You dont have javascript enabled! Please enable it! যুদ্ধের নরক-যন্ত্রণা পােহাচ্ছে কেবল এক পক্ষই-আগরতলা ভারত এপ্রিল ১৯৭১ - সংগ্রামের নোটবুক

সবাই বলে যুদ্ধ হচ্ছে নারকীয় ব্যাপার, তবে সাধারণত এই নরকযন্ত্রণা যুদ্ধরত উভয় পক্ষের ক্ষেত্রেই সত্য।  তা সত্ত্বেও পাকিস্তান আর্মি এবং সশস্ত্র শক্তিতে বহুলাংশে দুর্বল প্রতিরােধ যােদ্ধাদের মধ্যে তিন সপ্তাহের যুদ্ধে নরক সৃষ্টি হয়েছে। কেবল একদিকেই—সেটা ঘটেছে হাজার হাজার পূর্ব পাকিস্তানি বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষেত্রে, বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনকে সন্ত্রস্ত, ভীত ও দমন করার লক্ষ্যে পাক আর্মির গণহত্যার শিকার যাঁরা হয়েছেন। প্রধান নগরী ও শহরগুলাের ওপর দখল কায়েমের পর সেনাবাহিনী, সম্পূর্ণত পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিয়ে যা গঠিত এবং যাদের অনেকেই বাঙালিদের প্রতি তীব্র জাতিবিদ্বেষ পােষণকরে—এখন গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করছে। বর্ষা মৌসুমের আগেই তারা এই নিয়ন্ত্রণ সম্প্রসারণ করতে চাইছে। নতুবা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রবল ধারাবর্ষণ শুরু হয়ে নিয়মিত বাহিনীর চলাচল বিঘ্নিত করবে।  একজন বাঙালি অফিসার জানালেন, ‘হাঁটুজলে হিমশিম খেয়ে ওরা ডুবে মরে। আমরা দেশী নৌকো ব্যবহার করবাে। ওদের নাজেহাল করে ছাড়বাে। আগামীতে এক দীর্ঘ ও বিষন্ন যুদ্ধের শঙ্কা দেখা দিচ্ছে। বেশির ভাগ কূটনীতিক ও বিদেশী পর্যবেক্ষক মনে করেন যে, প্রলম্বিত যুদ্ধ চালিয়ে বাঙালিরা শেষ পর্যন্ত জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে পারবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের, যারা তাদের আবাস ও সরবরাহ কেন্দ্র থেকে হাজার মাইল দূরে রয়েছে। তবে বৈদেশিক পর্যবেক্ষকরা এটাও মনে করেন যে, পাক সরকারের ওপর বিদেশী শক্তিসমূহ অর্থনৈতিক চাপ প্রয়ােগ না করলে  প্রদেশের ওপর শোষণের অবসান ঘটিয়ে ৭৫ মিলিয়ন বাঙালির চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জনে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। এই অর্থনৈতিক শােষণ থেকেই জন্ম নিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার তাগিদ। | প্রত্যেক ঘটনা, প্রত্যেক বিতর্ক, প্রত্যেক সংঘর্ষের সাধারণত থাকে দু’টি দিক। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনী যা করছে, তা প্রত্যক্ষ করার পর এর কোনােরকম যৌক্তিকতা খুজে পাওয়া মুশকিল। এর কারণ, প্রাপ্ত সকল তথ্যপ্রমাণ থেকে স্পষ্টভাবে বােঝা যায়, পাকবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বংস এবং সকল নেতা ও সম্ভাব্য নেতাকে হত্যার সঙ্কল্প নিয়ে অভিযানে নেমেছে। একজন বাঙালি সৈনিক বললেন, “তারা আমাদের এতােটা পাতালে টেনে নামাতে চায় যেন আমাদের ঘাস খেয়ে বাঁচতে হয়। তারা নিশ্চিত হতে চায় যেন তাদের বিরুদ্ধে আর কেউ মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহস না পায়। | বাঙালি ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, সেনা অফিসার, প্রকৌশলী, ডাক্তার ও নেতৃত্বের গুণসম্পন্ন অন্য সবাইকে পাক আর্মি হত্যা করছে।

পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবকাঠামাে—খাদ্যগুদাম, চাবাগান, পাটকল ওপ্রাকৃতিক গ্যাসের খনি ধ্বংসের জন্য পাকবাহিনী ব্যবহার করছে ট্যাঙ্ক, জঙ্গি বিমান, ভারি কামান ও গানবােট বহর। এসব অস্ত্রের বেশির ভাগই এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট চীন থেকে। প্রতিরােধ বাহিনীর সবচেয়ে ভারি অস্ত্র হচ্ছে তিন ইঞ্চি মটার। সামান্য কতক ভারি কামান তারা দখল করেছে। বাঙালি সৈনিকদের কারাে কারাে পায়ে জুতাে নেই। বাঙালিদের প্রতিরােধের মূল কেন্দ্র হচ্ছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য, যাঁদের সংখ্যা ১২,০০০ থেকে ১৫,০০০ এবংআক্রমণ শুরু হওয়ার পর এদের সবাই পাকবাহিনীর কাতার থেকে পালিয়ে এসেছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছে। তবে এই মুহূর্তে এমন পদক্ষেপের লক্ষ্য প্রধানত বাঙালিদের মনােবল অটুট রাখা এবং যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সমন্বয় সাধন করা। অব্যাহত যুদ্ধের ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অঞ্চলের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই বৎসর মাঠে বের হয়ে ফসল বােনার ঝুঁকি নিচ্ছে না বাঙালি কৃষকেরা। পাটের রপ্তানি ঘটছে না এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিরাটকীয়বস্ত্রশিল্প তাদের নিম্নমানের উচ্চমূল্যের সুতি কাপড় পূর্ব পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করতে পারছে না। বাইরেও এর কোনাে বাজার নেই। একটি প্রশ্ন হচ্ছে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর অভিযান চালিয়ে যাওয়ার মতাে পর্যাপ্ত সাহায্য কমিউনিস্ট চীন পাকিস্তানকে দেবে কিনা। গত সপ্তাহে পাকিস্তান সরকারকে প্রেরিত এক নােটে চৌ এন লাই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ব্যাপক হস্তক্ষেপের জন্য’ যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের নিন্দাবাদ করেছেন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা আগ্রাসন শুরুর দুঃসাহস দেখালে’ চীনের সমর্থনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। এমনি আরেক প্রশ্ন হচ্ছে পশ্চিমী সাহায্যদাতা গােষ্ঠী, বিশেষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যারা পাকিস্তানকে বার্ষিক ১৭৫ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক রক্তপাত বন্ধ না করা পর্যন্ত সাহায্য স্থগিত রাখবে কিনা।  বিদেশ মন্ত্রণালয়ের আকাঙক্ষা হচ্ছে রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য চাপ দেওয়া, সেসম্ভাবনা যতাে সুদূরপরাহত হােক না কেন।

এই নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কবলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, চীনের প্রভাবের প্রাধান্য রােধ করতে যেখানে আমেরিকা একটি অবস্থান বজায় রাখতে চাইছে। তদুপরি রয়েছে মূলত পশ্চিমপন্থী স্বাধীনতা আন্দোলনকারী পূর্ব পাকিস্তানের শুভেচ্ছা হারানাের বিপদ। সরকারি বেতার মারফত পাকিস্তান সরকার যুদ্ধের প্রায় সকল কিছুর জন্য প্রায়শ ভারতকে অভিযুক্ত করছে। তাদের মতে, ভারতই স্বাধীনতাকামী বাহিনীকে অস্ত্র ও সৈন্য যােগাচ্ছে, পাকিস্তানি জাহাজকে উত্যক্ত করছে, গােপন বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে এবং গণহত্যা ও বর্বরাচরণ বিষয়ে ফাঁপানাে বিবরণ ছাপতে পত্রপত্রিকাকে উৎসাহিত করছে। এই সমস্ত অভিযােগ, যার সবই ভারত বারংবার অস্বীকার করেছে, বিশ্ব-সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা লাভ করেছে। এর প্রধান কারণ এইসব প্রচারের পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার মতাে কোনাে রেডিও বাংলাদেশের নেই।  স্বাধীনতা আন্দোলনকে ভারত সম্ভবত সমর্থন সহায়তা যােগাচ্ছে, তবে অস্ত্র, গােলা ও সৈন্য দিয়ে সাহায্যের কোনাে নজির এখনাে মেলে নি।  ভারতকে যাবতীয় অপকর্মের জন্য দায়ী করা ছাড়াও রেডিও পাকিস্তান ও সরকারনিয়ন্ত্রিত পশ্চিম পাকিস্তানি সংবাদপত্র পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে বলে দৈনিক ঘােষণা দিয়ে চলেছে। ব্যাপক জনসমর্থিত স্বাধীনতা আন্দোলনকে তারা ‘কতিপয় দুষ্কৃতকারীর কারসাজি’ বলে অভিহিত করছে এবং বলছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি পুনরায় চাঙ্গা হয়ে উঠছে ও পাট রপ্তানি শুরু হয়েছে। এসবই নির্জলা মিথ্যা।  

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ