You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.26 | অধিকাংশ যানবাহন অকেজো হওয়ার ফলে অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি ঢাকা জুন ২৬- ১৯৭১ - সংগ্রামের নোটবুক

পাকিস্তানের অনেক স্থানে খাদ্যাভাব মারাত্মক হয়ে উঠছে গ্রামাঞ্চলে নগদ অর্থের সমস্যা দেখা দিয়েছে, পাটকলগুলাে বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং গেরিলারা প্রধান প্রধান সড়ক ও রেল যােগাযােগ ব্যাহত করে চলেছে।  এখানে অবস্থানরত বেশির ভাগ বিদেশী অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, এতােকিছুসত্ত্বেও পূর্বাঞ্চলে সেনাদখল কায়েম রাখার অর্থনৈতিক মাশুল গুণতে, অন্তত আশু দিনগুলাের জন্য, পাকিস্তান সরকার প্রস্তুত রয়েছে। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন দমন প্রচেষ্টায় অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওয়াকেবহাল বিদেশী উৎস থেকে জানা যায়, দেশের অভ্যন্তরে তাঁদের ফিল্ড ট্রিপের সময় তাঁরা কতক এলাকায় খাদ্যসঙ্কট দেখতে পেয়েছেন, বিঘ্নিত যােগাযােগ ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি না হলে এটা মারাত্মক সঙ্কটের রূপ নিতে পারে। সমস্যাপীড়িত একটি ক্ষেত্র হচ্ছে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, স্বাভাবিক অবস্থায় যা পাশের জেলাগুলােতে চালের যােগানদার উদ্বৃত্ত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। বিদেশী অর্থনীতিবিদরাজানান যে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল জনবিরল হয়ে পড়েছে, মাঠে চাষীর দেখা বিশেষ পাওয়া যায় না। বাঙালিদের দমনের জন্য ২৫ মার্চ থেকে পাকবাহিনী যে অভিযান চালাচ্ছে তার থেকে বাঁচার জন্য অধিকাংশ চাষী মনে হয় ভারতে পালিয়েছে। ধ্বংস ও লুট বিদেশী উত্স মতে প্রকাশ, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খাদ্য মজুত হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে কিংবা লুণ্ঠিত অথবা দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া   হয়েছে। তাঁরা বলেন, অবস্থার অবনতি উপােষ থাকার পর্যায়ে যায় নি, তবে মানুষের পর্যাপ্ত খাদ্য জুটছে না এবং দু’তিন মাসের মধ্যে আহার জোটানাের সমস্যা দেখা দেবে। একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, এই মুহূর্তে মৃত ব্যক্তির চাইতে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেশি।’ বিশেষজ্ঞরা জানান, পূর্ব পাকিস্তানে সামগ্রিকভাবে দু’মাসের খাদ্য সরবরাহ মজুত রয়েছে এবং বড় সমস্যা হচ্ছে ঘাটতি এলাকায় খাদ্য পাঠাবার ব্যবস্থা করা। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বন্দর চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার রেল যােগাযােগ এখনও বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এসব এলাকায় গেরিলা তৎপরতা যথেষ্ট বলেই জানা যায়। পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃক আমদানিকৃত খাদ্যশস্যের ৭০ শতাংশই এই রেলপথে বাহিত হয়। সড়কপথের প্রধান সেতুগুলাে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।  পূর্বাঞ্চলের খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ সাধারণত বছরে দুই মিলিয়ন টন, চলতি বছর তা প্রায় তিন মিলিয়ন টনে দাঁড়াতে পারে।

পলাতক বন্দর শ্রমিক

পরিবহনের বিপর্যয় ছাড়াও চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরের কাজকর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গুদামে স্থানসঙ্কট ও শ্রমিক ঘাটতি দ্বারা, কেননা ডক শ্রমিকদের অনেকেই দেশের গভীর অভ্যন্তরে অথবা ভারতে চলে গেছে। বন্দরে মাল জমে যাওয়ার দরুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সচরাচর যে দেশ পূর্ব পাকিস্তানে বার্ষিক এক মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য পাঠিয়ে থাকে, সাময়িকভাবে তাদের খাদ্য চালান বন্ধ রেখেছে।  প্রধান আরেক খাদ্য ঘাটতি এলাকা হচ্ছে বঙ্গোপসাগরের বদ্বীপ অঞ্চল, বিগত নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে যেখানে মারা গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ, ধ্বংস হয়েছিল খেতের অধিকাংশ ফসল। দ্বীপাঞ্চল এবং উপকূলীয় এলাকায় খাদ্য মজুতের পরিমাণ খুব কম, তবে প্রথমে যেমন ভাবা হয়েছিল অবস্থা ততাে মারাত্মক নয়, কেননা কিছু রিলিফ এখানে এসে পৌঁছেছে।  বিদেশী উৎস জানায়, এতদ্সত্ত্বেও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নতি না হলে এই অঞ্চল দুর্ভিক্ষ এলাকায় পরিণত হতে পারে। গাঙ্গেয় বদ্বীপের খুলনা জেলাতেও খাদ্যের ঘাটতি রয়েছে, কেননা হিন্দু কৃষক ও খেতমজুরদের অনেকেই পালিয়েছে। সংখ্যালঘু হিন্দুরা সেনাবাহিনীর বিশেষ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে, তাদেরকে মনে করা হয় ভারতের চর ও মুসলিম জাতির শত্রু। আরেকটি অজানা দিক হচ্ছে ছয় মিলিয়ন বাঙালির ভারতে পালানাের মতাে ব্যাপক দেশান্তরের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া। তাদের দেশত্যাগের ফলে ফসল ও শিল্প উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে, তেমনি হ্রাস পেয়েছে পণ্যভােগ। এমনকি যেসব এলাকায় ধানের সরবরাহ ভালাে সেখানে রয়েছে নগদ অর্থের সঙ্কট। অনেক গ্রামবাসীর পর্যাপ্ত ক্রয় ক্ষমতা নেই, পলায়নপর হিন্দুরা স্বল্প মূল্যে সমস্ত কিছু বিকিয়ে দিলেও তারা সেটা কিনতে পারছে না।  

অর্থ সঙ্কটের মূল কারণ গ্রামে সরকারের ওয়ার্কস্ প্রােগ্রামের কাজ একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তা, সেচের খাল ও বাঁধ তৈরির কাজ করে যেসব মজুর দৈনিক ৬০ সেন্ট করে। আয় করতাে তারা এখন একেবারে বেকার সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে আছে। সরকারি কৃষি প্রযুক্তিবিদ ও বেসরকারি | সেচকূপ কন্ট্রাক্টররা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে ভয় পাচ্ছে। বিদেশী পরামর্শদাতা ও প্রকৌশলীরা ঢাকা অফিসে বসে কালক্ষেপণ করে চলেছে। সরকারি দপ্তর খােলা রইলেও কর্মচারী হাজিরা অনেক কম এবং উন্নয়নমূলক কোনাে কাজ হচ্ছে না। | পাটকলগুলাে তাদের পূর্বতন ক্ষমতার ভগ্নাংশ মাত্র চালু রেখেছে। পূর্বাঞ্চলের পাট হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি এবং পাকিস্তানের মূল রপ্তানি ও বিদেশী মুদ্রা অর্জনকারী। পুরােমাত্রায় সাহায্য আবার চালু করার পূর্বশর্ত হিসেবে অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নিরীক্ষণের জন্য বিশ্বব্যাঙ্কের যে প্রতিনিধিদল সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তান সফর করেছেন তারা এরকম একটি অর্থনৈতিক ছবিই দেখতে পেয়েছেন। এখানকার বিদেশী অর্থনীতিবিদরা জানান, বিশ্বব্যাঙ্কের টিম হতবাক ও আলােড়িত বােধ করেছে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না কার্যকর রাজনৈতিক সমাধান অর্জিত হয় ও সামরিক সরকার বাস্তববাচিত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে, ততােদিন সাহায্য স্থগিত রাখার সুপারিশ করেছে। বিশ্বব্যাঙ্ক কাজ করছে ১১-জাতি কনসাের্টিয়ামের সমন্বয়কারী হিসেবে, যারা পাকিস্তানকে বার্ষিক প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। পাকিস্তান এই সাহায্যের ওপর বড়ভাবে নির্ভরশীল। মার্কিন সাহায্যের বড় অংশ—বার্ষিক প্রায় ২০০ মিলিয়ন—এই কনসাের্টিয়ামের মাধ্যমেই প্রদত্ত হয়।  বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানে সেনা-তৎপরতা পাকিস্তান কতকাল চালিয়ে যেতে পারবে সেটা এখন ঢাকার বৈদেশিক মহলে জোর আলােচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের বিদেশী মুদ্রা ভাণ্ডার কমে এলেও যেমনটা ভাবা হয়েছিল পরিস্থিতি ততাে খারাপ নয়। একটি কারণ হচ্ছে স্বীয় বিপুল আন্তর্জাতিক ঋণের কিস্তি পরিশােধের ওপর পাকিস্তান এককভাবে স্থগিতাদেশ জারি করেছে। আরেকটি কারণ হচ্ছে লড়াই শুরুর পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় কোনাে আমদানিই ঘটে নি, এ ক্ষেত্রে তাই সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় ঘটেছে। সর্বোপরি, সঙ্কট শুরুর আগে ঘটনাচক্রে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের জন্য বিপুল কাঁচামাল পশ্চিম পাকিস্তানে মজুত ছিল। | সব মিলিয়ে বিদেশী অর্থনীতিবিদরা মনে করেন যে, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মরিয়াঅবস্থার কিনারেরইলেও পূর্বাঞ্চলে দখলদারীর আশুঅবসানের কারণ হয়ে উঠবে । 

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ