You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.29 | পূর্ব পাকিস্তানের শহরে সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসের লক্ষ্য হচ্ছে হিন্দু জনগণ ফরিদপুর - সংগ্রামের নোটবুক

(নিচের বার্তাটি পাঠিয়েছেন নিউইয়র্ক টাইমস এবং তাঁরা তাঁদের বাড়িঘর দোকানে এর সংবাদদাতা গত বুধবার যাকে পূর্ব পাকিস্তান ‘মুসলমানের বাড়ি জাতীয় কথা লিখে থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। )

এই শহরে যেসব দোকান এখনাে আক্রমণের বিশেষ লক্ষ্যবস্তু এদেশের। সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দুদের সম্পত্তি চিহ্নিত করতেই এই কাজ  সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা আর্মির সন্ত্রাসের হাত থেকে রেহাই না পেলেও হিন্দুদের চাইতে নিরাপদ অনুভব করে থাকে I দিয়েছে। তুলনামূলকভাবে স্বল্পসংখ্যক খৃষ্টান, যাদের অধিকাংশ ব্যাপ্টিস্ট, দরজার ওপর ক্রুশচিহ্ন এঁকেছে এবং জামায় লাল সুতাে দিয়ে তা সেলাই করে নিয়েছে। | সড়ক পথ ও ফেরিতে রাজধানী ঢাকা। থেকে ৮৫ মাইল দূরবর্তী ও প্রদেশের মধ্যভাগে অবস্থিত ফরিদপুর শহর পূর্ব পাকিস্তানের অন্য কতক শহরের তুলনায় কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন দমনের জন্য ২৫ মার্চ সূচিত অভিযানের অংশ হিসেবে এপ্রিলে এখানে সেনাবাহিনীর আক্রমণ ঘটে। | ফরিদপুরে যদিও বেশকিছু দোকানপাট দগ্ধ হয়েছে, যার অধিকাংশই হিন্দু মালিকানাধীন, তা সত্ত্বেও বলা যায় শহরের অবকাঠামোেঅক্ষত রয়েছে। কিন্তু জীবনযাত্রার আর সব দিক একেবারে এলােমেলাে হয়ে গেছে এবং ঘৃণা, সন্ত্রাস ও ভয়, শহরের জীবনকে যা দুমড়েমুচড়ে দিয়েছে, তা সাড়ে সাত কোটি লােক অধ্যুষিত পূর্ব প্রদেশের আর সব শহরের সঙ্গে ফরিদপুরকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ফরিদপুরের ৩৫,০০০ শহরবাসীর অর্ধেক  মাত্র ফিরে এসেছে, তবে এই প্রবাহ বাড়ছে। সম্প্রতি আর্মি স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটা দেখাতে মানুষ হত্যা ও গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার কাজ কিছুটা কমিয়ে এনেছে। জুনের মধ্যভাগ থেকে কৌশলের এই পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এটা ঘটেছে বিদেশী সংবাদদাতাদের অত্র অঞ্চলে আবার প্রবেশের অনুমােদন দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ঘােষণার ঠিক আগেভাগে। ফরিদপুরের ১০,০০০ হিন্দুর কতজন মারা গিয়েছে সঠিকভাবে বলা শক্ত, অন্যরা সীমান্ত পার হয়ে পালিয়ে গেছে ভারতে। কতক হিন্দু ফরিদপুরে ফিরে আসছে ঠিকই, তবে আর্মির মন পরিবর্তনের ওপর আস্থাশীল হয়ে নয়, বরংচরম হতাশা থেকে। বাস্তুচ্যুত মানুষ হয়ে ভারতে বসবাস করতে চায় না তাঁরা এবং এটাও অনুভব করে পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে স্থানই তাঁদের জন্য নিরাপদ নয়। কাজে কাজেই নিজ শহরেই বরং এই নিরাপত্তাহীনতার মুখােমুখি হওয়া যাক।

একজন ক্ষৌরকার বলেছিল যে, সে এখনও লুকিয়ে আছে, তবে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য গােপনে শহরে ঢােকে। অন্নের সংস্থান করার জন্য যেটুকু সময় কাজ করা দরকার, করে। সে বলেছিল, ‘আমি চোরের মতাে শহরে ঢুকি, চোরের মতাে শহর ছেড়ে যাই।’ | যেসব হিন্দু শহরে এসেছে রাত্রে তাঁরা পাহারার ব্যবস্থা রেখেছে। এক তরুণ কাঠমিস্ত্রি আমাকে জানালাে, “আমরা কেউ রাতে ভালােভাবে ঘুমুতে পারি না, দিনের আলাে সামান্যই ভরসা যােগায়। এটাই আমাদের আবাস। ৭০ বছরের এক বৃদ্ধ হিন্দুরমণী, যাঁর ঘাড়ে গুলি লেগেছিল, তিনি বলেছিলেন যে, পরিস্থিতি ভয়ানক খারাপ এবং চরম ভীতসন্ত্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি জানেন এটাই আমাদের আবাস, আমরা সােনার বাংলায় থাকতে চাই।’ ২১ এপ্রিল আর্মি ফরিদপুর এলে বৃদ্ধা ও তাঁর ৮৪ বছরের স্বামী আশ্রয়ের জন্য তিন মাইল দূরের বদিবাঙ্গি গ্রামে যান। পরের দিন সৈন্যরা এই গ্রাম আক্রমণ করে এবং স্থানীয় বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ৩০০ হিন্দুকে সেখানে হত্যা করা হয়।  বৃদ্ধা বর্ণনা করছিলেন যে, পালাবার সময় পা পিছলে তিনি পড়ে যান এবং দুজন সৈন্য তাঁকে ধরে ফেলে। তারা তাঁকে মারধাের করে গয়নাগাটি টেনে ছিড়ে নেয় এবং একেবারে সামনে থেকে গুলি ছোঁড়ে। এরপর মৃত ভেবে তাঁকে ফেলে রেখে চলে যায়। বৃদ্ধা ও তাঁর স্বামীর একখণ্ড জমি ছিল যেখানে ঘর তুলে তাঁরা ভাড়া দিয়েছিল। তিনি বললেন, এখন ভিটের মাটিটুকু ছাড়া আর কিছুই সেখানে নেই। | হিন্দুদের বিরুদ্ধে সেনাভিযান ছিলএবংকতক ক্ষেত্রে এখনও রয়েছে—সুসংগঠিত। সৈন্যরা প্রায় প্রতিটি গ্রামে তল্লাশি চালিয়ে জানতে চেয়েছে হিন্দুরা কোথায় বাস করে। হিন্দু সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে হয় বিক্রি করা হয়েছে নতুবা দিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘অনুগত নাগরিকদের। এই সুবিধাপ্রাপ্তদের অধিকাংশই বিহারি, ভারত থেকে আগত মুসলিম। উদ্বাস্তু। বিহারিদের বেশিরভাগই সৈন্যদের সঙ্গে কাজ করছে, আমি তাদের অস্ত্রপাতিও   দিয়েছে।

যেসব এলাকায় আর্মির অবস্থান কিছুটা শিথিল করা হয়েছে, সেখানে প্রায়শ বিহারিরা হিন্দুদের হত্যা করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। হিন্দুদের ব্যাঙ্ক তহবিল আটক করা হয়েছে। বলতে গেলে কোনাে হিন্দু ছাত্র অথবা শিক্ষকই বিদ্যালয়ে ফিরে আসেন নি। ইয়াহিয়ার আশ্বাস লুকনাে আশ্রয় ও ভারত থেকে নিজ আবাসে ফিরে আসার জন্য হিন্দুদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। ভারতে পালিয়ে যাওয়া ষাট লক্ষ বাঙালির ভেতর চল্লিশ লক্ষই হচ্ছে হিন্দু এবং পূর্ব পাকিস্তানের জীবনযাত্রায় তাঁদের সমভূমিকা পালনের সুযােগ দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন পাক প্রেসিডেন্ট। তবে সংঘর্ষ ক্ষেত্রে কর্মরত একজন আর্মি কম্যান্ডার ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সময় স্বীকার করেন, তাদের নীতি হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংস করা, হিন্দু ও মুসলমান উভয়কে, বিশেষভাবে হিন্দুদের, উৎখাত করা।  ‘রাষ্ট্রবিরােধী’ হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানকে সেনাবাহিনী হত্যা করলেও মূল দোষ তারা চাপিয়ে দিচ্ছে হিন্দুদের ওপর। সামরিক প্রশাসন স্বায়ত্তশাসনআন্দোলনের জন্য দোষী। সাব্যস্ত করছে হিন্দু ভারত ও তার এজেন্টদের। ফরিদপুরে এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় গােটা পরিধি জুড়েই, সেনাবাহিনী আসার আগে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে কোনাে দ্বন্দ্ব ছিল না। আমি এখন এমন বিরােধ উস্কে দিতে চাইছে। এপ্রিল মাসে জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ফরিদপুর শহর-কেন্দ্রে দুইজন হিন্দুর শিরচ্ছেদ করে তাঁদের শরীরে কেরােসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। কতক হিন্দু যখন প্রাণ বাঁচাতে ইসলাম ধর্মান্তরণের জন্য প্রার্থনা জানায়, তাঁদেরকে কাফের গণ্য করে গুলি করে হত্যা করা হয়। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে অবশ্য ধর্মান্তরণ গৃহীত হয়ে থাকে)। হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন মুসলমানদের আর্মি বাধ্য করেছিল হিন্দুবাড়ি লুট করতে। তাঁদেরকে বলা হয় হিন্দুবাড়ি আক্রমণ না করলে তাঁদেরকেই হত্যা করা হবে। এর ফলে ফরিদপুর এলাকায় অধিকাংশ হিন্দুবাড়ি—কারাে কারাে মতে ৯০ শতাংশ বাড়িঘর, লুষ্ঠিত হয়েছে। এত কিছু করবার পরও বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে কোনাে হিন্দু-বিদ্বেষী মনােভাব দেখা যায় না। হিন্দুদের আশ্রয়দান ও রক্ষার জন্য অনেকে বিরাট ঝুঁকি নিয়েছেন। হিন্দুদের ক্ষেত্রে যা ঘটছে তাতে ভয়ঙ্কর মর্মপীড়ার কথা জানিয়েছেন অন্যেরা। সেইসঙ্গে এটাও স্বীকার করেছেন যে প্রাণভয়ে কোনােরকম সহায়তা করা থেকে তাঁরা বিরত রয়েছেন। | বস্তুত অনেক বাঙালি মনে করেন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলমান বন্ধন জোরদার করতেই কেবল আর্মি কামিয়াব হয়েছে। 

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ