১৩ জুন রবিবার ১৯৭১
জামায়াতে ইসলামীর আমীর মওলানা আবুল আলা মওদুদী যুক্তরাষ্ট্রের ভারতঘেঁষা নীতি ও পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল অবলম্বন করার জন্য মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য গ্রহণে বিরত থাকতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, পাকিস্তানের পূর্ব অংশকে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে ব্যর্থ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন যারা পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে চলে গেছে তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা শুরু করেছে। তিনি বলেন, পাকিস্তান সরকারের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সকল সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, যুক্তরাষ্ট্রের ভারতঘেঁষা নীতি পাকিস্তানের জনগণ ঘৃণা করে। | পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মােহাম্মদ আলী জাতীয় ঐক্যের রাজনীতির খাতিরে দুবছরের জন্য দলীয় রাজনীতি ও শাসনতান্ত্রিক বিতর্ক বন্ধ রাখার আবেদন জানান। পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ এফ. ফারল্যান্ড ঢাকায় গভর্নর টিক্কা খানের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। পশ্চিম পাকিস্তানে শুভেচ্ছা সফররত পূর্ব পাকিস্তান আইনজীবী প্রতিনিধি দলের নেতা জুলমত আলী খান করাচিতে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেন, বেআইনি আওয়ামী লীগ ৭০-এর নির্বাচনে জনগণের বিপুল ভােটে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছে তা মােটেই ঠিক নয়। তিনি পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পাকিস্তানের মানচিত্র থেকে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যেত। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। বেআইনি আওয়ামী লীগের পেছনে কোনাে জনসমর্থন নেই।
মুক্তিবাহিনী খুলনার সাদীপুর, শাখরা ও কুমিল্লার বিবির বাজারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এক ভাষণে বলেন, গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সরকারের প্রশাসনিক কাজে সরাসরি অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি আত্মমর্যাদাবান জাতি হিসেবে আমরা বাঁচতে চাই । এই উদ্দেশ্যে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনী মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবনপণ লড়াই করছে। প্রয়ােজনীয় অন্ত্র পেলে ইনশা আল্লাহ আমাদের বীর মুক্তিযোেদ্ধারা অচিরেই দেশ থেকে হানাদার বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হবেন। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধকে অধিকতর সুসংগঠিত ও জোরদার করার জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে প্রয়ােজনীয় অস্ত্র সাহায্যের আবেদন জানান। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে ইসলামাবাদের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্যও বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের জনগণ ও সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে এবং ইনশা আল্লাহ সাড়ে সাত কোটি মানুষের ইচ্ছা বাস্তবায়িত হবেই ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনসাধারণের ইচ্ছার ভিত্তিতে গঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারই দেশের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে আমাদের জনগণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই সংগ্রাম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের অবসান ঘটানাের জন্য জনসাধারণের ইচ্ছা থেকে উৎসারিত। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দখলদার শত্রুরা এক নিদারুণ অবস্থায় পড়েছে। আমাদের মুক্তিবাহিনী প্রতিদিন শত্রুর ওপর আক্রমণ চালিয়ে সরবরাহ ও যােগাযােগ ব্যবস্থার গুরুতর বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। পাকিস্তানি বাহিনী সুপরিকল্পিত হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের নীতি গ্রহণ করে তারা নিজেদের মানুষ ও সভ্যতার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তিনি বাংলাদেশ থেকে দখলদার সামরিক বাহিনী তুলে না নেওয়া পর্যন্ত ইসলামাবাদ সরকারকে কোনাে সাহায্য না দেওয়ার জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, ইসলামাবাদকে সাহায্যদান মানেই পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং সে শক্তি কেবল বাংলাদেশের মানুষকে দমন করার কাজেই ব্যবহৃত হবে। প্রধানমন্ত্রী গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য না করার জন্য মুসলিম বিশ্বের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, জনসাধারণের ইচ্ছা ও মানবাধিকারকে বর্বরােচিতভাবে দমন করে জেনারেল ইয়াহিয়া ইসলামের দোহাই পাড়ছেন। তিনি বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির স্বাধীনতা লাভের আকাক্ষা থেকে উৎসারিত। এ যুদ্ধে জয় আমাদের হবেই তাতে কোনাে সন্দেহের অবকাশ নেই।
সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান