পাকিস্তান এসবই খেলার রীতি— তবে ভয়ঙ্কর ও নির্দয় এক খেলা-নয়াদিল্পি এপ্রিল ৪ -১৯৭১
সবই হয়ে উঠেছিল জরুরি, একান্ত জরুরি, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা-আন্দোলন দমন করতে পাকবাহিনীর অভিযান সম্পর্কে বহিস্কৃত কতক বিদেশী সাংবাদিককে অবহিত করতে গিয়ে একথাই বললেন পশ্চিম পাকিস্তানি বিমানবালা। আপনার দেশে এমনটা ঘটলে আপনারাও একই কাজ করতেন। খেলার রীতিই হচ্ছে এমন। | খেলা? ঢাকায় অবস্থিত বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে এটা মনে হয়েছিল ট্যাঙ্ক, কামান ও ভারি মেশিনগান সজ্জিত হয়ে কার্যত নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর হঠাৎআক্রমণ—যে নাগরিকেরাবিগত ডিসেম্বরের নির্বাচনেঅর্জিত তাদের রাজনৈতিক গরিষ্ঠতার দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছিল অহিংস পন্থায়, ধর্মঘট ও অন্যান্য অসহযােগ পদ্ধতি অবলম্বন করে। এবং চলতি সপ্তাহান্তে যথেচ্ছ হত্যাকাণ্ডের অকাট্য এমন সব তথ্য-প্রমাণ। বেরিয়ে এসেছে, যার দ্বারা নিরাবেগ ভারতীয় কর্মকর্তা ও পশ্চিমা কূটনীতিকদের মনে আর কোনাে সন্দেহ থাকতে পারে না যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি নির্মূল করতে পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মি একেবারে বারাহীন। আক্রমণ শুরু হয় ২৫ মার্চ রাতে, দশ দিনের রাজনৈতিক আলােচনা শেষে। আমি এবং পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ আলােচনা চালানাের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানিদের ভেতর এমন ভাব সঞ্চার করেছিলেন যেন তাদের অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নেওয়া হচ্ছে। এখন এটা পরিষ্কার যে, আলােচনা সফল করে তােলার কোনাে ইচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ছিল না। আলােচনা তারা প্রলম্বিত করেছে স্রেফ সময় ক্ষেপণের জন্য, যাতে করে আক্রমণের জন্য প্রয়ােজনীয় সৈন্য ইত্যবসরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা যায়। তবে আলােচনা যখন চলতেই থাকলাে সাংবাদিক থেকে শুরু করে কূটনীতিক, প্রায় সকল দর্শকই প্রবল আশঙ্কাটি মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল। সবরকম। দুর্লক্ষণ অবশ্য সেখানে ছিল, আকাশ ও সমুদ্রপথে আসছিল সৈন্য, যে সামরিক আইন। প্রশাসক অতি নমনীয় ছিলেন, তাঁকে বরখাস্ত করা হলাে, পূর্ব পাকিস্তানিদের সামরিক নির্দেশ উপেক্ষা করে বরং শেখ মুজিবুর রহমানের কথা মেনে চলার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর। ছিল স্বভাববিরুদ্ধ নিশ্ৰুপতা। সাংবাদিকরা এইসব লক্ষণ তুলে ধরলেও যখনই আলােচনায় কিঞ্চিৎ অগ্রগতির কথা উঠেছে তারা সেটাকে লুফে নিয়েছে। কেননা তেমনটা ঘটাই তাে উচিত ছিল। কিন্তু এ সমস্তই এখন ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বরং জয়ী হয়েছে সামরিক চিন্তাধারা।
কিন্তু শক্তির আশ্রয় নেওয়ার মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা দৃশ্যত তাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা ও ৭৫ মিলিয়ন পূর্ব পাকিস্তানির অনুভূতির গভীরতা দুই-ই বিচার করতে ভুল করে ফেলেছে। ‘তারা ভেবেছিল কিছু বুলেট খরচ করলেই লােকজন ভয় পেয়ে যাবে’, বলেছেন ভারতীয় সীমান্তবর্তী কলকাতার পুলিশ কমিশনার রণজিৎ গুপ্ত। এটা একেবারেই অবাস্তব এর মধ্য দিয়েই বােঝা যায় পূর্ব পাকিস্তানিদের সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। কত কম জানে। | গােলাগুলি বর্ষণের প্রথম পর্বের দ্বারা সন্ত্রস্ত জনগণকে অনুগত করে তােলা যায় নি। এটা এখন পরিষ্কার, আর্মি হয়তাে মহানগরী ও বড় শহরগুলাের ওপর প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। কিন্তু নদীস্নাত সুপ্রাচীন গ্রাম এলাকায় তারা ব্যাপক গেরিলা তৎপরতার সম্মুখীন হবে। পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের সরবরাহ লাইন ও চলাচল এতে এমন বিপর্যস্ত হবে যে, স্বাধীনতা আন্দোলন পরিণামে বিজয়ী হবে। ভারতে পূর্ব পাকিস্তানিদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল অনেকে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমীদের সামরিক অভিযানকে চট করে তুলনা করে বসেনহিটলারের অভিযানের সঙ্গে। কলকাতার একটি পত্রিকার হেডলাইন ছিল, ‘পাকবাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন’। আরেক পত্রিকার শিরােনাম : ‘জল্লাদসুলভ’ এবং লিখেছে, “দখলদার পাকবাহিনী বাংলাদেশে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তা নাৎসি সন্ত্রাসের কালাে অধ্যায়ের চাইতেও কৃষ্ণবর্ণ’। ভারতীয় পার্লামেন্ট এই ঘটনাকে অভিহিত করেছে, প্রতিরক্ষাহীন মানুষকে ব্যাপকভাবে হত্যা যা গণহত্যারই শামিল। সরকার নিচুপ বিশ্বের অন্য প্রায় সকল সরকারই নিশ্ৰুপ রয়েছেন। কলকাতায় জনৈক আমেরিকানকে এক কর্মকর্তা জিগ্যেস করলেন, আপনার দেশ এই হত্যাযজ্ঞের নিন্দা করে না কেন ? এটা কোনাে জলােচ্ছাস নয়, প্রকৃতির কোনাে বৈরিতা নয়—এখানে মানুষ মানুষকে জবাই করছে।
বাঙালিরা একটি তাৎপর্যপূর্ণ রেখা অতিক্রম করেছে— এমন একটি বিভাজন রেখা যা শােষণের বিরুদ্ধে অসন্তোষ এবং শোষকের বিরুদ্ধে লড়াইকে ফারাক করে রেখেছিল। এই রেখা হয়তাে তারা অতিক্রম করেছে ২৪ মার্চ, আক্রমণের রাতে। কিংবা হয়তাে এটা। ঘটেছিল আরাে আগে, ১ মার্চ, যখন সেনাবাহিনী প্রধান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্থগিত ঘােষণা করলেন জাতীয় সংসদের অধিবেশন, পাকিস্তানের বেসামরিক শাসনেপ্রত্যাবর্তনের জন্য প্রয়ােজনীয় শাসনতন্ত্রের মুসাবিদা যে সংসদে দু’দিন পর থেকে শুরু হওয়ার কথা। ছিল। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত এই সংসদে ছিল শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ দলের প্রাধান্য, যারা চাইছিল ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে কেবল প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সাহায্য ও বৈদেশিক বাণিজ্য। পশ্চিম পাকিস্তানি ক্ষমতাচক্র, সেনাবাহিনী ও বৃহৎ ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদদের কাছে এইসব শর্ত ছিল একেবারেই অগ্রহণযােগ্য। সঙ্কট নিয়ে রাজনৈতিক আলােচনা তারা শুরু করেছিল আপসরফার ইঙ্গিত দিয়ে এবং পরে নিয়ে এলাে দুধের মধ্যে চোনা-স্বরূপ জুলফিকার আলী ভুট্টোকে। পশ্চিম পাকিস্তানের এই প্রধান রাজনৈতিক নেতা যখন আপত্তি জানিয়ে বললেন, আওয়ামী লীগ বড় বেশি স্বায়ত্তশাসন চাইছে, সার্বভৌমত্বের প্রায় কাছাকাছি’—তখন আলােচনায় অচলাবস্থা শুরু হলাে। এরপর হঠাৎ করে ঘটলাে সেনাবাহিনীর আক্রমণ। আক্রমণের পরদিন সকালে কড়া সামরিক প্রহরায় ভুট্টো ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের মিত্রভূমিতে। সেখানে এই রাজনৈতিক নেতা দ্রুতই ঘােষণা করলেন, “আল্লাহর রহমতে পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু একটি অখণ্ড মুসলিম দেশ হিসেবে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হলে ধর্মীয় বুলির অতিরিক্ত কিছুর প্রয়ােজন হবে। এমনটা ভাবা হয়েছে যে, দুই অংশকে একত্র ধরে রেখেছে যে সামাজিক আঠা, সেটা হচ্ছে ধর্ম। কিন্তু এই কাজে ধর্ম কখনােই যথেষ্ট ছিল না। | হয়তাে এজন্য দীর্ঘ সময় লাগতে পারে, কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাম্প্রতিক উথান ও পাকবাহিনীর আক্রমণের বর্বরতার যাঁরা সাক্ষী, তাঁরা কেউ এ বিষয়ে আর সন্দেহ। পােষণ করেন না। এবং এখন, বর্তমানে ক্ষত-বিক্ষত তাঁর বাসভবনে সমবেত ভক্ত জনতার উদ্দেশে অতীতে যেমনটি বলতে পছন্দ করতেন শেখ মুজিব : ‘সংগ্রাম, সংগ্রাম, চলবেই চলবে।
সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ