You dont have javascript enabled! Please enable it!

 

পশ্চিমবাংলা রাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলাগুলােতে ছত্রখান হয়ে যাওয়া বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের পশ্চিমী ইউনিটগুলাে আবার সংগঠিত হতে চেষ্টা করছে। গেরিলা কায়দায় পুনরায় প্রত্যাঘাত হানার জন্য তাঁরা নিজেদের তৈরি করতে চেষ্টা করছেন। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের বিগত দুই সপ্তাহব্যাপী অভিযানে পশ্চিমী জেলাগুলাের সকল প্রধান শহর-বন্দর কার্যত দখল করে নিয়েছে। অধিকতর ভারি অস্ত্রসজ্জিত আরাে বিশাল বাহিনীর মুখােমুখি হয়ে বাঙালি সৈন্যরা পিছু হটেছে, অনেক ক্ষেত্রে কোনাে লড়াই না করেই। তবে তাঁরা তাঁদের অস্ত্র বিসর্জন দেন নি। বেশিরভাগ যােদ্ধাই পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের গ্রাম এলাকায় মিলিয়ে গেছেন। তিনদিন আগে উল্লেখযােগ্য বাঙালি প্রতিরােধ ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া হয় পূর্ব পাকিস্তানি শহর মেহেরপুর। সেখান থেকে প্রায় ছয় মাইলের মধ্যে অবস্থিত এই ভারতীয় সীমান্ত শহরে এখন অনেক বাঙালি সৈনিক ও অফিসার জমায়েত হয়েছেন আবার নিজেদের গুছিয়ে | মেহেরপুর কলেজের ২১ বৎসরের ছাত্র ইউসুফ গণি ধীরভাবে জানালাে, ‘যতদিন পর্যন্ত একজন বাঙালিও জীবিত থাকবে আমরা লড়াই থেকে ক্ষান্ত হবে না।’ কান্নায়-ভেঙেপড়া মানুষ ছাত্রটি যখন তার কথা বলে চলেছিল তার পাশের মানুষটি কাঁদতে শুরু করলাে। দু’গাল বেয়ে নেমে আসছিলাে অশ্রুধারা এবং শরীর বারবার কেঁপে উঠছিলাে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন, আমার এক খালাত ভাইকে ওরা হত্যা করেছে। সে বাজার থেকে  ফিরছিলাে। ওরা পেছন দিক থেকে তাকে গুলি করে। আমি তাকে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখেছি।’ এই মুষড়ে-পড়া ব্যক্তি হচ্ছেন আবদুল আজিজ, মেহেরপুরের ৪২ বৎসর বয়স্ক চাল। ও পাট ব্যবসায়ী। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের একজন কর্মী। ব্যবসায়ী ভদ্রলােক জানালেন, গতকাল রাতে তিনি যখন মেহেরপুর ছাড়েন তখনও ‘চারপাশে লাশ ছড়িয়ে ছিলাে। তিনি বলেন, সৈন্যরা খুঁজছে ছাত্র, অধ্যাপক, আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের। তাঁদের হাত-পা পিছমােড়া করে বেঁধে পেছন দিক থেকে গুলি করা হয়।

ব্যবসায়ীরা ভদ্রলোক জানালেন,সেন্যরা দোকান পাট লুট করে,খদ্য মজুদ ধ্বংস করে। ‘আমি ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছি। যতদিন পর্যন্ত অস্ত্র প্রশিক্ষণ পাই এবং ফিরে গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়তে পারবাে ততদিন পর্যন্ত আমি এখানে থাকবাে। বাঙালিরা স্বীকার করে তাঁদের গুরুতর সমস্যা রয়েছে—গােলাবারুদের অভাব, ভারি। অস্ত্রশস্ত্র নেই, দেশের সর্বত্র স্বাধীনতাকামী শক্তির মধ্যে যােগাযােগ দুর্বল অথবা নেই বললেই চলে। অধিকাংশ স্বেচ্ছাসেবকেরই কোনাে প্রশিক্ষণ নেই এবং অফিসারদের বিশেষ সংখ্যাল্পতা রয়েছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরােধ পাকবাহিনী। দমন করেছে এমন বক্তব্যে তাঁরা ক্ষিপ্ত বােধ করে। আধা-সামরিক বাহিনীর এক অফিসার জানালেন, মেহেরপুরে প্রতিরােধ দাঁড় করানাের কথা আমরা ভাবতেই পারি না। ওদের রয়েছে মর্টার ও কামান। একমাত্র যা করার ছিল তা হলাে গ্রামাঞ্চলে চলে গিয়ে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ। তাদের সঙ্গে মুখােমুখি লড়বার মতাে ভারি কামান আমাদের ছিল না। ঘরের একপাশের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছিল ছয়টি এনফিল্ড রাইফেল এবং দুটি শটগান। মেঝেতে রয়েছে কিছু গােলাবারুদ। অফিসারটি কথা বলবার সময় কাপড়ের থলেতে করে এনফিল্ড রাইফেলের কিছু কার্তুজ নিয়ে ঢুকলাে একজন এবং মেঝেতে তা বিছিয়ে রাখলাে। জটিল ভবিষ্যতের শঙ্কা বাঙালি স্বাধীনতা যােদ্ধাদের দৃঢ়সঙ্কল্প সত্ত্বেও ভারতে অনেক পশ্চিমী পর্যবেক্ষকই মনে করেন যে, কোনাে ধরনের বৈদেশিক সহায়তা না পেলে আন্দোলনের সামনে দেখা দেবে। জটিল সময়, সম্ভবত এক অসাধ্য নিয়তি।  ভারতীয়রা যেনানা ধরনের সাহায্য যােগাচ্ছে—খাদ্য, পরিবহন, হাসপাতাল, আহতদের পরিচর্যা, আশ্রয় শিবির—সেটা বেশ দৃশ্যগােচর, তবে বাঙালিরা বলছে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সরকারিভাবে কোনাে সামরিক সহায়তা পাওয়া যায় নি। | বাঙালি সৈনিকরা, যাঁদের অধিকাংশই এসেছে সীমান্তরক্ষী ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস থেকে, বেদাই এবং তার আশপাশে ক্যাম্প করে রয়েছে। কিছু সৈন্য রয়েছে সেখানকার বি.এস.এফ ঘাঁটিতে। সেখানে রয়েছে স্বাধীনতাকামী বাহিনীর কতক জিপ ও ট্রাক। 

সীমান্তঘাঁটির প্রবেশদ্বারে একজন মার্কিন সংবাদদাতা হাজির হওয়ার সাথে সাথে গাড়িগুলাে থেকে বাংলাদেশের সবুজ, লাল ও স্বর্ণালী পতাকা খুলে নেওয়া হয়। | এই সংবাদদাতা যখন এলাকার বাঙালি বাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আজিম চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে চান ভারতীয় সৈনিক জানায় তিনি ঘাঁটিতে নেই। কিন্তু পরে বাঙালিদের সূত্রে জানা যায় তিনি সেখানেই ছিলেন। | বাঙালি সৈনিকরা বেদাইতে যথেচ্ছভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চুল কাটছে, খাবার কিনছে, পান চিবােচ্ছে, চা খাচ্ছে। প্রায় ১০০ মাইল দক্ষিণের শহর কলকাতায় যাওয়া-আসা করছিল বাংলাদেশের কতক গাড়ি।। | কৃষ্ণনগর শহর থেকে কয়েক মাইল উত্তরে বর্তমান সংবাদদাতার ভাড়া-করা গাড়ির সঙ্গে বাংলাদেশের এক জিপের সামান্য সংঘর্ষ ঘটে। ই.পি.আর সৈন্যদের এই জিপ ও সঙ্গের ট্রাক বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল জ্বালানি তেলের খালি ড্রাম এবং গােলা ও বিস্ফোরকের খালি। বাক্স । গাড়ি দুটি সরবরাহ আনতে বেদাই থেকে কৃষ্ণনগর যাচ্ছিল। | এই রাস্তায় আজকেও যথেষ্ট ভারতীয় সামরিক তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। সৈন্য বহনকারী ট্রাকবহর উত্তরের সীমান্তের দিকে এগিয়ে গেছে। উত্তর অভিমুখী একটি সামরিক ট্রাক, কাদা দিয়ে যার গায়ের চিহ্ন লেপ্টানাে, কী বহন করে চলছিল বােঝা গেল না, কেননা পেছনের ত্রিপলের ঢাকনা নামানাে ছিল। 

 

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!