You dont have javascript enabled! Please enable it!

 নয়াদিল্লি, ভারত মার্চ ২৮, ১৯৭১ –পূর্ব পাকিস্তানে ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে লাঠি ও বর্শা 

ঘরে তৈরি বন্দুক, লাঠি ও বল্লমে সজ্জিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তুলছে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে যারা বিমান, বােমা, ট্যাঙ্ক ও ভারি কামানে সশস্ত্র। তিন রাত আগে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সরকারি বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণের পর এই প্রতিরােধের শুরু, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য অহিংস প্রয়াস থেকে যার বিকাশ। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাদের বিজয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানিরা এবং এই প্রচেষ্টা প্রতিরােধে অগ্রসর হয়েছে। সেনাবাহিনী। মার্চ মাসের শুরুর দিকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসনের জনসংযােগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক অবাধ্য নাগরিকজনকে দমাতে পাকবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে বিদেশী সাংবাদিকদের জানাচ্ছিলেন। | দীর্ঘদেহী এই পাকিস্তানি অফিসার বলেছিলেন, “যখন ডাকা হবে সেনাবাহিনীকে সেটা হবে একেবারে চূড়ান্ত পদক্ষেপ। সেনাবাহিনী হত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই গুলি ছুঁড়বে।’ এই বক্তব্য ছিল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। দুই সপ্তাহ পর গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে পাকিস্তান আর্মি বস্তুত ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী অথবা জানালা থেকে জোরগলায় প্রতিবাদ ধ্বনি তােলা যে কাউকে যথেচ্ছভাবে হত্যা করে চলেছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠাকামী বাঙালিদের আন্দোলন ধ্বংস করে দিতে পূর্ব পাকিস্তানি নাগরিকদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ব্যবহার করছে কামান, মেশিনগান, রিকয়েললেস রাইফেল ও রকেট। 

এটা নিশ্চিত যে, হাজার হাজার বাঙালি মারা পড়বে, তবে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও এর নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জনগণের অঙ্গীকার হচ্ছে গভীর—এতাে গভীর। যে ১০০০ মাইল দূরের কার্যত-বিদেশী সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিয়ন্ত্রণ বহাল রাখতে পারবে কি-না সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে উঠেছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে আছে ভারত ভূখণ্ড দ্বারা। এই দুই জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি, বাহ্যিক অবয়ব সবই আলাদা। ১৯৪৭ সালে অভিন্ন ইসলাম ধর্মের বিচারে ভারত ভাগ করে দুই অঞ্চলবিশিষ্ট দেশটির প্রতিষ্ঠার পর থেকে পুবের ওপর পশ্চিমের আধিপত্য চলছে। | সেনাবাহিনী এসেছে পশ্চিম-দেশ থেকে, যেখানে বড় ব্যবসায়ীদের সমাবেশ, মাথাপিছু আয় বেশি, জিনিসপত্রের দাম কম। ৭৫ মিলিয়ন পূর্ব পাকিস্তানিদের তুলনায় ৫৫ মিলিয়ন পশ্চিম পাকিস্তানিদের সবকিছু অধিকতর ভালাে। অনেক বাঙালিই, পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা এই নামেই পরিচিত, গত কয়েক সপ্তাহে শহর থেকে পালিয়ে দেশের অভ্যন্তরে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। এই সংবাদদাতাসহ সকল বিদেশী সাংবাদিককে শনিবার পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাদের দেহ ও মালপত্র তল্লাশি করে ফিলা ও নােটখাতা বাজেয়াপ্ত করা হয়। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে বিচ্ছিন্ন ও সত্যাসত্য-যাচাই-দুষ্কর যেসব খবর এসে পৌছেছে তাতে দেখা যাচ্ছে আর্মি তাদের নিপীড়ন জোরদার করছে এবং বাঙালিদের প্রতিরােধও বাড়ছে। | পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক আয় ও করের বড় অংশ ব্যয়িত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন প্রকল্পে ও সেনাবাহিনীর খরচ মেটাতে, জাতীয় বাজেটের ৬০ শতাংশ যাদের জন্য বরাদ্দ। সেনাবাহিনীতে বাঙালির সংখ্যা ১০ শতাংশেরও কম।

আমি তাদের অস্ত্র সংগ্রহ করেছে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সসাভিয়েত ব্লক ও কমিউনিস্ট চীন থেকে। এ পর্যন্ত কোনাে বৃহৎ শক্তিই পূর্ব পাকিস্তানে আর্মির তৎপরতার নিন্দাবাদ করে নি। | ঢাকায় অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক আলােচনায় কঠোর গােপনীয়তা অবলম্বন করা হয়েছিল, এই আলােচনা ভেঙে যাওয়ার পরপরই ঘটে আকস্মিক সেনা-আক্রমণ। কিন্তু সামান্য যেসব সংবাদ পাওয়া গিয়েছিল তাতে পরিষ্কার বােঝা যায় পশ্চিমীরা কখনােই শেখ মুজিবকে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ স্বায়ত্তশাসন অর্জন করতে দিতে চায় নি। বাঙালিদের ক্ষোভের প্রতি সহানুভূতিশীল সদাচারী জেনারেল হিসেবে আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের ইতিপূর্বেকার ইমেজ হঠাৎই বিপুলভাবে পাল্টে গেছে। তিনি বলেছেন, আলােচনা ভেঙে গেছে, কেননা নবনির্বাচিত জাতীয় সংসদের অধিবেশনে চুক্তিনামা আলােচনায় শেখ মুজিব অসম্মতি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু মুজিব তাে জানেন জাতীয় সংসদ অধিবেশন শুরুর আগে একটি লিখিত চুক্তিনামায় তাঁকে উপনীত হতে হবে। | আলােচনা গড়িয়ে চলে ১০ দিন ধরে এবং বাঙালি ‘গুজবমহলে নানা রব ওঠে, বড়ড | দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে আলােচনা, কিছু একটা গণ্ডগােল রয়েছে যেন। এই সময় শেখ মুজিব ও তাঁর আওয়ামী লীগ সামরিক শাসন অগ্রাহ্য করে কার্যত গােটা   দেশবাসীর সমর্থনপুষ্ট হয়ে অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। শেখ মুজিবের অনুগামীরা কতক সরকারি সংস্থা দখল করে নেয়, কতক বন্ধ করে দেয় এবং উপেক্ষা করে বিভিন্ন সরকারি নির্দেশ। যেমন একটিতে বলা হয়েছিল প্রতিরক্ষা কাজে নিয়ােজিত বেসামরিক ব্যক্তিদের অবিলম্বে কাজে যােগ দিতে হবে, অন্যথায় ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হবে।

কোনােরকম অর্ধ-স্বায়ত্তশাসন নয়, পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলতে শুরু করে জঙ্গি ছাত্রশ্রমিকরা এবং ওড়ানাে হয় বাংলাদেশের সবুজ, লাল ও সােনালি পতাকা। কিন্তু বাঙালিদের এইসব উদ্দীপ্ত দিনের পরিসমাপ্তি ঘটলােতই। আলােচনায় অগ্রগতি মন্থর হয়ে আসার খবরের পাশাপাশি আর্মি ক্র্যাকডাউনের শঙ্কা দেখা দিতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রতিদিন বিমানযােগে সৈন্য নিয়ে আসা হয় এবং বাঙালিদের অনেকে ভাবতে থাকেন পশ্চিম পাকিস্তানস্থ সরকারকে পূর্বাংশে ব্যাপক সেনা-সমাবেশ ঘটাবার জন্য প্রয়ােজনীয় সময় দেওয়ার জন্যই আলােচনা উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে দীর্ঘ করা হচ্ছে। | বেশ কয়টি শহরে বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয় এবং হতাহতেরও খবর পাওয়া যায়। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটার আগে বিলি করা একটি বিবৃতিতে শেখ মুজিব তাঁর ভাষায় ‘সন্ত্রাসের রাজত্বের’ নিন্দাবাদ করেন। এর প্রায় চার ঘণ্টা পর সৈন্যরা রাস্তায় নেমে এসে গুলি ছুড়তে থাকে। সংগুপ্ত বাংলাদেশ বেতারের দাবি মতাে ৫১ বৎসর বয়স্ক শেখ মুজিব জীবিত ও মুক্ত রয়েছেন, নাকি সেনাবাহিনীর দাবি মােতাবেক তিনি বন্দী হয়েছেন, সেটা কেউ নিশ্চিত জানে না। তবে জীবিত বা মৃত যাই হােন না কেন, তিনি হচ্ছেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরােধের প্রতীক। পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরােধ অভিযানের অসমর্থিত খবর ছাড়াও প্রতিরােধের কিছু স্পষ্টতর নিদর্শন দেখা যাচ্ছে। শুক্রবার সকালে নতুন ১৫টি কঠোর বিধি ঘােষণা করা হয়েছে। এর একটির লক্ষ্য নিশ্চিতভাবেই অসহযােগ আন্দোলন। সকল সরকারি কর্মচারীকে শনিবার সকাল দশটার মধ্যে কর্মস্থলে হাজির হতে বলা হয়েছে।  পূর্ব পাকিস্তানের ৫৫ হাজার বর্গমাইলের খুব কম এলাকারই জরিপ বা ম্যাপ প্রস্তুত করা হয়েছে। সৈন্যবাহিনীর সদস্যরা না জানে এখানকার ভাষা, না বােঝে নদীর স্রোতের গতি। তাদের জীবন দুঃসহ করে তুলতে পারে গেরিলা বাহিনী। এমন কতক নদী রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে প্রায়শ যাদের গতিপথ পরিবর্তিত হয়। একটি ফেরি ধ্বংস করতে পারলে আটকে রাখা যায় এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য।  পাকিস্তানের যদি পর্যাপ্ত বােমা থাকে এবং বিমান হামলার পরিকল্পনা তারা নেয় তাহলেও বােমাবর্ষণে খুব কাজ হবে না। জনসংখ্যা খুব ছড়ানাে, প্রায়শ ছােট ছােট পরিবারে বিভক্ত অঙ্গনে তাদের বসবাস। শহরে বা গ্রামে একত্রসমাবেশ নয় ভালাে রাস্তা। বিশেষ নেই। রেলপথ, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনও খুব সীমিত। কতক অঞ্চলে এসবের অস্তিত্বই নেই।  

বঙ্গোপসাগরের তীরে চট্টগ্রাম হচ্ছে একমাত্র বন্দর যেখানে সৈন্য ও সরবরাহ বােঝাই বড় জাহাজ ভিড়তে পারে। ঢাকার সঙ্গে সড়ক, রেল ও ফেরিযােগে চট্টগ্রামের যে যােগাযােগ তা সহজেই বিপর্যস্ত হতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকের সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। কোনাে কোনাে কূটনৈতিক মহলের হিসেবে সঙ্কট শুরুর আগে এই সংখ্যা ছিল ২৫,০০০। এরপর থেকে সৈন্য-বােঝাই কয়েকটি জাহাজ করাচি বন্দর ছেড়েছে এবং এক রিপাের্টে প্রকাশ, এদের কোনাে কোনােটি চট্টগ্রাম পৌঁছেছে। পশ্চিম থেকে বিমানেও রােজ সৈন্য আসছে।  নতুনহিসেবে সৈন্যসংখ্যা ৩০,০০০-এরও বেশি বলে উল্লেখ করা হয়। কোনাে কোনাে হিসেবে এই সংখ্যা ৬০,০০০ বলা হচ্ছে। তবে সেটা খুব বেশি বলে মনে হয়। পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য আরেক সমস্যা হচ্ছে সকল বিমানকে আসতে হয় ২৮০০ মাইল ঘুরে সিংহল হয়ে, দুইজন কাশ্মিরি কর্তৃক ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান হাইজ্যাক করে পাকিস্তানে নিয়ে তা উড়িয়ে দেওয়ার পর বিগত ফেব্রুয়ারি থেকে ভারত তার আকাশসীমার ওপর দিয়ে পাকবিমানের উডডয়ন নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। | এখন সিংহল যদি মন পাল্টে পাকিস্তানকে অবতরণ ও জ্বালানি গ্রহণের অধিকার থেকে। বঞ্চিত করে তবে সামরিক অভিযান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানে বিমানের জ্বালানি তেলের মজুদ হ্রাস পেয়েছে এবং তেল সরবরাহের জন্য তারা বার্মার। শরণাপন্ন হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত প্রকৃতিই হয়তাে নির্ধারক উপাদানে পরিণত হবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনার মতাে শহর সেনাবাহিনী আরােকিছুকাল তাদেরকজায় রাখতে পারলেও দেশের গভীর অভ্যন্তরে তাদের কার্যকরভাবে অনুপ্রবেশের ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। 

সূত্র : ডেটলাইন বাংলাদেশ – নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান – সিডনি শনবার্গ

২৮ মার্চ ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!