১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ১৯৭১
নমাসের দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে বাঙালি জাতির জীবনে আসে নতুন প্রভাত। আসে হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সূচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য বিজয়। পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লে. জেনারেল নিয়াজীর নির্দেশে পাকিস্তান বাহিনী তাের পাঁচটা থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু করে। বেলা নটার সময় যৌথবাহিনীর ডিভিশনাল কমান্ডার জেনারেল নাগরার বার্তা নিয়ে মিরপুর ব্রিজের এপার থেকে ওপারে নিয়াজীর হেডকোয়ার্টার অভিমুখে সাদা পতাকা উড়িয়ে একটি জীপে রওয়ানা হন। ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর দুজন অফিসার। বার্তায় লেখা আছে, “প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এসে পড়েছি। তােমার খেলা শেষ। এখন আমার কাছে আত্মসমর্পণ করবে। এ আমার উপদেশ। জেনারেল নাগরা। এ বার্তা পাবার আগেই জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজী তার বাহিনীর যুদ্ধবিরতি ও অস্ত্র সংবরণের কথা আনুষ্ঠানিক ভারত সরকারকে জানিয়ে দেবার জন্য ঢাকাস্থ মার্কিন সামরিক এটাচিকে অনুরােধ করেন। দিপ্লিন্থ, মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে ভারতে সরকারকে তা অবহিত করা হয়। সকাল আটটার দিকে নিয়াজী ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে আত্মসমর্পণের সর্বশেষ মেয়াদ আরও দুঘণ্টা বাড়ানাের অনুরােধ করেন। বেলা এগারােটার সময় যৌথবাহিনীর অফিসারদ্বয় জেনারেল নিয়াজীর হেডকোয়ার্টার থেকে ফিরে আসেন। তাদের সঙ্গে জেনারেল নিয়াজীর। প্রতিনিধি হিসেবে যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব নিয়ে জেনারেল নাগরাকে অভ্যর্থনা জানাতে আসেন জেনারেল জামশেদ। বেলা। বারােটার দিকে জামসেদের সাথে জেনারেল নাগরা নিয়াজীর অফিসে পৌঁছান। শুরু হয় আত্মসমর্পণের শর্তাবলি নিয়ে দুজনের কথাবার্তা। বেলা একটা নাগাদ কলকাতা থেকে ঢাকা এসে পৌঁছান যৌথবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল জ্যাকব।
ততক্ষণে যৌথবাহিনী মিরপুর ব্রিজ পেরিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতে শুরু করেছে। বেতারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর প্রচারের সাথে সাথে অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীর রুদ্ধবাক লাখ লাখ মানুষ আসন্ন মুক্তির উল্লাসে ফেটে পড়ে। পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ আরােপিত সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। আকাশ-বাতাস মুখরিত করে চারদিকে আওয়াজ ওঠে ‘জয় বাংলা জয় বাংলা’। ধানমন্ডিসহ পুরনাে এলাকায় সকাল ১১টার দিকেই উল্লসিত জনতা রাস্তায় মিছিল বের করে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে রাজধানীর সর্বত্র সদর্পে আত্মপ্রকাশ ঘটে মুক্তিবাহিনীর বীর গেরিলাদের। যৌথবাহিনীর রাজধানী প্রবেশের খবর দাবানলের মতাে ছড়িয়ে পড়ে গােটা নগরীতে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও জনমানবশূন্য রাজধানীর রাজপথ নিমিষে জনতার উত্তাল জোয়ারে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। নিঃশব্দ নগরী আবার বিজয়ের উল্লাসে জেগে ওঠে। কষ্ঠে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি আর হাতে ফুলের মালা নিয়ে মুক্তি বাহিনী ও মিত্রবাহিনীকে স্বাগত জানায় সর্বস্তরের মানুষ । হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধা আর ভালােবাসা দিয়ে বরণ করতে থাকে দেশমাতৃকার বীর সন্তান, বাংলাদেশের। স্বাধীনতার অমর প্রতীক ইতিহাস স্রষ্টা মুক্তিযােদ্ধাদের। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। দিগন্তজুড়ে কেবল ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়, ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’। দুপুর একটার পর জেনারেল হেডকোয়ার্টারে বসে আত্মসমর্পণের দলিল। তৈরির বৈঠক। একপক্ষে নিয়াজী, ফরমান আলী, জামশেদ। অপরপক্ষে জ্যাকব, নাগরা, কাদের সিদ্দিকী। সিদ্ধান্ত হয় আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করবেন বিজয়ী বাহিনীর পক্ষে পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জয়েন্ট কমান্ডিং ইন চিফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা এবং বিজিত বাহিনীর পক্ষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জেনারেল অরােরা আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যােগদানের জন্য বিমান ও নৌবাহিনীর চিফ অব স্টাফসহ কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছান। নিয়াজী অভিবাদনসহ অভ্যর্থনা জানান যৌথবাহিনীর কমান্ডারকে। অবশেষে আসে সেই মুহূর্ত, যে মুহূর্তটির জন্য বাঙালি জাতি দিনের পর দিন প্রতীক্ষা করেছে। জীবন বাজি রেখে নমাস যুদ্ধ করেছে বাংলার দামাল ছেলেরা। লাঞ্ছিত হয়েছে কয়েক লাখ কন্যাজায়াজননী। শহীদ হয়েছে তিরিশ লাখ বাঙালি। বিকেলে রেসকোর্স (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে স্বাক্ষরিত হয় আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক দলিল। ৭১-এর ৭ মার্চ এই রেসকোর্স থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বিকেল পৌনে ৫টায় পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে, জেনারেল এ এ কে নিয়াজী রেসকোর্স ময়দানে আসেন। সামরিক বিধি অনুসারে বিজয়ী ও বিজিত সৈনিকরা শেষবারের মতাে জেনারেল নিয়াজীকে গার্ড অব অনার জানায়। | সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। বিকেল ৫টা। জেনারেল নিয়াজী ও যৌথবাহিনীর অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা এগিয়ে যান ময়দানে রাখা একটি টেবিলের দিকে। টেবিলের একপাশে মাত্র দুটি চেয়ার। জেনারেল অরােরা বসেন টেবিলের ডানদিকের চেয়ারে। তার বাম পাশে বসেন জেনারেল নিয়াজী। দলিল আগে থেকেই তৈরি করা ছিল। জেনারেল অরােরা স্বাক্ষর করার জন্য দলিল এগিয়ে দেন নিয়াজীর দিকে। নিয়াজী অধােবদনে দলিলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। নিয়াজীর কাছে কোনাে কলম ছিল না। ভারতীয় একজন। অফিসার নিজের কলমটি নিয়াজীকে দিলে কাঁপা কাঁপা হাতে পরাজয়ের দলিলে স্বাক্ষর করেন নিয়াজী। সেই সাথে তিনি আইনগতভাবে কবর দেন পূর্ব পাকিস্তানের, আনুষ্ঠানিক স্বীকার করে নেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে। তখন পাঁচটা এক মিনিট।
নিয়াজী দলিলে স্বাক্ষরের পর চারদিকে আকাশ কাঁপানাে স্লোগান ওঠে—জয় বাংলা জয় বাংলা! জেনারেল নিয়াজী উঠে দাঁড়ান। তার পদমর্যাদার প্রতীক খুলে ফেলেন। কোমরে ঝােলানাে রিভলবার বের করে একটি একটি করে সব বুলেট বের করে টেবিলের ওপর রাখেন। তারপর গুলিশূন্য রিভলবার এবং পদমর্যাদার প্রতীকগুলাে তুলে দেন ভারত ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল অরােরার হাতে। এরপর বিজিত নিয়াজী বিজয়ী অরােরার দুহাত ধরে মাথানত করে কপাল ছোঁয়ান। চারদিক থেকে আবার শ্লোগান ওঠে—জয় বাংলা! জয় বাংলা! | জেনারেল অরােরা বিজিত জেনারেলের পিঠে হাত দিয়ে আত্মসমর্পণ স্থলত্যাগ করেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ব্রিগেডিয়ার কাদের সিদ্দিকী ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ, কে, খন্দকার যথাক্রমে মুক্তিবাহিনী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষে উপস্থিত থাকেন। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হলাে বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নসাধ-স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার, মরণপণ যুদ্ধ করে সে অধিকার ছিনিয়ে আনল সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। কিন্তু বাঙালির মুক্তিদূত স্বাধীনতার জনক তখন বন্দী পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার লৌহকারার অন্তরালে। জনক জানে না তার জাতি আজ মুক্ত। তার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে ঢাকা স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানীর মর্যাদালাভের পর সন্ধ্যায় মিত্রশক্তি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এক বিশেষ বেতার ভাষণে ঘােষণা করেন। বাংলাদেশ মুক্ত। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি এখন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত রাজধানী।
সূত্র : দিনপঞ্জি একাত্তর – মাহমুদ হাসান