১৮ মে মঙ্গলবার ১৯৭১
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পূর্ববঙ্গ থেকে ক্রমবর্ধমান উদ্বাস্তু আগমনের মুখে ভারত তার জাতীয় স্বার্থে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। আমাদের ওপর কোনাে পরিস্থিতি চাপিয়ে দেওয়া হলে তা মােকাবিলা করতে ভারত পুরােপুরি প্রস্তুত। তিনি বলেন, ভারতে ক্রমবর্ধমানহারে উদ্বাস্তুদের আগমন এ অঞ্চলের শান্তির পক্ষে হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ব্রিটিশ কমন্সসভায় বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর আলােচনাকালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরােধ ব্যবস্থা আরােপের আহ্বান জানানাে হয়। সাবেক দেশরক্ষা সচিব মি, হেইলি বলেন, সাহায্য প্রদানের শর্ত হিসেবে পাকিস্তানের বর্তমান সমস্যা মীমাংসার অগ্রগতি সাধনে ব্রিটেন অবশ্যই চাপ দিতে পারে। সিনেটের ফ্রাঙ্ক চার্চ মার্কিন সিনেটে এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধে সত্যিই যদি নিরপেক্ষ থাকতে হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রদত্ত অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তান তার নিজের জনগণের ওপর ব্যবহার করছে। নির্বাচিত নেতৃবর্গকে হত্যা ও পূর্ব বাংলার জনসাধারণের ওপর অত্যাচার চালানাের ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের বিষয় নয় বলে পাকিস্তান সামরিক সরকার যে যুক্তি দেখিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অবশ্যই উচিত তা বাতিল করে দেওয়া। মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বেতার ভাষণে বলেন, মুক্তিসংগ্রামের অন্ধকার অধ্যায় কাটিয়ে আমরা শুভপ্রভাতের দিকে এগিয়ে চলেছি। সেদিন বেশি দূর নয় যেদিন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বহু বিদেশি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করবে।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেন, মুক্তিফৌজের কঠোর প্রতিরােধ ও তীব্র পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তান বাহিনী হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ ইতােমধ্যে অভাবিত ত্যাগ স্বীকার করেছে। লাখ লাখ লােক ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর গুলিতে প্রাণ দিয়েছে। গৃহহারা হয়ে পথের ভিখিরি হয়েছে। সন্তানহারা মায়ের অশ্রুতে বাংলার আকাশ-বাতাস আজ ভারাক্রান্ত। শহীদের রক্তে বাংলাদেশের পথ-প্রান্তর। আজ রক্তগঙ্গা। তবু জাতি সংগ্রামী মনােবল হারায়নি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম আরও বলেন, সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির ত্যাগ বৃথা যেতে পারে না এবং তা বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। বাঙালির এই অশ্রু একদিন তাদের মুখে হাসি ফোটাবেই। তিনি বাংলাদেশে ইতিহাসের বৃহত্তম গণহত্যার ঘটনায় মুসলিম রাষ্ট্রবর্গের নীরবতা অবলম্বনে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর সহযােগী বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে মুক্তিসংগ্রাম বিরােধী ঘৃণ্য কাজ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। ধর্ম, বর্ণ ও মতাদর্শ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তির লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করার আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, জয় আমাদের সুনিশ্চিত। কোনাে শক্তিই তা ঠেকাতে পারবে না। বাঙালিরা মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করবেই করবে। | চিফ সেক্রেটারি, বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের আই, জি, বেশকিছু জেলা প্রশাসক ও এস, পি-সহ প্রাদেশিক সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করে তাদের স্থলে পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের নিয়ােগ করা হয়। পি, ডি, পি-র মৌলবী ফরিদ আহমদ আওয়ামী লীগ সদস্যদের প্রকাশ্য বিচার দারি করে বলেন, পাকিস্তানের সংহতির স্বার্থে তা করা প্রয়ােজন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য ১৯৪৭ সাল থেকেই চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। নেজামে ইসলামীর মহাসচিব (প্রাদেশিক) মওলানা আশরাফ আলী বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। জনগণের উচিত সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা রাখা।
সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান