You dont have javascript enabled! Please enable it!

নাগরিকজনেরা বিদেশীদের সঙ্গে কথা বলে চাপা স্বরে এবং পেছন দিকে লক্ষ্য রাখে পাছে কেউ কিছু শুনে ফেলে কিনা। সৈনিক ও বিশেষ পুলিশ দল—যাদের নিয়ে আসা হয়েছে হাজার মাইলেরও দূরের পশ্চিম পাকিস্তান থেকে । রাস্তায় গাড়ি, বাস ও বােঝ-হাতে মানুষজন । থামিয়ে খানাতল্লাশি চালাচ্ছে। আটক ও গ্রেপ্তারি অব্যাহত রয়েছে, যদিও তা কখনাে স্বীকার করা হয় না। পরিবারের লােকজন যখন সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চায় তাঁদের পুত্র বা পিতার খবরাখবর, সামরিক কর্তাদের বাঁধা জবাব হচ্ছে, জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের তাে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এবং এখনও যদি বাড়ি না ফিরে থাকে তবে হয়তাে ভারতে পালিয়ে গেছে। ধরা পড়লে কঠোর সাজার ভয় সত্বেও বহু লােক প্রতিদিন সংগুপ্ত বাংলাদেশ বেতার শুনে থাকে। প্রদেশব্যাপী বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীর অভিযানের তিন মাস পর এই হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকারঅস্বস্তিকরও অসুখী পরিস্থিতি। শহরের নিয়ন্ত্রণ নিঃসন্দেহেসৈন্যবাহিনীর হাতে, তবে ‘স্বাভাবিকতা’—পরিস্থিতি বয়ানকালে যে কথাটা সরকার ব্যবহার করে তার কোনাে অস্তিত্ব নেই। আজকের ঢাকাকে বড় জোর বলা যেতে পারে সেনাবাহিনী অধিকৃত নগরী, যেখানে শক্তি, সন্ত্রাস ও ভীতির শাসন চলছে, কিন্তু কোনােভাবেই কার্যকর বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি। ঢাকার ১৫ লক্ষ মানুষের মাত্র অর্ধেক এখানে রয়েছে। বাদবাকিদের অধিকাংশই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অথবা ভারতে পালিয়ে গেছে। বহু সহস্র নাগরিক, সঠিক সংখ্যা  কেউ জানেন না, নিহত হয়েছেন সেনাবাহিনীর হাতে।

অল্প অল্প করে মানুষ যদিও ফিরে আসছে, তবুও অনেক দোকানপাট এখনাে বন্ধ। যেসব দোকান খুলেছে তার বেশিরভাগই আবার সামরিক বাহিনী ও তার দোসর লােকজনের লুট বা হাঙ্গামার ভয়ে বেলা থাকতেই বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় জনচলাচল কম। ব্যস্ত সময়ে একদা যেসব পথ জনাকীর্ণ থাকতাে, পুরনাে ঢাকার সেইসব সরু রাস্তা দিয়ে এখন গাড়ি নিয়ে অনায়াসে ঘােরা যায়। আগের দিনে ভিড়ের জন্য এখানে হয়তাে ঘণ্টাখানেক আটকা পড়ে থাকতে হতাে।  ২৫ মার্চ সেনাভিযান শুরুর পর চলতি সপ্তাহে এই প্রথমবারের মতাে সরকার বিদেশী। সাংবাদিকদের পূর্ব পাকিস্তানে আসা ও স্বাধীনভাবে ঘুরবার অনুমতি দিয়েছে। | ট্যাঙ্ক, রকেট ও অন্যান্য ভারি অস্ত্র ব্যবহার করে যেসব ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানাে হয়েছিল তার অনেক চিহ্নই মুছে ফেলা হয়েছে। তা সত্ত্বেও শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই ঝড়ের বহু নিদর্শনই রয়ে গেছে। এখানে অবস্থানরত বিদেশীরা মাটিতে মিশিয়ে দেয়া শহরের সেইসব ধ্বংসস্তুপের ব্যঙ্গাত্মক নামকরণ করেছে পাঞ্জাবি নগর-উন্নয়ন প্রয়াস’সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাবি বা পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রাধান্যের প্রতি ইঙ্গিতবহ এই মন্তব্য। বেশির ভাগ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে শহরের পুরনাে এলাকায়, ঢাকার দরিদ্রজনদের যেখানে বসবাস। তাঁরা আওয়ামী লীগের দৃঢ় সমর্থক, যে দল গত ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বশাসনের দাবি নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। দলটি এখন নিষিদ্ধ। পাড়ার পর পাড়া, যা ছিল একদা টিনের চালার নড়বড়ে ঘরের সারি, এখন সেখানে কেবল শূন্যতা, ধূলিধূসর লম্বা মাঠ। এখানেওখানে ভাঙাচোরা জিনিসপত্রেরস্থূপ শুধুজানান দিচ্ছে অতীতে কি ছিল এখানে। ইট-সিমেন্টের তৈরি কিছু কিছু ভবন, যেগুলাের ক্ষতির মাত্রা মেরামতের অযােগ্য, তা ভেঙে ফেলে সরকার ধ্বংসযজ্ঞের যাবতীয় নিদর্শন মুছে দিতে চাইছে। 

বস্তুত মুখশ্রী উন্নত করার জন্য কর্মকর্তারা বেশ বড় ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে। দগ্ধ মাটিতে জমে থাকা যাবতীয় আবর্জনা বুলডােজার দিয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং আশপাশের যেসব বাড়িঘরে বুলেট ও গােলাবর্ষণের গর্ত রয়ে গিয়েছিল সেগুলোেভরাট করে তার ওপর চুনকাম করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাঙালি পুলিশদের ব্যারাক, সেনাবাহিনীর আক্রমণের এই দুই বিশেষ লক্ষ্যস্থানেও মেরামত ও চুনকামের ছাপ রয়েছে। কিন্তু একতলা সারি সারি সুদীর্ঘ পুলিশ ব্যারাকগুলাের অবস্থানটা এখনও দেখাচ্ছে আক্রমণের পরের সকালের মতাে, ভারি গােলায় ধ্বংস ও দগ্ধ করে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া। সেনাভিযানে নিহত হয়েছে আনুমানিক প্রায় ৭০০ বাঙালি পুলিশ। পুরনাে ঢাকার কিছু কিছু দগ্ধ এলাকায় সরকার ইটের নতুন ঘর তুলে ব্যবসায়ীদের কাছে দোকান হিসেবে ইজারা দিচ্ছে। পাইকারি কেনাবেচার এমনি একটি ভস্মীভূত এলাকায় পুরনাে মালিকেরা নিজেরাই আবার দোকান তুলে নিচ্ছে। আর সব জায়গার মতাে এখানেও পরিবেশ হচ্ছে ভীতিতাড়িত। সৈন্যদের উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে কোনাে কোনাে দোকানদার কাচের ওপর বড় করে সেটে রেখেছে বাণী—‘ক্র্যাশ ইন্ডিয়া’। সবখানেই উড়ছে পাকিস্তানের পতাকা। রাস্তায় খােলাখুলি কথা বলবে খুব কম লােকই, কিন্তু বিদেশী দর্শনার্থীদের গাড়ি যখন ধার ঘেঁষে চলবে জানালার কাছে মুখ এনে ওরা ফিসফিসিয়ে বলবে অনেক কথা। এখানে সবকিছু পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, এক বৃদ্ধ বললেন মুখ প্রায় না খুলে। অনেক হিন্দু দোকান মালিক, যাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন মিষ্টি বিক্রেতা, হয় পালিয়ে গেছেন নতুবা নিহত হয়েছেন। অবাঙালি মুসলমান ও সেনাবাহিনীর পক্ষাবলম্বী লােকজনদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁদের দোকান। | হিন্দু সংখ্যালঘিষ্ঠরা বিশেষভাবে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বহুকাল থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃত্ববানরা হিন্দুদের বিবেচনা করে আসছে অবিশ্বস্ত, যাঁদের প্রকৃত আনুগত্য রয়েছে, তাদের মতে, মূলত হিন্দু অধ্যুষিত ভারতের প্রতি। যে ছয় লক্ষ পূর্ব পাকিস্তানি ভারতে পালিয়ে গেছে তাঁদের ভেতর চার লক্ষ বা ততােধিক হচ্ছে হিন্দু। 

পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ হিন্দু মন্দির ভেঙে ফেলছে। এখানে উপাসনা করার মতাে হিন্দু লােকজন রয়েছে কিনা সেসব কিছুই বিবেচনা করছে না। হিন্দু অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম যাঁরাই পালিয়ে গেছে তাঁদের বাড়িঘর দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘অনুগত’ নাগরিকদের। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ঘর থেকে বের করে এমনি দখলদারি বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতি দমন-অভিযানের অংশ হিসেবে গাড়ির নম্বরপ্লেট বাংলা থেকে আবার ইংরেজিতে পরিবর্তন করা হয়েছে। রাস্তায় সৈনিক খুব বেশি নজরে পড়ে না। কিন্তু রয়েছে তাদের বিকল্প–পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা পুলিশ, ছাইরঙা কোর্তাও টুপি-পরা। তাদের বড় কাজ হলাে ঘরে তৈরি বােমা ও অস্ত্রপাতির খোঁজে রাস্তায় গাড়িঘােড় তল্লাশি করা। ঢাকায় বাঙালি গেরিলা যােদ্ধারা বােমা নিক্ষেপ ও অন্যান্য সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তবে এসব এখনাে বিক্ষিপ্ত এবংসুসংগঠিত নয়। বাঙালিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নেওয়া ও পরে হত্যা করা সম্পর্কে নানা খবর শহরময় চালাচালি হচ্ছে। এখানে বসবাসরত বিদেশীরা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করলেও অধিকাংশ খবর প্রত্যক্ষভাবে যাচাই করা কঠিন। তবে কিছু কিছু ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য বিবরণী রয়েছে। একজন উর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও তাঁর গােটা পরিবারকে সম্প্রতি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আর্মি ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কেবল একটি ছেলে ছাড়া পরে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছেলেটির কি হয়েছে এ-খবর আর তাঁরা জানতে পারেন নি। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে কি অভিযােগ সেটাও জানা যায় নি। | ‘এখন আপনি নিজের চোখেই সবকিছু দেখতে পারবেন, শহরকেন্দ্রের দোকানে এক বাঙালি যুবক ফিসফিস করে বললাে বিদেশী সংবাদদাতাকে। ওরা কি করেছে এবার আপনি সব দেখতে পাবেন। আমি একজন হিন্দু কিন্তু এখন নাম পাল্টে খৃষ্টান হয়েছি এবং আমার পরিবারকে খৃষ্টান বাড়িতে নিয়ে তুলেছি। আপনারা যে এসেছেন সেজন্য আমরা কৃতজ্ঞ। প্রার্থনা করি আমাদের সাহায্য করতে আপনারা সফলকাম হােন।  

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!