শনিবার সকালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিস্কৃত জায়গায় পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য ও ৩৫ জন বিদেশী সংবাদদাতার মধ্যে মি, শনবার্গও নাগরিকদের মধ্যে সংঘর্ষের খবর পাওয়া ছিলেন। তিনি এই বার্তা পাঠিয়েছেন ভারতের যাচ্ছিল বােম্বে থেকে। ৭৫ মিলিয়ন মানুষের পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে পাকবাহিনী কামান ও ভারি মেশিনগান ব্যবহার করছে। কোনাে সতর্কীকরণ ছাড়াই বৃহস্পতিবার পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক রাতে আক্রমণ শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি আক্রমণ-অভিযান, জোর । সৈন্যরা, সেনাবাহিনীতে রয়েছে যাদের সংখ্যাধিক্য, প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার রাস্তায় লড়াইয়ের খবর, সৈন্যরা নেমে আসে বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন শক্ত ঘাঁটি অবরােধের কামান দাগিয়েছে, উদ্দেশ্যে। নাগরিকদের ওপর। কত নাগরিক আহত বা নিহত হয়েছে সেটা জানার কোনাে উপায় নেই। প্রদেশের গুলিবর্ষণ, বিভিন্ন। বাদবাকি অঞ্চলে কী ঘটছে সে সম্পর্কেও এলাকায় অগ্নিসংযােগ কোনাে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ঢাকা আক্রমণের আগে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন | প্রথমদিকে গােলাগুলি চলছিল বিক্ষিপ্ত, তবে রাত একটার দিকে তা জোরদার ও বিরামহীন হয়ে ওঠে এবং প্রায় তিনঘণ্টা ধরে এমনি চলে। প্রাণের ভয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে আটকে থাকা বিদেশী সংবাদদাতারা কামানের গােলাবর্ষণের আগুন দেখতে পেয়েছেন, শুনেছেন এর শব্দ। উত্তর ঢাকায় অবস্থিত আমাদের হােটেল , থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বাঙালিদের সংখ্যাধিক্যসম্পন্ন আধা-সামরিক বাহিনী ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এরব্যারাকসহ শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশাল দহনজ্ঞ দেখা যাচ্ছিল।
আজ খুব সকালে যখন ৩৫ জন সাংবাদিককে ঢাকা থেকে বহিষ্কার করা হয়, তখনও গােলাগুলির শব্দ শােনা যাচ্ছিল এবং ইতস্তত আগুন জ্বলছিল। ‘হায় আল্লা, হায় আল্লা’, হােটেলের জানালা থেকে এসব দেখে চোখের জল চাপতে চাপতে একজন পাকিস্তানি ছাত্র বলছিল, ওদেরকে মেরে ফেলছে। ওদেরকে জবাই করছে। ঘরে ঘরে অগ্নিসংযােগ সামরিক ট্রাকের বহরে কঠোর পাহারায় বিমানবন্দরের দিকে যেতে যেতে সাংবাদিকরা দেখেছিলেন সৈন্যরা গরিব বাঙালিদের আবাস রাস্তার ধারের বস্তিগুলােতে আগুন জ্বালাচ্ছিল। স্ব-শাসন আন্দোলনের দৃঢ় সমর্থকদের মধ্যে রয়েছে এইসব বস্তিবাসী বাঙালি। | বৃহস্পতিবার রাতে সামরিক অভিযানের শুরু থেকে সৈন্যরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ‘জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, মেশিনগান ও রিকয়েললেস রাইফেলে প্রথমে দালানকোঠায় গােলাগুলি ছোঁড়ে ও পরে গােটা অঞ্চলে আগুন লাগিয়ে দেয়। | বিদেশী সাংবাদিকরা সকলেই অবস্থান করছিলেন হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। কি ঘটছে বােঝার জন্য বাইরে যেতে চাইলে ব্যাপকভাবে মােতায়েন সেনাপ্রহরীরা তাঁদের জোর করে ভেতরে ঠেলে দেয় এবং বলে ভবনের বাইরে পা বাড়াবার চেষ্টা নিলে তাঁদের গুলি করা হবে। | হােটেলের আশপাশে গােলাগুলি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং রাত একটার দিকে গােটা শহরেই গুলি বর্ষণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়।
১-২৫ মিনিটে বাইরের মিলিটারি গার্ডদের হুকুমে হােটেলের টেলিফোন লাইন কেটে দেওয়া হয়। একই সময়ে টেলিগ্রাফ টাওয়ারের বাতি নিভে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভারি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। বাজার আক্রমণ। রাত ২-১৫ মিনিটে মেশিনগান বসানাে একটি জিপগাড়ি হােটলের সামনে দিয়ে ময়মনসিংহ রােডে ওঠে এবং একটি শপিং সেন্টারের সামনে থেমে দোতলার জানালার দিকে নিশানা করে। এক ডজন সৈন্য পায়ে হেঁটে জিপের পিছু পিছু অবস্থান নেয়। তাদের কারাে কারাে কাঁধে রকেট জাতীয় অস্ত্র। | দোতলা থেকে হঠাৎ চিৎকার ভেসে আসে, বীর বাঙালি এক হও’ এবং সৈন্যরা ঝাঁকে ঝাঁকে মেশিনগানের এলােপাতাড়ি গুলিবর্ষণেভবন ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। এরপর সৈন্যরা গুলি ছুড়তে ছুঁড়তে শপিং সেন্টারের পাশের গলিতে ঢােকে এবং পথ-আটকে-রাখা গাড়িগুলাে উল্টে ফেলে দেয়। সৈন্যদের হাতের টর্চের আলােয় উদ্ভাসিত হয়েছিল এইসব দৃশ্য এবং হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের একাদশ-তলা থেকে দর্শনরত সাংবাদিকদের কাছে এসব ছিল এক অবিশ্বাস্য নাটক। সৈনিকরা যখন গলির ভেতরে গুলি ছুড়ছিল তখন প্রায় ২০০ গজ দূর থেকে ১৫-২০ জন বাঙালি তরুণের একটি দল তাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। তারা সৈন্যদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিল, তবে মনে হচ্ছিল তারা নিরস্ত্র, তাদের কারাে হাতে কিছু নেই। | জিপের ওপরের মেশিনগানের নিশানা ঘুরে গেল তাদের দিকে এবং শুরু হলাে একটানা গুলিবর্ষণ। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসজ্জিত সৈন্যরাও যােগ দিল সাথে। দু’পাশের ছায়াময় অন্ধকারে সটকে পড়লাে বাঙালি তরুণেরা। কেউ আহত-নিহত হলাে কি-না এখান থেকে ঠাহর করা অসম্ভব।
এরপর সৈন্যরা আবার গলির দিকে দৃষ্টি ফেরালাে। একটি গ্যারেজে আগুন লাগিয়ে এগিয়ে গেল। দৃশ্যত তাদের মূল লক্ষ্য, সৈন্যবাহিনীকে কটাক্ষকারী শেখ মুজিবের কড়া সমর্থক ইংরেজি দৈনিক দি পিপল-এর দপ্তর ও ছাপাখানা। | পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাষা উর্দুতে চিৎকার করে তারা ভেতরের লােকদের আত্মসমর্পণ নচেৎ মৃত্যুবরণ করার হুশিয়ারি জানালাে। কোনাে জবাব মিললাে না, ভেতর থেকে কেউ বেরিয়েও এলাে না। এরপর সৈন্যরা ভবনের দিকে তাক করে রকেট ছুঁড়ে মারলাে এবং মেশিনগান ও হালকা অস্ত্রের গুলিবর্ষণ শুরু করলাে। তারপর তারা প্রেস ও যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করে ভবনে আগুন লাগিয়ে দিলাে। আরাে ভেতরে এগিয়ে গলিতে যেসব দোকান ও ঝুপড়ি ছিল তাতে তারা অগ্নিসংযােগ করলাে এবং অগ্নিশিখা দ্রুত দোতলা ভবনের মাথা ছাপিয়ে উঠলাে। রাত চারটার অব্যবহিত পর আর্তচিৎকার কিছুটা থিতিয়ে এলাে, তবে কামান ও মেশিনগানের গােলাগুলি বর্ষণের বিক্ষিপ্ত আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। অনেক দূর থেকে ছোঁড়া ট্রেসার বুলেট হােটেলের পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল। | ৪-৪৫ মিনিটে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর হেড কোয়ার্টারের দিকে আরেকটি বড় অগ্নিকাণ্ড দেখা গেল। ৫-৪৫-এর দিকে সকালের ধূসর আলােয় ছ’টি চৈনিক টি-৫১ ট্যাঙ্কে সওয়ারি সৈন্যরা ঘর্ঘর করে শহরের দিকে এগিয়ে গেল এবং রাস্তায় টহল শুরু করলাে। গতকাল সারাদিন এবংআজ সকালে সাংবাদিকদের বহিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত থেকে থেকে দহন ও গােলাবর্ষণ চলছিল। গতকাল সকালে মাথার ওপর হেলিকপ্টার চক্কর দিয়েছে, নিশ্চিতই তদারকির কাজে। গত নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের পর ত্রাণকাজের জন্য সৌদি আরব যে চারটি হেলিকপ্টার পাকিস্তানকে দিয়েছিল, এই সামরিক অভিযানে সেগুলাে ব্যবহৃত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর দখলকৃত ঢাকা বেতারে সকাল সাতটায় ঘােষণা করা হয় প্রেসিডেন্ট আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে এসেছেন এবং রাত আটটায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। সকাল আটটার অল্পকাল পরে আগুপিছু জিপ ও ট্রাকে মােতায়েন সশস্ত্র প্রহরায় একটি
১৯৬১ মডেলের শেভ্রলেট গাড়ি হােটেলের সামনে এসে থামে। এই গাড়িবহর জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তাঁর সঙ্গীদের এয়ারপাের্টে নিয়ে যাবে। | পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান নেতা জনাব ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্জনে শেখ মুজিবের দাবির বিরােধিতা করেছিলেন। সাধারণভাবে এটা মনে করা হয় যে, সেনাবাহিনী | ও পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ীমহল সমর্থিত বা সৃষ্ট এই বিরােধিতাই সাম্প্রতিক সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে। বাঙালিরা যে তাদের বর্তমান দুর্গতির জন্য তাঁকেই মূলত দোষারােপ করে এ সম্পর্কে সচেতন ভুট্টো হােটেলের লবিতে এলেন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রধারী সামরিক ও শাদা পােশাকের প্রহরী বেষ্টিত হয়ে। তাঁকে ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল এবংসাংবাদিকদের সব প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেলেন এই বলে, আমার মন্তব্য করার কিছু নেই। দশটার সময় বেতারে নতুন সামরিক আইন জারির কথা ঘােষিত হলাে। হােটেলে সাংবাদিকরা যতবারই খবরাখবর জানতে চেয়েছেন তাঁদের নিরাশ করা হয়েছে। কূটনীতিক মিশনগুলােতে যােগাযােগ স্থাপনের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। | একবার তর্ক-বিতর্ককালে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে আসা সাংবাদিকদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলােক্যাপ্টেন। তাঁদেরকে ভেতরে ফিরে যাওয়ার আদেশ দিয়ে প্রত্যাবর্তনরত সাংবাদিকদের উদ্দেশে পেছন থেকে চিৎকার করে বললাে, “তােমাদের কিভাবে সামাল দিতে হয় জানা আছে আমার। আমি যদি নিজের লােকজনদের খুন করতে পারি তবে তােমাদেরও পারবাে।’
সঙ্কট নিয়ন্ত্রণে আনার ঘােষণা
কিছুক্ষণ পর সামরিক কর্তৃপক্ষ হােটেলে খবর পাঠালাে সন্ধ্যা ৬-১৫মিনিটের মধ্যে হােটেল ছাড়ার জন্য বিদেশী সাংবাদিকদের তৈরি থাকতে হবে। সাংবাদিকরা জিনিসপত্র গুছিয়ে হােটেলের বিল চুকিয়ে সামনে-পিছে পাঁচ ট্রাক বােঝাই সৈন্যের প্রহরায় যখন হােটেল থেকে এয়ারপাের্টের উদ্দেশে বের হলেন, তখন রাত ৮-২০ মিনিট। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণ সবে শেষ হয়েছে। | হােটেল ত্যাগের ঠিক আগে একজন সাংবাদিক দায়িত্বপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে জিগ্যেস করেছিলেন বিদেশী সাংবাদিকদের বিদায় দেওয়া হচ্ছে কেন। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমরা চাই আপনারা চলে যান, কেননা এটা আপনাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। সবকিছু হয়ে উঠবে অতিশয় রক্তাক্ত। হােটেলের কর্মচারী ও অন্যান্য বিদেশী অতিথি যাঁরা হােটেলে রয়েছেন তাঁরা সবাই মনে করেন সাংবাদিকদের বিদায় ঘটলে সূচনা হবে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের। | হােটেলের একজন কর্মী বললেন, ‘এটা হােটেল থাকছে না, এটা হয়ে উঠবে রক্তাক্ত হাসপাতাল।’ দূরে অব্যাহত গােলাগুলির পটভূমিকায় বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের ব্যাগপত্র কঠোরভাবে তল্লাশি করা হলাে এবং কিছু টেলিভিশন ফি, বিশেষভাবে বি বি সি-র তােলা, বাজেয়াপ্ত করা হয়।
সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ