You dont have javascript enabled! Please enable it!

পূর্ব পাকিস্তান ঘিরে ভারতের ১৩৫০ মাইল দীর্ঘ সীমান্তের চেহারা দাঁড়িয়েছে এক অন্তহীন ও চরম দুর্দশাগ্রস্ত জিপসি ক্যাম্পের মতাে। পাকবাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এসেছে ভীত ও হতবিহ্বল মানুষের বিরাট ঢেউ—ভারত বলছে এই সংখ্যা তিন মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকায় প্রতিদিন আরাে হাজার হাজার মানুষ ভারতে আসছে। অর্ধেকের মতাে শরণার্থীর জন্য ভারত বাস-সংস্থান করেছে বিশ্রীভাবে জনবহুল। ক্যাম্পগুলােতে, স্কুল ও ছাত্রাবাসগুলাে বন্ধ করে ঝটিতি এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অন্যরা থাকছেন বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে। | নতুন শিবিরে যাওয়ার অপেক্ষায় পথের ধারে পড়ে রয়েছেন আরাে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ—কোনােরকমে আচ্ছাদন তাঁরা দাঁড় করিয়ে নিয়েছেন, অথবা থাকছেন খােলা আকাশের নিচে, মৌসুমি বর্ষণের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়হীনভাবে, যে বর্ষণ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। রাস্তার ধারে রাখা পয়ঃনিষ্কাশনের বিশালাকার কংক্রিটের পাইপ হয়েছে কারাে কারাে আশ্রয়স্থল। কোনাে রাস্তায় দেখা যায় একদা-সচ্ছল বাঙালি ভিক্ষা করছেন। প্রতিদিন ব্যাপকসংখ্যক শরণার্থীর আগমনে পরিস্থিতি সামাল দেয়া ভারতের জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে উঠেছে, যে- দেশটির সম্পদের ওপর ইতিমধ্যেই চাপ পড়েছে। তবে ভারত যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে।  শিবিরের স্বাস্থ্য সমস্যা গুরুতর। খােলা জায়গায় মলমূত্রত্যাগ সাধারণ ঘটনা। কতক স্থানে ইতিমধ্যেই কলেরা রােগ-সংক্রমণ   ঘটেছে। আমাশয় ও অন্যান্য আন্ত্রিক রােগ বেশ ব্যাপক। এমন কি যেসব শিবিরে প্রাথমিক পয়ঃসুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেখানকার অবস্থাও হতদ্দশায় পতিত মানুষের গিজগিজে ভিড়ে। কোনাে কোনাে শিবিরে সবসময় বাতাসে ভাসছে তীব্র কটু গন্ধ এবং ময়লা ফেলা হচ্ছে যত্রতত্র। এই সপ্তাহে ভারত সরকার আয়ােজিত তিনদিনব্যাপী সাংবাদিকসফরকালে শরণার্থীদের অবস্থা দেখে বােঝা গেছে যে, গত নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসে পূর্ব পাকিস্তানের বদ্বীপ এলাকায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু এবং দুই মিলিয়নের নিরাশ্রয় ও ক্ষুধার্ত হওয়ার ঘটনা থেকেও মানবিক মাপকাঠিতে অধিকতর ধ্বংসাত্মক হয়েছে পাকবাহিনীর সামরিক অভিযান। মানুষের দুর্গতির পরিমাপ অথবা তুলনা করা যদিও একটা কঠিন কাজ, তবুও ঘূর্ণিঝড় থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের তুলনায় বিমূঢ় শরণার্থীদের মনে হয় মানসিকভাবে আরাে ভেঙেপড়া। কেননা যুগ যুগ ধরে তাঁরা যা করে এসেছে, দুর্গতির জন্য এবার তাঁরা আল্লাহর ইচ্ছের কাছে নিজেদের সমর্পণ করতে পারছে না। তাঁরা দোষ দিচ্ছে ‘পাঞ্জাবিদের’—পাকিস্তানি বাহিনী প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবিদের নিয়ে গঠিত। যেহেতু এই দুর্গতি মানব-সৃষ্ট, তাই এর মােকাবেলায় তাঁরা যেন তত সক্ষম নন।

বৈদেশিক সহায়তা নেই

নিজ ভূমিতে বসবাসের নিরাপত্তা অনুভব তাঁদের নেই। নেই বিপুল বৈদেশিক সাহায্য ঘূর্ণিঝড়ের পর যেমনটা ঘটেছিল। কোনাে কোনাে শরণার্থী ক্যাম্পেআছেন এক মাসের ওপর, তারপরও তাঁদের ভয় কাটে নি। প্রায় প্রত্যেকেই তাঁদের পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয় অথবা বন্ধুজনদের হারিয়েছেন। এবং অনেকেই হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছেন। অনেককেই দেখাচ্ছে বৃদ্ধ-আবাসের নিঃশক্তি বুড়াের মতাে, শূন্য দৃষ্টি নিয়ে এলােমেলাে ঘুরে ফিরছে। অন্যেরা ডুকরে কেঁদে উঠছে যখনই ভাবছে তাঁদের ওপর দিয়ে কী দুর্ভাগ্যই-না বয়ে গেছে। শিশুদের মধ্যে নেই প্রাণবন্ততা। ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর কোণে সাব্রুমের শরণার্থী শিবিরে ৪৫ বৎসরের এক মহিলা, যাঁকে দেখাচ্ছিল থুথুড়ে বৃদ্ধার মতাে, সাংবাদিকদের পিছে পিছে ফিরছিলেন তাঁর ১৬ বৎসরের যমজ কন্যাদের খুঁজে দেওয়ার জন্য। তিনি বিড়বিড় করছিলেন এবং মনে হচ্ছিল যেন কোনাে মানসিক বিপর্যস্ততার মধ্যে রয়েছেন। তিনি জানালেন, পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল এবং সবাই বেরিয়ে এলে সৈন্যরা দুই কন্যাকে ধরে টেনে নিয়ে যায়। বাঙালিদের অনেকেই বলছেন তাঁদের শহর-গ্রাম বসবাসের জন্য নিরাপদ হয়ে উটলে তাঁরা ফিরে যাবেন। কোনাে প্রত্যয় ছাড়াই তাঁরা বলছেন যে এটা শিগগিরই ঘটবে। সাব্রুম থেকে কয়েক মাইল দূরে ১২,০০০ শরণার্থী ওপচানাে ক্যাম্পে দেড় বছরের একটি শিশু, তার বয়সের তুলনায় ক্ষুদে, দৃশ্যত অপুষ্টিতে ভুগছে, উঠে দাঁড়িয়ে হেঁটে যেতে চেষ্টা করছিল বেড়ার ঘরের দিকে, যেখানে অন্য কতক পরিবারের সঙ্গে তার বাবা-মাও  রয়েছে। শরীরে কোনাে শক্তি না থাকায় শিশুটি, ছােট মুখবিবরে বিস্ফারিত চোখ নিয়ে, দুলতে দুলতে পড়ে গেল। সে হামাগুড়িও দিতে পারছিল না।

ভিড়াক্রান্ত হাসপাতাল

এমনি সমস্যার কারণে সীমান্তবর্তী শহরগুলাের ভারতীয় হাসপাতাল রােগীর ভিড়ে উপচে পড়ছে। এদের অনেকেই গুলিতে আহত। আগরতলায় ২৬০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি হাসপাতালে বুধবার দিন ছিল ৫৪০ জন রােগী, এর মধ্যে প্রায় ১০০ জনের রয়েছে বুলেটের ক্ষত। এক ডাক্তার জানালেন, আগের দিন এমনি আঘাত নিয়ে প্রায় ৪০ জন রােগী এসেছিল। আহতদের মধ্যে মাত্র সামান্য ক’জনই বাঙালি স্বাধীনতা বাহিনীর সদস্য, সীমান্তে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে প্রায়শ যাঁদের সংঘর্ষ ঘটছে। বাদবাকি সবাই বেসামরিক নাগরিক, স্পষ্টতই যাঁরা নিরস্ত্র এবং প্রায় ক্ষেত্রে পালানাের সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এদের মধ্যে কতক শিশুও রয়েছে। তিন মাসের এক বাচ্চার উরুদেশে গুলি লেগেছে। সন্তানসম্ভবা এক নারী তলপেটে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ১১ বছরের এক বালক হাঁটুর পেছনে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। ডাক্তার জানালেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আহতরা হচ্ছে পুরুষ, কারণ নারী ও শিশুদের পথেই মৃত্যু ঘটছে। হাসপাতাল একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার এবং বেশ দক্ষভাবে পরিচালিত বলেই মনে হয়। তবে শয্যার অভাবে অনেক রােগীকেই মাটিতে বিছানা পাততে হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে আগত ১৭ বৎসরের হিন্দু ছাত্র সুবলকান্তি নাথ, যাঁর ডান হাত ঝরঝরে হয়ে গেছে, আমাদের জানালেন যে, কোনােরকম হুশিয়ারি ছাড়াই ৪০০ সৈন্য ৫০টি হিন্দু পরিবার অধ্যুষিত তাঁদের মহল্লা ঘিরে ফেলে। মেশিনগান বসানাে জিপ ও ট্যাঙ্কও ছিল কিছু। এবং মিলিটারিরা হঠাৎ গুলি ছুড়তে শুরু করে।

তিনি বলেন, গােলাগুলির ফলে আহত হওয়া সত্ত্বেও তিনি বাড়ির পেছন দিক দিয়ে দৌড়ে পালাতে সমর্থ হন। পরিবারের অন্যদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তিনি জানেন না। অনেক হিন্দুর মতাে তিনিও পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেতে চান না, প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে তিনি স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে নিতে চান। সীমান্ত পেরিয়ে মুসলমানদের চাইতে অনেক বেশি সংখ্যায় পালাচ্ছে সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দুরা, যাঁরা হয়ে উঠেছে পাঞ্জাবিদের বিশেষ লক্ষ্যবস্তু। ৭৫ মিলিয়ন পূর্ব পাকিস্তানির মধ্যে ১০ মিলিয়ন হিন্দু হচ্ছে আওয়ামী লীগের কড়া সমর্থকদের অংশ। হিন্দুরা যদিও এখনাে আন্দোলনের আদর্শ নিয়ে উচ্চকণ্ঠ, কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যদের হটাবার কোনাে আশু সম্ভাবনা তাঁরা দেখছেন না। ‘আমরা জানি না কী করতে হবে’ ‘আমরা অসহায়, জানি না কী করতে হবে’, বলেছেন নিয়তি রানী চৌধুরী, ২০ বৎসর বয়স্ক  এই কলেজছাত্রী জানিয়েছেন যে সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষণ ও বাড়িতে অগ্নিসংযােগের দৃশ্য দেখে তিনি ও তাঁর পরিবার পালিয়ে এসেছেন। ধর্ষণের কথা বলতে গিয়ে বিব্রত হয়ে মাথা বুকে এলাে তাঁর।  ভারত সরকার আশাবাদিতার সঙ্গে বলছে যে, শরণার্থীরা ছয় মাসের ভেতর দেশে ফিরে যাবে। কিন্তু পাকবাহিনীর অব্যাহত তৎপরতা ও গেরিলা প্রতি-আক্রমণের প্রেক্ষিতে ভারতীয় কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে মত ব্যক্ত করেন যে, এমন আশা করাটা ইচ্ছাপূরণের ব্যাপার।  বস্তুত সরকার এখন অনুমান করছে শেষ পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা ছয় মিলিয়নে দাঁড়াতে পারে। এমনকি এটাও একটা আনুমানিক হিসেব মাত্র। কোনাে কোনাে কর্মকর্তা মনে করেন শরণার্থীর সংখ্যা আরাে বৃদ্ধি পাবে। কোনাে কোনাে আশ্রয়শিবিরে সীমান্তের ওপার থেকে মর্টার ও কামানের গােলা ছোঁড়ার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। শেল এবং টুকরাে অংশ কখনাে কখনাে ভারতে এসে পড়ে। কয়েন ভারতীয় ও শরণার্থী এতে হতাহত হয়েছেন। সাব্রুমের একটি শরণার্থী শিবির থেকে ১০০ গজের মধ্যে পাকবাহিনী ঘাঁটি গেড়েছে। তাদের ফারাক করে রেখেছে ফেনী নদী, ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সীমানা, যে নদীতে সাঁতার কেটে বেড়ায় বাঙালিদের অনেকে।

যুদ্ধে যােগদানের পরিকল্পনা

শরণার্থীদের কেউ কেউ জানান বাংলাদেশের জন্য লড়তে তাঁরা স্বাধীনতা বাহিনীতে যােগ দেবেন। তবে শিবিরে বিরাজমান রাজনৈতিক মনােভাব সম্পর্কে সাধারণীকরণ করা মুশকিল। | অন্যান্য অনেকে—কায়ক্লেশে দিন গুজরানকারী গরিব কৃষক অথবা সুবিন্যস্ত জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট আমলা—রাজনীতিতে আগ্রহী ছিলেন না। কারাে কারাে এখনও কোনাে আগ্রহ নেই এবং লড়াইয়ে যােগ দেওয়ার কোনাে উদ্যম তাঁদের মধ্যে দেখা যায় না। একটি বড় কারখানার প্রধান হিসাবরক্ষক ছিলেন এমন একজন হিন্দু বললেন, ‘আমার পরিবার রয়েছে। সেটাই হচ্ছে বড় সমস্যা।’ অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতি-বিমুখ ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন রাজনীতি-সচেতন। ৩২ বৎসরের মুসলিম শিক্ষক খালেদ হােসেন পায়ে আঘাত পেয়েছেন এবং আগরতলা হাসপাতালে এখন নিরাময়ের পথে। তিনি খােলাখুলি না বললেও আকারে-ইঙ্গিতে জানিয়েছেন গত ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে তিনি ভােট দেন নি। এখন একজন জঙ্গি স্বাধীনতা সংগ্রামীর মতাে শােনাচ্ছে তাঁর কথাবার্তা। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে কি করবেন জিগ্যেস করা হলে তিনি জবাব দিলেন, ‘আমি মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিয়ে লড়াই করবাে।’ 

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!