পর্যন্ত মােটামুটি কার্যকর পর্যায়ে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর চালু করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু লড়াই শুরুর আগে বন্দরের গুদামে যেসব মালামাল মজুত ছিল তা জাহাজ-বােঝাই করা ছাড়াও নতুন মালের প্রয়ােজন রয়েছে। কতক অঞ্চলে খাদ্যঘাটতি মারাত্মক হয়ে উঠছে এবং বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। সেনাবাহিনী যদি অবিলম্বে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন ব্যবস্থা মেরামত ও মজুত খাদ্য বিতরণের উদ্যোগ না নেয় তবে দুর্ভিক্ষ-পর্যায়ে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। | বাঙালিদের প্রতিরােধের কারণে পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। ভারতের ক্রমবর্ধমান সহায়তা, আশ্রয় ও কখনাে কখনাে কভারিং ফায়ারের কল্যাণেও এখনাে অসংগঠিত প্রতিরােধ ক্রমেই শক্তি অর্জন করে চলেছে। হাজার হাজার বাঙালি তরুণ ডিমােলিশন ও গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে প্রায়শ এটা সীমান্তের ভারতীয় দিকে ভারতীয় প্রশিক্ষকদের দ্বারা প্রদত্ত হচ্ছে। নতুন গেরিলাদের প্রথম দলগুলাে ইতিমধ্যে দেশের ভেতর প্রবেশ করতে শুরু করেছে। সড়ক ও রেলসেতু ধ্বংস করা হচ্ছে আরাে অধিক হারে, উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কতক ধ্বংসাত্মক তৎপরতা স্পষ্টতই পাকা হাতের কাজ। সড়কপথে পাতা মাইন সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। প্রায়শই আর্মি, যারা সশস্ত্র ও সতর্ক অবস্থায় রয়েছে, মেরামতির কাজে স্থানীয় কন্ট্রাক্টরদের পাচ্ছে না, বাধ্যতামূলক শ্রমিক নিয়ােগ করে তারা ভালাে কাজও পাচ্ছে না। কুমিল্লার বাইরে অল্প কিছুকাল আগে গেরিলারা একটি রেলসেতু উড়িয়ে দিয়েছে। যে রিপেয়ার ট্রেন পাঠানাে হয়েছিল প্রকাশ্য দিবালােকে তার ফায়ারম্যানকে হত্যা করে কয়েকজনকে জিম্মি করা হয়। ট্রেন দ্রুত শহরে ফিরে যায়। 

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!