১২ টি বগিতে হাজারের কমসংখ্যক যাত্রীর ঠাঁই হয় এমন একটি ট্রেনে চড়েছে দুই হাজার হতশ্রী বাঙালি শরণার্থী। আরাে পাঁচ হাজার মানুষ শুয়ে-বসে রয়েছে প্ল্যাটফর্মে, অপেক্ষা করছে তাঁদের পালা আসার—যদিও ২৪ ঘণ্টার আগে পরের ট্রেনটি আসছে না। | অপেক্ষায় থাকতে থাকতে মৃত্যু ঘটছে। কারাে কারাে—অপুষ্টি, নিউমােনিয়া, উদরাময় ও কলেরায়। মধ্য ভারতের যে-জায়গায় তাঁদের নিয়ে যাওয়া হবে তা নিয়ে সবাই চিন্তিত ও ভীত। পূর্ব পাকিস্তানে বাধ্যত ফেলে আসা বাড়িঘরের কাছাকাছি থাকতে পারাটাতেই তাঁরা বরং আগ্রহী। কিন্তু মরিয়া হয়ে ওঠা ভারতীয় সরকারি কর্মচারীরা তাঁদের রেশন বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে,—তাঁরা জানে এভাবে যদি বাধ্য না করা হয় তবে অসম্ভব রকম ওপচানাে সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে তাঁদের ভারতের অন্যত্র নতুন জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবেনা। সরকারি রেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর খাবার কেনার জন্য শরণার্থীরা বেচে দিয়েছে তাঁদের যৎসামান্য সম্বলছাতা, থালাবাসন, কাপড়চোপড়। দ্বিগুণ জনসংখ্যা দৃশ্যটির স্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বারাসাত, কলকাতা থেকে ১৬ মাইল উত্তরপূর্বে এবং পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত থেকে ৩০ মাইল ভেতরে। একসময় এলাকার লােকসংখ্যা ছিল ৪০,০০০ এখন এখানে উপচে পড়েছে আরাে ৪০,০০০ মানুষ, পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা আন্দোলন দমনের জন্য পাকসেনাভিযান থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে এঁরা। ভারতের সীমান্ত এলাকা জুড়ে প্রায় ষাট লক্ষ ক্ষুধার্ত ও অসুস্থ শরণার্থীর ভিড়ে কী অবস্থা দাঁড়িয়েছে তার একটি অনুচিত্র হচ্ছে বারাসাত। মােট শরণার্থীর মধ্যে মাত্র ৩০০০ জনকে সরকার ইতিমধ্যে স্থানান্তর করতে পেরেছে। ২৬০০ মাইল দূরে মধ্যপ্রদেশের মানার অস্থায়ী শিবিরে। তাঁদের প্রায় সবাইকে ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গতকাল থেকে দুইটি সােভিয়েত বিমানে করেও এই কাজ শুরু হয়েছে। বিমানে প্রতিদিন ৭০০ উদ্বাস্তুকে মানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আগামীকাল থেকে চারটি পরিবহন বিমান নিয়ে আমেরিকান বহর কাজ শুরু করবে এবং আশা করা যাচ্ছে ত্রিপুরা ও আসাম থেকে এভাবে দৈনিক ১০০০ শরণার্থীকে সরিয়ে নেওয়া যাবে।
এখনও আসছে শরণার্থী
তবে এমনি হারে শরণার্থী স্থানান্তরের কাজ চললে তা নতুন শরণার্থী আগমনের সঙ্গে তাল বজায় রাখতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রতিদিনই আসছে হাজার হাজার উদ্বাস্তু। উদাহরণত, বারাসাত শহরে এখন প্রতিদিন ৫০০০ শরণার্থী এসে পৌছুচ্ছে এবং ট্রেনে চলে যাচ্ছে ২০০০ শরণার্থী। স্থানীয় কর্মকর্তারা নতুন কোনাে শরণার্থীর নাম তালিকাভুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাঁদের পার্শ্ববর্তী জেলায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। | আজকের বারাসাতকে শহর বলা চলে না, হয়ে উঠেছে মৌমাছির ঝাঁক। রাস্তায় উদ্বাস্তুর এমন ভিড় যে গাড়ি নিয়ে এগােতে হয় মেপে মেপে। প্রতিটি সদর দরজার সামনে, বারান্দায়, খালি বাড়িতে শরণার্থী উপচে পড়ছে। সব খােলা মাঠ তাঁরা ভরে ফেলেছে। সবখানেই দেখা যাবে খড়কুটো দিয়ে জ্বালানাে তাঁদের চুল্লি, জোড়াতালি দিয়ে গড়ে তােলা সাময়িক আচ্ছাদন বৃষ্টির ধারাপাত যা সহজেই ফুটো করে ফেলে। মৌসুমি বর্ষণ যতাে বাড়ছে চারপাশের কাদা ও ময়লা আবর্জনা ততই থকথকে হয়ে উঠছে। স্থানীয় জনসাধারণ সহানুভূতিপ্রবণ। তবে সব ধরনের স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ শরণার্থীরা যেভাবে রুদ্ধ করছে তাতে করে স্নায়ুর ওপর চাপ বাড়ছে। গত সপ্তাহে অবিরাম বর্ষণ থেকে বাঁচার জন্য হিন্দু শরণার্থীরা প্রবেশ করেছিল মুসলমানদের মসজিদে এবং সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা বেঁধে যাওয়া রােধ করতে অতিরিক্ত পুলিশ মােতায়েন করতে হয়েছিল প্রশাসনকে। এমনি হাঙ্গামাকে খুব ভয় পাচ্ছে ভারত সরকার। ‘এদিক থেকে কোনাে সমাধান নেই’ ‘যদি পূর্ব পাকিস্তানে কোনাে রাজনৈতিক সুরাহা না ঘটে,” বললেন তারকনাথ ভট্টাচার্য, ৩৫ বছর বয়েসী জেলা প্রশাসক, “আমাদের এদিক থেকে কোনাে সমাধান করা যাবে না।’ শহরের অবস্থা যেমন করুণ, রেলসার্ভিসের পরিস্থিতি ততােধিক। টিমটিমে বাতির আলােয় রেলস্টেশনের শানবাঁধানাে স্যাতসেঁতে মেঝেতে গাদাগাদি করে শুয়ে থাকা ৫০০০ শরণার্থীকে মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুর চাদরে আবৃত নিথর সত্তা। এক সময় সেই জড়পিণ্ড যেন সামান্য নড়েচড়ে ওঠে। কেউ হয়তাে একটি হাত অথবা পা নাড়ালাে, কেউ বমি করে উঠলাে, কারাে গােঙানির শব্দ, একটি বাচ্চা তারস্বরে কাঁদছে।
মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে এক বৃদ্ধ, ঘােরলাগা দৃষ্টি, মৃত্যুপথযাত্রী । হাড়জিরজিরে মাছিতাড়িত শিশু হামাগুড়ি দিতে গিয়ে একটু সরে গেছে পরিবারের কাছ থেকে। বাবা-মার অনুপস্থিতি টের পেয়ে হঠাৎ-জাগা কান্নার সঙ্গে দমকে উঠতে থাকে। কাশি। সচকিত হয়ে জেগে উঠলেও বাবা-মা এতােই ক্ষীণশক্তি ও ঘােরাচ্ছন্ন যে সাহায্যের কোনাে হাত বাড়িয়ে দিতে পারছে না। পূর্ব পাকিস্তানের বাড়িঘর ছেড়ে এই দীর্ঘ পদযাত্রায় শরণার্থীরা একেবারেই শক্তিহীন। অনেকেরই উঠে প্রয়ােজনীয় কর্ম সারবার শক্তিও নেই। মাঝে মাঝে ক্ষীণ বাতাসের দোলা বয়ে আনছে দুর্গন্ধ। গােটা স্টেশনে কোনাে ডাক্তারনার্স বা প্রাথমিক চিকিৎসা-সহযােগী নেই। একটি ছােট টিনের তােরঙ্গ, যার ভেতরে রয়েছে তার যথাসর্বস্ব, সেটা খুলে সামনে পা ছড়িয়ে বসে আছেন এক হতবুদ্ধি ব্যক্তি। বারবার আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখে নিচ্ছিলেন। তাঁর প্রতিটি জীর্ণ দলিলপত্র ও মলিন জামাকাপড়। স্টেশন মাস্টার বলছিলেন যে, কলকাতা থেকে সীমান্ত পর্যন্ত প্রতিটি স্টেশনের এই একই দুর্গতি। তিনি জানালেন, প্ল্যাটফর্মেই প্রতিদিন চার-পাঁচজন কলেরায় মারা যাচ্ছে। বিকেল পাঁচটা থেকে শরণার্থীরা ট্রেনে চেপে বসে আছে। রাত বারােটা চার মিনিটে এটা যাত্রা শুরু করবে। ভেতরে গাদাগাদি যাত্রীর ভিড়ে বাতাস গুমােট হয়ে আছে। সময়সূচি অনুযায়ী মানা পৌছুতে সময় লাগবে ২২ ঘণ্টা, কিন্তু বারংবার যাত্রাভঙ্গ ও বিলম্বের কারণে প্রকৃতপক্ষে সময় লাগবে আরাে বেশি। ভেতরের বদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে যাত্রীদের কেউ কেউ বাইরে বেরিয়ে আসছেন, কিন্তু এখানকার বাতাসও প্রায় একইরকমের গুমােট। গন্তব্যস্থান নিয়ে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে তাঁরা খুঁজছেন এমন লােক যে জবাব দিতে পারবে তাঁদের জিজ্ঞাসার মানাতে কি আমাদের খাবারদাবার মিলবে ? ‘ওখানে ওঁরা কি জানে যে আমরা আসছি ?” স্টেশনে কর্মচারীর সংখ্যা মুষ্টিমেয় এবং তাঁদের উত্তরও খুব ভাসাভাসা। ‘পৃথিবীতে যদি সত্যের কোনাে শক্তি থেকে থাকে তবে আমরা স্বাধীনতা পাবাে বলে আমি নিশ্চিত বিশ্বাস করি, বললেন ২১ বছরের দোকানদার আশুতােষ বিশ্বাস। তারপর সামান্য ভেবে তিনি যােগ করলেন, “আমরা বড়রা দুর্গতি ভােগ করার জন্য তৈরি রয়েছি কিন্তু আমাদের শিশুদের কেন হত্যা করা হচ্ছে ? কীভাবে আমরা ঐসব জীবন আবার ফিরিয়ে দিতে পারি ? | কয়েক মিনিট পর হুইসিল বাজিয়ে ট্রেন যখন ধীরে ধীরে স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে লাগলাে, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানাে এক বৃদ্ধ, পরের ট্রেনে যাঁর যাবার কথা, বিড়বিড় করে বললেন, যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন, যাত্রাপথেই মারা যাবে এদের অনেকে।’
সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ