নিউইয়র্ক টাইমস, ১৭ অক্টোবর, ১৯৭১
“বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ”
সিডনী শনবার্গ
নয়া দিল্লী – বাঙালী বিদ্রোহীদের যারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে যেটাকে তারা বাংলাদেশ (বাংলার জাতি) নাম দিয়েছে, বিদেশী কূটনীতিক সেই মুক্তিবাহিনী (মুক্তিবাহিনী) নিয়ে বলেছিলেন, “ভিয়েতকং যদি ছয়মাস পর থেকে ভালো করতে পারে, তাহলে তারা এটাকে একটা উল্লেখযোগ্য সূচনা হিসাবে বিবেচনা করতো।
গত মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন বাংলা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করেছিল, একটি বিশৃঙ্খল ও বিভ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধাতখন মুক্তিবাহিনীতে পরিণত হয়েছে, যারা কার্যকর পদক্ষেপে নেমেছে এবং যাদের ভালো যুদ্ধাস্ত্র না থাকলেও অন্ততপক্ষে একটি যুক্তিসঙ্গতভাবে সমন্বিত এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে কার্যকর গেরিলা বাহিনীর চেয়ে বেশি।
ভারত অস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছে এবং পরিষ্কারভাবে, ভারতীয় সাহায্য ছাড়া বিদ্রোহী কার্যক্রমের মাত্রা কখনোই বর্তমান অবস্থায় পৌছাতে পারতোনা। কিন্তু জনগন এবং প্রেরণা পূর্ব পাকিস্তানি এবং এমনকি যদি তারা তাদের নিজেদের মত থাকতো তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদল কতৃক বাংলা প্রতিরোধ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হতো কিনা এটা অনিশ্চিত।
আনুমানিক ৮০,০০০ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়, পাশাপাশি কয়েক হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ। তারা প্রায় ১০,০০০ রাজাকার নামে পরিচিত অবাঙ্গালী রক্ষিবাহিনীকে জরুরী প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
এই বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা আনুমানিক ৮০,০০০ থেকে ১০০,০০০ এই পরিসীমার মধ্যে; বিদেশী পর্যবেক্ষকরা মনে করেন কম সংখ্যা সম্ভবত বেশি বাস্তবসম্মত। ১৫,০০০ বাঙালি নিয়ে গঠিত হয় পেশাদারি সৈন্যদের প্রধান গ্রুপ, যাদের মধ্যে কিছু উচ্চ-প্রশিক্ষন প্রাপ্ত নয়, তারা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (আধাসামরিক সীমান্ত প্রহরীদল) এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (একটি ভাল প্রশিক্ষিত নিয়মিত ইউনিট বাহিনী) থেকে বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষত্যাগ করেছে। উপরন্তু, আনুমানিক ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০ নতুন যোগদানকারীদের বেশিরভাগই বয়স ১৮ থেকে ২৫ এর মধ্যে এবং বেশিরভাগই কলেজ শিক্ষার্থীর সাথে অনেক গ্রাম্য ছেলেদেরকেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
অনেকে বাংলাদেশ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও ঘাঁটি এলাকা ভারতীয় সীমান্ত অঞ্চলে, কিন্তু বাঙালি সৈন্যদলের একটা ক্রমবর্ধমান সংখ্যা শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরের “স্বাধীন এলাকা” থেকে পরিচালিত হচ্ছে। এই অঞ্চলগুলো বড় নাহলেও বিস্তৃত হচ্ছে।
নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কিছু সৈন্যকে নিয়মিত সৈন্যদের মত এবং অন্যদের গেরিলাদের মত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। শেষোক্ত দলটি গ্রাম্য পোশাক গ্রহন করেছে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে আছে। যাহোক, প্রাথমিকভাবে অস্ত্রের স্বল্পতা এবং একটা বিরাট সংখ্যক ছেলেরা তাদের অপূর্ণাঙ্গ মৌলিক প্রশিক্ষণ নিয়েই যুদ্ধে অংশগ্রহন করে যা বস্তুত শারীরিক ব্যায়াম ও প্রাথমিক ড্রাইভিং এর তুলনায় কমই এসব কারণে মুক্তিবাহিনীর প্রয়োজনের তুলনায় বেশি স্বেচ্ছাসেবক আছে।
মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রগুলো অনেক মলিস আছে। কিছু স্টেনগান আছে। হাল্কা মেশিনগান ও অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, এবং অনেক পুরানো সিঙ্গেল-শট রাইফেলও আছে। ভারি অস্ত্রশস্ত্র হলো হালকা ও মাঝারি মর্টার এবং তারা সংখ্যায় খুবই কম। এসব অস্ত্র বিভিন্নভাবে তৈরি এবং বিভিন্ন সময়ের, কিছু পাকিস্তানী সৈন্যদের থেকে কেড়ে নেওয়া এবং কিছু ভারতীয়দের কতৃক প্রদত্ত – যদিও বাঙালিদের অভিযোগ সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
তবুও এইসব সমস্যা নিয়েও মুক্তিবাহিনী কার্যকরভাবে কিছু এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের উত্ত্যক্ত করেছে এবং এটা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে দিয়েছে। নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, পাকিস্তানি হতাহত বাড়ছে। গেরিলাদের স্থানীয় অবাঙালি নিয়ে গঠিত “শান্তি কমিটির” সদস্য ও অন্য সহযোগী যারা সেনাবাহিনীর দখলদারিত্বে এলাকার প্রশাসন চালায় তাদের হত্যা কড়ছে। গেরিলা হতাহতের কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি, কিন্তু ধারণা করা যাচ্ছে সেরকম সংখ্যা কম। তবে, প্রতিটি গেরিলা অভিযানে প্রতিহিংসামূলকভাবে সৈন্যরা পল্লী পোড়াচ্ছে এবং গ্রামবাসীদের হত্যা করছে।
সেতু, সড়ক ও রেল লাইন ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশৃঙ্খল রেখে সেনাবাহিনীর চলাচল কমাতে সক্ষম হওয়াই গেরিলাদের সর্বশ্রেষ্ঠ সাফল্য। এছাড়াও গেরিলা ফ্রগম্যানেরা (ডুবসাতারুরা) প্রায় এক ডজন সমুদ্রগামী জাহাজ, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি বিদেশী, ডুবিয়ে দিয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্থ করেছে, যেগুলো বন্দরে নোঙর করেছিল। সাতটি ব্রিটিশ শিপিং লাইন পূর্ব পাকিস্তানে তাদের সকল চলাচল স্থগিত করেছে।
যদিও মুক্তিবাহিনী ছয় মাস আগের থেকে এখন অনেক সমন্বিত, এটা কোন একপাক্ষিক যুদ্ধদল নয়। কিছু প্রো-পীকিং সাম্যবাদি সহ স্প্লিন্টার গ্রুপ তাদের নিজেদের মত করে অপারেশন শুরু করেছে। এক গ্রুপ, ঢাকা থেকে অসাম্যবাদি জঙ্গি ছাত্রদের নেতৃত্বে, ভারতীয় সীমান্তের ত্রিপুরা অঞ্চলে ১৫০০ জনের একটা ঘাটি স্থাপন করেছে। তা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ আন্দোলন বা বাম আন্দোলনের মধ্যে কোনো গুরুতর বিভক্তির কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
মৌসুমী বৃষ্টিপাত শেষ হবার সাথে সাথে আশা করা যাচ্ছে, মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনারা উভয়ই পূর্ব পাকিস্তানে তাদের কার্যক্রম বাড়াবে। প্রচন্ডভাবে প্রহরারত মালবাহী ট্রেনের রেলপথ দিয়ে কলকাতা গেছে, পূর্বনির্দিষ্ট মুক্তিবাহিনীর জন্য সামরিক সরবরাহ বহন করে নিয়ে গেছে। এটা ইঙ্গিত করে যে, ভারত সরকার গেরিলাদের অস্ত্র সহায়তার বৃদ্ধি করতে সম্মত হয়েছে।
কিন্তু মুক্তিবাহিনী কমান্ডার পূর্ব পাকিস্তানের একটি বৃহদাকার অংশ, যেখানে বাংলাদেশ সরকার (বর্তমানে কলকাতা ভিত্তিক) গঠন করা যেতে পারে, বাজেয়াপ্ত করার সম্মুখ সমরে এর থেকেও বেশি ভারতীয় যৌক্তিক সমর্থন এবং আকাশপথ রক্ষার জন্য চাপ দিতে থাকে। ভারতীয়রা এখনো পর্যন্ত দ্বিধান্বিত কারণ তারা ভাবছে এটি তাৎক্ষনিকভাবে পাকিস্তানের সাথে একটা সাধারন যুদ্ধ সৃষ্টি করবে। গেরিলা যুদ্ধের সকল কার্যকারিতার জন্য বাংলাদেশী নেতাবৃন্দ যুক্তি দেখান, এটার অত্যল্পকালস্থায়ী প্রকৃতি অবশেষে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি প্রতিহিংসার কারণে জনপ্রিয় সমর্থনের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ব্যহত করবে।
“আমরা অনেক গ্রামবাসীর সহানুভূতি হারাবো”, এক উচ্চপদস্থ বাঙালি কর্মকর্তা বলেন। “তারা আমাদের বলেন, যদি আপনি আমাদের সমর্থন চান, আপনাকে অবশ্যই পূর্ণদ্যোমে আসতে হবে এবং আমাদের রক্ষা করতে হবে”
—————– সিডনি এইচ শনবার্গ