বিদেশী বাহিনী’ চাপিয়ে দিচ্ছে স্বীয় কর্তৃত্ব ঢাকা জুলাই ৪-১৯৭১
পৃথিবী কি বুঝছে না যে এরা কসাই ছাড়া আর কিছু নয়?’ প্রশ্ন করলেন এক বিদেশী, বহু বছর যাবৎ যিনি পূর্ব পাকিস্তানে আছেন। কেউ কি বুঝছে না, বাঙালিদের চিরতরে দাসে পরিণত করার জন্য তারা হত্যা করেছে এবং এখনাে করে চলেছে ? এরা উৎখাত করছে গােটা গ্রাম, সকালের প্রথম আলাে ফোটার সঙ্গে সঙ্গে গুলি শুরু করছে, আর ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত থামছে। না ? শান্ত সৌম্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত এই ভদ্রলােক কথা বলছিলেন বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলন দমনকল্পে পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনী সঙ্ঘটিত রক্তপাত বিষয়ে। এখানে বসবাসরত অধিকাংশ বিদেশী কূটনীতিক, মিশনারি, ব্যবসায়ী এই ব্যক্তির মতাে একই ধরনের কথা বলেন। তিন মাসের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও ক্রোধ নিয়ে তাঁরা ফেটে পড়ছেন। যা জানেন সেটা বিদেশী সাংবাদিকদের বলতে তাঁরা সবিশেষ আগ্রহী। ২৫ মার্চ সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরুর পর মাত্র পক্ষকাল আগে। বিদেশী সাংবাদিকদের প্রথমবারের মতাে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ ও ঘুরে বেড়াবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা বিদেশী গণমাধ্যমকে অত্যন্ত বৈরী হিসেবে বিবেচনা করে। অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তানে শৃঙ্খলা আবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ আরােপ করেছে এবং পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে, এটা দেখাতেও তারা মরিয়া হয়ে আছে। বস্তুত কতক এলাকা ব্যতীত পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে—সীমান্তঘেষা ঐসব এলাকায় মুক্তিফৌজ’ বা লিবারেশন আর্মি সক্রিয় রয়েছে এবং ভারতের সহায়তা পেয়ে তাঁদের তৎপরতা বাড়ছে।
তথাপি পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি আর যাই হােক স্বাভাবিক নয়। কেননা এটা স্পষ্টত ও খােলাখুলিভাবে বিদেশী বাহিনীর সামরিক দখলদারীর ঘটনা। বাঙালি পুলিশের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা পুলিশদল। বিভিন্ন সরকারি বিভাগে এমন কি টাইপিস্ট পর্যায়েও পূর্ব পাকিস্তানিদের বদলে বসানাে হচ্ছে ১০০০ মাইল দূর থেকে উড়ে আসা পশ্চিম পাকিস্তানিদের। নিহত অথবা শহর ছেড়ে গ্রামে পলাতক বাঙালিদের বাড়িঘর, দোকানপাট তুলে দেয়া হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত অবাঙালি মুসলমানদের হাতে যারা পাকবাহিনীর সঙ্গে সহযােগিতা করছে। সেনাবাহিনীর বিশেষ লক্ষ্য সংখ্যালঘু হিন্দুদের মন্দির ধূলিসাৎ করা হচ্ছে, আর কিছু না হােক অন্তত এটুকু দেখাবার জন্য যে যাঁরা সেনাবাহিনীর ‘ইসলামী সংহতি পরিকল্পনার শামিল নয় তাঁরা সত্যিকার পাকিস্তানি নয় এবং তাদের সহ্য করা হবে না। মাত্র তিন মাস আগে রাজপথে উল্লসিত মিছিল করে গেছে এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। জোরগলায় স্লোগান তুলেছে যে বাঙালি যুবকেরা, তাঁরা এখন ফিসফিস করে কথা বলে। বিদেশী সাংবাদিকদের হাতে চট করে গুজে দেয় কোনাে চিরকুট। বিড়বিড় করে দ্রুত জানিয়ে যায় কোনাে গণহত্যার বিবরণী, পরিবারের সদস্যদের হত্যা অথবা গােটা গ্রাম ধ্বংসের কাহিনী। বিস্তারিত বিবরণী সম্বলিত বেনামি এমনি বহু চিঠি প্রতিদিন হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সাংবাদিকদের ডাকবাক্সে এসে জমা হচ্ছে। | ভয়-ভীতির থাবার বিস্তার ঘটেছে প্রবল। কিন্তু একটি নতুন চেতনার উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। সাদাসিধা ও রােমান্টিক বাঙালি জাতির অধিকাংশ এখন মনে করেন তাদের নিজেদেরকেই সব করতে হবে, অন্য কোনাে দেশ তাদের রক্ষায় এগিয়ে আসবে না এবং কাজটি হবে দীর্ঘমেয়াদী। সীমান্ত এলাকা এবংসীমান্তের অপর পারের নিরাপদ আশ্রয় থেকে তৎপর মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিতে উল্লেখযােগ্য সংখ্যক তরুণ সটকে পড়ছে। বাঙালি গেরিলাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা বেড়ে চলেছে। সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন দালালকে খতম করা হয়েছে এবং ঢাকায় হাতে-তৈরি বােমা বিস্ফোরণের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। প্রতিরােধ এখনও বিক্ষিপ্ত, প্রান্তিক ও অসংগঠিত, কিন্তু তা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
প্রতিটি সন্ত্রাসমূলক কাজের প্রতিশােধ নেয় পাকবাহিনী নিকটস্থ বাঙালি সাধারণজনের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়ে। নােয়াখালী জেলায় পাক আর্মির ‘শান্তি কমিটি’র একাধিক সদস্য ও তাদের স্ত্রী-পুত্রদের সম্প্রতি মুক্তিবাহিনী খতম করার পর সেনাবাহিনী কয়েক শত বেসামরিক নাগরিককে ধরে এনে হত্যা করেছে বলে জানা যায়। একদা যেমন ব্যাপকভাবে ভাবা হয়েছিল যে, দখলদারিত্বের ব্যয়ভার খুবই চড়া হয়ে উঠবে এবং তা দ্রুত পাততাড়ি গােটাতে পাকিস্তানকে বাধ্য করবে, এখন সে ভাবনা পরিত্যক্ত হয়েছে। এমন কি বিশ্বব্যাঙ্ক কনসাের্টিয়ামের বার্ষিক বিপুল সাহায্য, যা স্থগিত রাখা হয়েছে পাকিস্তানি পীড়নের সমালােচনা হিসেবে, সেটা সত্ত্বেও ইসলামাবাদ পূর্ব পাকিস্তানের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হয়। মনে করা হয়েছিল জাতির উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষণে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানে বেসামরিক শাসন প্রবর্তনের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পরিকল্পনার উন্মোচন ঘটবে। কিন্তু গত সােমবার প্রদত্ত এই ভাষণে উল্টোটাই ঘটেছে—নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে বেসামরিক সরকার গঠনের আবরণে সামরিক একনায়কত্বই বহাল থাকবে বলে ঘােষণা করা হয়েছে। এখানে পশ্চিমী কূটনীতিকরা এই ভাষণকে ‘বিপর্যয়কর’ বলে অভিহিত করেছেন। বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট, তিনি সেনাবাহিনীর প্রধানও, দেশকে ‘আল্লাহর রহমতে … দ্বিখণ্ডিত হওয়া থেকে রক্ষার জন্য … ‘ সেনাবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। ছয় মিলিয়ন বাঙালি, যাদের বেশিরভাগ সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দু, যারা ভারতে পালিয়ে গেছে ‘বিদ্রোহীদের মিথ্যা প্রচারণার কারণে, তিনি তাদের প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন। তিনি দ্রুত পুনর্বাসনের জন্য অবিলম্বে তাদের নিজ নিজ গৃহে’ প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানান।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণের ঠিক আগের দিন একটি আর্মি প্লাটুন ঢাকা থেকে ৩০ মাইল দূরে মূলত হিন্দু অধ্যুষিত কয়েকটি গ্রামে হামলা চালিয়ে হত্যা, লুট ও অগ্নিসংযােগ ঘটায়। আর্মি এ পর্যন্ত কতাে বাঙালি হত্যা করেছে তার সঠিক সংখ্যা কেউ জানে না, তবে এখানকার নির্ভরযােগ্য সূত্রমতে এই সংখ্যা ১০০,০০০-এর ওপরে, চাই কি আরাে বেশি হতে পারে। এখানকার একজন পশ্চিমী ব্যক্তি জানালেন, মনে হচ্ছে যেন ভূমিদাসদের বিরুদ্ধে মধ্যযুগীয় বাহিনীর অভিযান চলছে। পূর্ব পাকিস্তানকে দখলে রাখা ও নিঃশেষে দোহন করতে যে কোনাে ব্যবস্থা তারা অবলম্বন করতে পারে। বাঙালিরা যদি প্রতিরােধের ব্যাপারে খুবই সচেষ্ট হয়, তবুও দাগ কাটবার মতাে অবস্থা সৃষ্টি করতে পাঁচ-দশ বছর লেগে যাবে।’ এই নিবন্ধ তারযােগে পাঠানাের পর নিউইয়র্ক টাইমস-এর দক্ষিণ এশীয় সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গকে পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করা হয়। নয়াদিল্লি পৌছে তিনি জানিয়েছেন যে, “পাকিস্তানের নিরাপত্তার স্বার্থে’ পাক সরকার তাঁকে দেশত্যাগের আদেশ দেয়।
সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ