৮ জুন মঙ্গলবার ১৯৭১
ঢাকায় এক নম্বর বিশেষ সামরিক আদালত ওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দস ৫ জনের প্রত্যেককে ৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন এবং তাদের সম্পত্তির শতকরা ৫০ ভাগ বাজেয়াপ্ত ঘােষণা করেন। তাদের অনস্থতে বিচার করা হয় । তারা হলেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান, তােফায়েল আহামদ ও আবিদুর রহমান (সম্পাদক, দি পিপল)। বগুড়ার জাতীয় পরিষদ সদস্য হাবিবুর রহমান এক বিবৃতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটিয়ে বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের (মুক্তিবাহিনী) সাথে তার কোনাে সম্পর্ক নেই। তিনি একজন খাটি পাকিস্তানি হিসেবে দেশের সেবা করে যাবেন। সময়মতাে পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করায় তিনি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীকে অভিনন্দন জানান। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম লন্ডনে বলেন, নতুন অর্থনৈতিক সাহায্য প্রকল্পে সম্মত হবার আগে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ব্রিটেন পাকিস্তানের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তবে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ওপর রাজনৈতিক সমাধান চাপিয়ে দিতে পারি না। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং-এর মস্কো সফরকালে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামে নৈতিক সমর্থন ও সহযােগিতার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রয়েল কমনওয়েলথ সােসাইটির লন্ডন হেডকোয়ার্টারে প্রদত্ত ভাষণে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, সংবাদপত্র খুললেই আপনারা দেখতে পাবেন পূর্ব বাংলার নাগরিকরা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। ভারতে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু এসবের কারণ কি? কোথায় এই হত্যাযজ্ঞের সূচনা? এই মানবিক লাঞ্ছনার। জন্য দায়ী কে? তিনি বলেন, আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, পূর্ব বাংলার জনগণ। তাদের প্রত্যাশা আর আকাক্ষার অপূর্ণতা এবং রাজনৈতিক শাসন ও অর্থনৈতিক শােষণে দীর্ঘদিন ধরে জর্জরিত ছিল। ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে জনগণ ভােটকেন্দ্রে গিয়েছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শােষণের কথা মনে রেখেই। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানাের জন্য ভােট দেয়। কারণ, তারা বৈদেশিক বাণিজ্য ও অন্যান্য বিষয়ে ৬ দফার দাবিতে প্রদেশের হাতে ক্ষমতা দিয়েছিল, যাতে অভিন্ন পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিকে স্বীকার করে দুটি অঞ্চলই হাতে হাত ধরে এক পাকিস্তানের শান্তি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের প্রতিনিধি বলেন, ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আসনে আওয়ামী লীগের জয়লাভ করার ব্যাপারটাকে ইয়াহিয়ার মন্ত্রণাদাতারা ভালাে চোখে। দেখেনি। সামরিক একনায়কেরা বুঝতে পেরেছিল জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার সময় এসে গেছে। এই উপলব্ধিতেই তারা মাত্র ৩০টি আসন পাওয়া জুলফিকার আলী ভুট্টোকে নিজেদের দলে টেনে নিল। ভুট্টো ঘােষণা করলেন, ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন তিনি বয়কট করবেন। চাপের মুখে ইয়াহিয়া পরিষদ অধিবেশন বাতিল করলেন। শেখ মুজিবুর রহমান নিয়মতান্ত্রিকভাবে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে হরতালের কর্মসূচি। দিলেন। পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগােষ্ঠী তার আন্দোলনের সাথে যােগ দিল । কেননা, পূর্ব বাংলার জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানকে তাদের আইনসম্মত শাসক হিসেবে গ্রহণ করেছিল। বিচারপতি চৌধুরী বলেন, এই পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে তার সঙ্গে আলােচনায় বসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। শেখ মুজিব তা গ্রহণ করেন। আর শেখ সাহেব যখন আললাচনায় অংশগ্রহণ করছেন, তখন জাহাজভর্তি অস্ত্র ও পাকসেনা পাঠানাে হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। তারপর ঘটল ইতিহাসের বর্বরতম ঘটনা।
যার শুরু বৃহস্পতিবার ২৫ মার্চের রাতে। আমার ছাত্র ও অধ্যাপকরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল-এ অ্যাপার্টমেন্টে ঘুমিয়ে আছে, পুরাে ঢাকা শহর দ্রিামগ্ন—সেনাবাহিনী নেমে এলাে পথে, নির্বিচারে হত্যা করল ছাত্র আর অধ্যাপকদের। তিনি বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণ জেগে উঠেছে। আওয়াজ তুলেছে। স্বাধীনতার। নতুন এক দেশের অভ্যুদয় হয়েছে—তা আজকের বাংলাদেশ। কোনাে দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিক বা কৌশলগত কারণে না দিক, বাস্তবতা হলাে ইয়াহিয়ার বাহিনী ঢাকাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। এই বাহিনীকে প্রত্যাখ্যান করেছে সমগ্র জাতি। কারও পক্ষেই বাংলাদেশকে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বাধীন রাখা সম্ভব নয়। সাড়ে সাত কোটি মানুষকে এভাবে বন্দী রাখা যাবে । আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার ও পাকসেনা পূর্ব বাংলা নিয়ন্ত্রণ করছে তা মােটেই সত্য নয়। সংখ্যালঘুর নিয়ন্ত্রণে জনগণকে আতঙ্কিত করে কখনাে কোনাে দেশ চালানাে যায় না। পূর্ব বাংলার জনগণ জানে। পাকিস্তানের এই শাসন, পাকসেনার এই আস্ফালন আর বেশি দিন টিকবে না। আমরা এখন ভালােভাবেই জানি, উপনিবেশ থেকে আমরা আমাদের স্বাধীনতার মর্যাদাকে আয়ত্ত করতে যাচ্ছি। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, জীবনযাপন, সংস্কৃতি ও ভাষায় আমরা স্বতন্ত্র। আমাদের জনগােষ্ঠী আলাদা। জাতিসংঘ সনদের ভিত্তিতে নিজেদের আত্মরক্ষার অধিকার আমাদের আছে। সেই আত্মরক্ষার অধিকার আমরা আয়ত্ত করতে যাচ্ছি। আমরা অবশ্যই স্বাধীনতা চাই।
সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান