You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুজিব বাহিনীর উপর জিয়ার ক্ষোভ
মুক্তিযোদ্ধা হত্যার ষড়যন্ত্রে জিয়া
জেলের ভেতর ৫১ টি ধর্মঘট ও বিপরীতে হত্যাকাণ্ড
জেলে পুরে আবার ছাড়া পাবার সময় জেলগেট থেকে গ্রেফতার ৯ হাজার

মুক্তিযােদ্ধার লাশ
১৯৭৫ পূর্ববর্তী খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি মামলা দায়ের হয় বাজিতপুর থানায় ১৯৭৬ সনে। ঘটনার বিবরণ অস্পষ্ট। অনেকটা বানােয়াট। ঘটনায় যারা নিহত হয়েছিলেন তারা সর্বহারা পার্টির লােক। ‘৭৫ পরবর্তী সামরিক শাসন জারীর পর এই ঘটনা নিয়ে মামলায় আসামী করা হয় ৫ জন মুক্তিযােদ্ধাকে। আসামীরা হলেন আবুলাল, শামসুদ্দিন, আবদুর রউফ, কাঞ্চন মিয়া, ও চান মিয়া। এরা মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর সদস্য ছিলেন। ‘৭৬ সনে এই মামলার আসামী আবুলাল ও শামসুদ্দিকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭৬ সালে আগষ্ট মাসে আবদুর রউফ এবং কাঞ্চন মিয়া সামরিক আদালতে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭৭ সালে ২৮শে সেপ্টেম্বর জিয়া কর্তৃক গঠিত ঢাকার দুই নম্বর সামরিক আদালত ৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত ৫ জনের মধ্যে চাঁদ মিয়া পলাতক ছিলাে। ৩রা জুন ‘৮০ দিনগত মধ্যরাতের পর বিশেষ সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ৪ জনের ফাঁসি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সম্পন্ন হয়। সরকারী মুখপাত্রের মতে এরা সকলেই ছিলেন মুজিব বাহিনীর সদস্য।

সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যা:
৩৭. ৪ঠা জুন বুধবার সন্ধ্যায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ প্রধান আবদুল মালেক উকিল ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক চারজন মুক্তিযোেদ্ধার ফাঁসির প্রতিবাদে দেশব্যাপী তিনদিন দলীয় পর্যায়ে শোক পালন ও ৭ জুন অর্ধদিবস হরতালের কর্মসূচী ঘােষণা করেন। তারা বলেন, ফাসির আগেও আমরা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করেছিলাম এবং তিনি ৪৮ ঘন্টা ফাসি স্থগিত রাখেন। ফাসির দুই ঘন্টা আগেও রাত ১২টায় আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের নেতা জনাব আসাদুজ্জামান খান ও সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুর রাজ্জাক বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে আরেক দফা সাক্ষাৎ করেন এবং ফঁসির আদেশ মওকুফ করার জন্য তারা একটি লিখিত আবদনপত্র পেশ করেন। বাজিতপুর হত্যা মামলাকে সামরিক আইন জারি হওয়ার আগেকার ঘটনার অস্পষ্ট অভিযােগের ভিত্তিতে সাজানাে হয়েছে বলে তারা উল্লেখ করেন। জনাব মালেক উকিল স্বাধীনতাবিরােধীদের দণ্ডাজ্ঞা মওকুফ ও মুক্তিদানের কথা উল্লেখ করে বলেন, . “মুক্তিযােদ্ধাদের ফাসিদান সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যা।” দেশবাসীকে রাজনৈতিক হত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার আহবান জানান।

৩৮. ৪টি লাশ কফিনবদ্ধ করে সন্ধ্যা সােয়া ৬টায় বায়তুল মােকররমে প্রাঙ্গণে আনা হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও বহু লােকের উপস্থিতিতে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ নামাজে জানাজা পড়ান। জানাজা শেষে ৪টি কফিন নিয়ে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলকারীরা ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবাে না’, ‘স্বৈরাচারীর গদিতে আগুন জ্বালাে একসাথে’ ইত্যাদি শ্লোগান সহকারে শহরের কয়েকটি রাস্তা প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনারে পৌছে। সেখান থেকে লাশ বাজিতপুরে নিয়ে যাওয়া হয়।

রঙিন চশমার আড়ালে নিষ্ঠুর জিঘাংসা
৩৯. জিয়াউর রহমান আমলে দেশের জেলখানাগুলিতে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বিনা কারণে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার বন্দীদের আটক, তাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালানাে হয়। দেশের প্রতিটি কারাগারে স্থান সংকুলান না হওয়ায় এদের গাদাগাদি করে রাখা হয়। খাবার ছিলাে অত্যন্ত নিম্নমানের। চিকিৎসার ব্যবস্থাও ছিলােনা তেমন। বন্দীদের অধিকাংশই ছিলাে মুক্তিযােদ্ধা। তারা চোখের সামনে দেখছে স্বাধীনতা বিরােধীদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে—আর তাদের দিয়ে জেল ভর্তি করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে তাদের ক্ষোভ ছিলাে প্রচন্ড। ১৯৭৮ সন থেকে ১৯৮০ সনের ২২শে জুন পর্যন্ত জেলের অভ্যন্তরে ৫১টি ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। ২০

মুক্তির আদেশ ঃ পুনরায় গ্রেফতার
রঙিন চশমার অন্তরালে নির্মম নিষ্ঠুর জিঘাংসায় উন্মত্ত জিয়ার হৃদয় ছিলাে সীমারের চেয়েও কঠিন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য হত্যা ও নিপীড়ণে তার বিবেককে দংশন করেনা। সামরিক প্রতিপক্ষকে যেমনভাবে রক্তের বদলায় শায়েস্তা করেছেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতিও করেছেন অনুরূপ আচরণ। অনেক নেতাকর্মী হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু জেলগেট থেকেই তাদের করা হয়েছে পুনরায় গ্রেফতার। এর সংখ্যা একজন নয়-হাজার হাজার।

নির্মম অত্যাচার আর হিংস্রতা
৪০. রাজনৈতিক ব্যক্তিদের গ্রেফতার করার পর তাদের উপর চলতাে নির্মম অত্যাচার। আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের উপর যে কিভাবে অত্যাচার হতাে তার বর্ণনা দেয়া দুঃসাধ্য। জেরা করার সময় বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতন, গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে পেটানাে, শরীরের গুপ্ত স্থানে বরফ ঢুকানাে, অন্ডকোষের সঙ্গে ইট বেধে ঝুলিয়ে দেয়া, খাবার না দেয়া, পানির বদলে মগে পেশাব করে খেতে বলা, এসব অভিযােগ ছিলাে হাজার হাজার।

মাহফুজ বাবু কোথায় ঃ অন্ততঃ লাশটা দাও
৪১. রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করার জন্য জিয়াউর রহমান ব্যবহার করেছেন গােয়েন্দা বাহিনীকে। এরা সাদা পােশাকে ঘুরে বেড়াতাে। বিভিন্ন গাড়ী ব্যবহার করতাে। যখনই নির্দেশ আসতাে তখনই তারা তৎপর হয়েছে। এসব সাদা পােশাকধারী বাহিনীর সদস্যগণ যাকে গ্রেফতার করেছে তাদের অত্যাচারে হত্যা করা হয়েছে অথবা তাদের লাশ গুম করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের বলিষ্ঠ নেতা মাহফুজ বাবুকে ‘৭০ সনে পুরনাে ঢাকা হতে দিনের বেলা প্রকাশ্যে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় সাদা পােশাকধারীরা। মাহফুজ বাবু আজো ফিরে আসেনি। তার মা কাদতে কাদতে অন্ধ হয়ে গেছেন। তার কাছে যেই দেখা করতে যেতে তার মায়ের প্রশ্ন ছিলাে আমার মাহফুজ বাবু কোথায়? হয় তাকে এনে দাও-না হলে অন্ততঃ তার লাশটা দাও। মাহফুজ বাবু-র এই নির্মম অদৃশ্যতা’-একটি নয়। একাধিক। হাজার হাজার। এই ছিলাে জেনারেল জিয়ার গণতান্ত্রিক (1) বাংলাদেশের চিত্র।

রেফারেন্স – জেনারেল জিয়ার রাজত্ব -অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!