You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকিস্তানি শরণার্থীদের সঙ্গে প্রতিযােগিতা ভারতের দরিদ্রজনের উষ্মর কারণ হয়েছে- পেট্রাপােল, ভারত মে ১৬- ১৯৭১ 

পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া জন্য পলায়নপর  বাঙালি শরণার্থীর বিপুল সংখ্যায় নিরন্তর আগমন কেবল ভারতের অর্থনীতি নয়, সামাজিক বাতাবরণের ওপরও প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে। শরণার্থী আগমনে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে, অপরদিকে কমে গেছে মজুরি। বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ভারত সরকার জানিয়েছে যে, শরণার্থীর সংখ্যা ২.৬ মিলিয়নে পৌছেছে— এদের মধ্যে দুই মিলিয়ন আশ্রয় নিয়েছে রাজনৈতিকভাবে বিস্ফোরণােন্মুখ জনবহুল পশ্চিমবঙ্গে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিদিন আসছে আরাে হাজার হাজার শরণার্থী। বিগত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ সরকার যে আশঙ্কা করে আসছেন দরিদ্র ভারতীয়দের মধ্যে তেমনি প্রতিক্রিয়ার লক্ষণ ফুটে উঠছে এবং তাদের রুজি-রােজগারের জন্য উদ্বাস্তুরা প্রতিযােগিতা করে মজুরি নামিয়ে আনলে পরিস্থিতি আরাে খারাপ হবে। সেই সাথে জিনিসপত্রের দামও বেড়ে গেছে, যেহেতু খাদ্য ও নিত্যপ্রয়ােজনীয় সামগ্রীর ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত থেকে দুই মাইলের মধ্যে এখানে পশ্চিম বাংলার এই শহরে ৫০০০ শরণার্থীর জন্য গড়ে তােলা তাঁবুর আশ্রয়স্থলে গিজগিজ করছে ১০,০০০ মানুষ। পেট্রাপােল যেখানে অবস্থিত সেই বনগাঁ জেলার জনসংখ্যা হচ্ছে ৩০০,০০০। কর্মকর্তারা বলেছেন, ইতিমধ্যে এই জেলায় ২৫০,০০০-এরও বেশি শরণার্থী এসেছে। খেতমজুরদের দৈনিক মজুরি ছিল তিন রুপি বা প্রায় ৪০ সেন্ট। এখন বাড়তি শ্রম সরবরাহের ফলে মজুরি নেমে এসেছে দুই রুপিতে, কখনাে কখনাে এক রুপিতেও অন্যান্য ধরনের কাজকর্মও একইভাবে প্রভাবিত হয়েছে। পেট্রাপােল ক্যাম্পের পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এস.আর. দাশ জানালেন, ‘ক্যাম্পে যেহেতু শরণার্থীদের আহার যােগানাের ব্যবস্থা রয়েছে এবং খাবার কেনার জন্য টাকার দরকার নেই, তাই এইসব মানুষ যে কোনাে মজুরিতে কাজ করতে প্রস্তুত।

সরকার চায়, ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে কাজের বাজারে না গিয়ে শরণার্থীরা বরং শিবিরের ভেতরে অবস্থান করুক। কিন্তু এটা বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দেওয়া যায় না।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, এই সমস্যা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। কী করার রয়েছে ? মি. দাশ বলেন, স্থানীয় জনসাধারণ শরণার্থীদের নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে, কিন্তু এক্ষেত্রে কীই-বা করার রয়েছে ? অন্যান্য কর্মকর্তাব্যক্তিগত জীবনের ওপর চাপের উদাহরণ দিয়ে বিভিন্ন ঘটনার কথা জানিয়েছেন। শরণার্থীদের আশ্রয়দানের জন্য বহু বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়াতে অস্থির হয়ে উঠছেন ছাত্র ও অভিভাবকবৃন্দ। কোনাে কোনাে ভারতীয়ের অভিযোেগ যে, তাঁদের চাইতে ভালাে খাবার জুটছে শরণার্থীদের। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের ১৩৫০ মাইল সীমান্ত ঘেঁষে যে তিনশতাধিক আশ্রয় শিবির গড়ে উঠেছে তার অনেকগুলাের তুলনায় এই শিবির আদর্শস্থানীয় হলেও সুষ্ঠু ও প্রয়ােজনীয় অনেক ব্যবস্থাই এখানে নেই। পায়খানার সংখ্যাল্পতা এবং যথাযথ আব্রুর অভাবের দরুন মাঠ জুড়ে দূষণ সমস্যা সৃষ্টি করছে শরণার্থীরা। জীবাণুনাশক ব্লিচিং পাউডার ছড়ানাে হয়েছে সর্বত্র। কলেরার ইনজেকশন শরণার্থীদের কলেরার ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে।

পেট্রাপােলে নয় অন্যত্র ক্যাম্পে কলেরার বিস্তার ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তবে পেট্রাপােল ক্যাম্প হাসপাতালের অধিকাংশ রােগী আমাশা-পীড়িত। শিবিরের লাউড স্পিকার থেকে স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত নির্দেশমালার অনবরত উদ্গারণ চলছে, আশ্রিতদের বিভ্রান্তি তাতে বাড়ছে বলেই মনে হয়। পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনকল্পে ২৫ মার্চ পাকবাহিনীর আক্রমণ। শুরুর পর থেকে ভারত এককভাবে শরণার্থী সমস্যা মােকাবেলায় তার অপারগতার কথা জানিয়ে আসছে। এজন্য বিদেশী সহায়তার আবেদন জানিয়ে এলেও আজ পর্যন্ত সাহায্য মিলেছে সামান্যই।  শরণার্থীদের দায়িত্ব যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই দাবির পক্ষে যুক্তি পেশকালে ভারত ১.৪ মিলিয়ন প্যালেস্টাইনি উদ্বাস্তুর কথা তুলে ধরেছে জাতিসংঘ যাদের তদারকি করছে। ভারতে আশ্রিত শরণার্থীর সংখ্যা ইতিমধ্যে ঐ সংখ্যা ছাপিয়ে গেছে। ভারতীয়। কর্মকর্তাদের হিসেবে অনুযায়ী শরণার্থীদের সংখ্যা ১০ মিলিয়নে পৌছুতে পারে এবং এ   বাবদ বার্ষিক ব্যয় দাঁড়াবে কোটি কোটি ডলার। গতকাল এক কূটনীতিক-পত্রে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযােগ করেছে যে তারা উদ্বাস্তুদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণােদিত সন্ত্রাস অভিযান চালাচ্ছে। ভারত জোরের সঙ্গে উল্লেখ করেছে, ‘উদ্বাস্তুদের স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের যথােপযােগী ব্যবস্থা গ্রহণে পাকিস্তান প্রশ্নাতীতভাবে বাধ্য।’ পত্রে আরাে উল্লেখ করা হয়, ‘উদ্বাস্তুদের আশ্রয়দানের ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব পাকিস্তানের ওপর বর্তায়।’ শরণার্থী শিবিরসমূহে দুইদিনের সফরের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আজ বিকেলে পেট্রাপােল ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। বাংলাভাষী শরণার্থীদের কাছে বােধগম্য হিন্দী ভাষায় কথােপকথনকালে তিনি তাঁদের বলেন, “আপনারা এখানে এসেছেননিঃস্ব ও ক্ষুধার্ত, সাহায্যের প্রত্যাশী হয়ে। ভারত স্বয়ং অতি দরিদ্র দেশ, তা সত্ত্বেও আমরা যথাসম্ভব আপনাদের সহায়তা দান করবাে এবং আবার ঘরে ফিরে যেতে আপনাদের সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করতে চেষ্টা করব।’ 

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!