২ এপ্রিল শুক্রবার ১৯৭১
ঢাকার দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার অপর তীরে জিঞ্জিরায় মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘােষণা করেন অনুপস্থিত সরকারি কর্মচারীবৃন্দ অবিলম্বে কাজে যােগদান করলে তাদের বিরুদ্ধে কোনাে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। কোনাে নাগরিক ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের (মুক্তিযােদ্ধা) আশ্রয় দিলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে । ঢাকা শহরের সমস্ত বাড়ি ও গাড়ির নম্বর এবং বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের সাইন বাের্ড উর্দুতে লিখতে হবে। অবরুদ্ধ ঢাকায় কারফিউ’র মেয়াদ সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত শিথিল করা হয়। ভারতীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারতীয় জনগণের পূর্ণ সমর্থন ও সহানুভূতি প্রকাশ করে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস করা হয় । গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় পূর্ববঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে লােকসভা গভীর দুঃখ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। পূর্ববঙ্গের জনগণের আশা-আকাক্ষা দমন করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সারাদেশের জনগণের ওপর নির্লজ্জ ব্যাপক আক্রমণ শুরু করা হয়েছে। পূর্ববঙ্গের জনগণকে বেয়নেট, মেশিনগান, ট্যাঙ্ক, গােলন্দাজ বাহিনী ও বিমানের সাহায্যে নগ্নভাবে দমনের চেষ্টা চলছে। আমাদের সীমানার এত সন্নিকটে যে জঘন্য বিয়ােগান্তক নাটক চলছে তার প্রতি। লােকসভা উদাসীন থাকতে পারে না। নিরীহ, নিরস্ত্র জনগণের ওপর যে নির্মম অত্যাচার চলছে, আমাদের দেশের সর্বত্র জনগণ দ্বিধাহীন ভাষায় তার নিন্দা করছেন। একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য পূর্ববঙ্গের জনগণ যে সংগ্রাম শুরু করেছেন, তাতে লােকসভার অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহানুভূতি রয়েছে। অসহায় ব্যক্তিদের ব্যাপক হত্যা ও বলপ্রয়ােগ অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য। লােকসভা দাবি জানাচ্ছে। গণহত্যার শামিল ও সুপরিকল্পিত হত্যা অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য লােকসভা বিশ্ববাসী ও বিশ্বের বিভিন্ন সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছে, তারা যেন আপদকালীন এবং গঠনমূলক ব্যবস্থা হিসেবে তৎপর হয়ে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। লােকসভার স্থির বিশ্বাস, পূর্ববঙ্গের ৭৫ মিলিয়ন জনগণের এ ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান সাফল্যমণ্ডিত হবে। লােকসভা তাদের এ আশ্বাস দিতে চায়, তাদের সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার ভারতের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সহৃদয় সহানুভূতি লাভ করবে। পাকিস্তান ভারতের কাছে তার দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারে হাজার হাজার লােক ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঠাকুরগাঁও, সুনামগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের শরণার্থী শিবিরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষের এক হ্যান্ডআউটে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি ভারতীয় পার্লামেন্ট খােলাখুলি সমর্থন ঘােষণার পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ সরবরাহের ব্যবস্থা করেছেন। ঢাকায় সকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ঢাকা হাইকোর্টের ৩৮ জন আইনজীবী এক যুক্ত বিবৃতিতে পাকিস্তানের ঘরােয়া বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপকে নগ্ন ও নির্লজ্জ’ অভিহিত করে এর প্রতিবাদ জানান এবং সম্ভাব্য সকল উপায়ে দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিযােদ্ধা) বাধাদানের জন্য। জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন মৌলবী ফরিদ। আহমদ, মঈনুল হক, এ. ডব্লিউ. চৌধুরী, সফিকুর রহমান, আহমেদুর রহমান। খান, জুলমত আলী খান, মােদাব্বার হােসেন, এ, এম, এইচ, এ, জলিল, নাসির উদ্দিন, আবদুল ওদুদ মিয়া, ইউসুফ আলী খান, মােঃ গিয়াসউদ্দিন ভূঁইয়া, এ, কে, রফিকুল হােসেন, নাসির উদ্দিন চৌধুরী, নাসিম এ. রহমান, মহিতুর রহমান চৌধুরী, আকরাম হােসেন আমিন, আবু সালেক, আবদুর রশীদ, সৈয়দ মােহাম্মদ আলী, মােঃ কুরবান আলী, মােজাম্মেল হক, মােঃ নূরুল হক, মশিউল ইসলাম, এম, এন, আলী, আনিসুর রহমান, নূরুল হুদা খন্দকার, ফজলুল হক, এ. কে. ফজলুল হক চৌধুরী, আহমদ আলী মণ্ডল, মমতাজউদ্দীন আহমেদ, শামসুল হক, সেরাইল ইসলাম, ফরমান উল্লাহ খান, আবু সাঈদ, এইচ কে আবদুল হাই এম. এস, ভুইয়া ও মাহবুবুর রহমান। পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, দেশের সংহতির প্রশ্নে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের মনােভাবের প্রতি তার কোনাে আস্থা ছিল না বলেই তিনি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ক্ষমতা ভাগাভাগির ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ৬ দফা প্রকৃতপক্ষে শাসনতান্ত্রিকভাবে বিচ্ছিন্ন হবার পরিকল্পনা। তিনি আরও বলেন, ২৫ মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কর্মতৎপরতা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন, সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের পত্তন করতে চেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ চরমপন্থা গ্রহণ করে ২৩ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। তারা সশস্ত্র কুচকাওয়াজে অংশ নেয়। ২৭ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট ঘােষণা করে। প্রকৃতপক্ষে তারা ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণার পরিকল্পনা নিয়েছিল।
সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান